NIRF (National Institutional Ranking Framework)- এর দ্বারা সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী 2020 বর্ষে সারা ভারতবর্ষে সেরা কলেজগুলির তালিকায় সপ্তম স্থানে রয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির, বেলুড়, হাওড়া। Google ঘেঁটে দেখলাম 2016 সালে প্রথম এ'ধরণের তালিকা প্রকাশ হবার পর 2018 সাল থেকে উপর্যপুরি তিনবছর ধরেই এই কলেজ উপরের দিকে স্থান পেয়ে চলেছে। ভাবতে ভীষণ গর্ব বোধ করি যে একসময় আমি ঐ কলেজের ছাত্র ছিলাম। এই সুযোগে ঐ বিদ্যামন্দিরের কিছু স্মৃতিচারণ করে পাঠককে উপহার দেবার লোভ সামলাতে পারছি না।
আগরতলার মহারাজা প্রতিষ্ঠিত দেড়শতাধিক বৎসর পুরনো ঐতিহ্যশালী উমাকান্ত একাডেমী থেকে উচ্চ মাধ্যমিক (Class XI) পাশ করে 1967-68 শিক্ষাবর্ষে ফিজিক্স অনার্স কোর্সে 1st Year- এর ছাত্র হিসেবে উক্ত বিদ্যামন্দিরে ভর্তি হই। কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স এবং আরো কিছু নামী কলেজের ভর্তি-তালিকায় আমার নামটা উঠলেও কিংবা প্রেসিডেন্সী কলেজে অপেক্ষা-তালিকার সম্ভাবনাময় র্যাঙ্কে নামটা থাকলেও আমার বাবা বেলুড় বিদ্যামন্দিরের প্রতি অধিকতর ভরসা ও আস্থাবশতঃ আমাকে সেখানেই ভর্তি করিয়ে দেন। পশ্চিমবঙ্গে ছাত্রসমাজের মধ্যে সেই সময়কার রাজনৈতিক অস্থিরতাজনিত উদ্বেগ ছিল এই সিদ্ধান্তটির পেছনে অন্যতম একটি কারণ। তাছাড়া সেই সময়টায় বেশ কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বিদ্যামন্দিরের ফলাফল নাকি খুব ভাল হচ্ছিল।
যাই হোক, বিদ্যামন্দিরে ঢুকে আমার মনে হ'ল সত্যিই যেন বিদ্যার এক মন্দিরেই আমার আসা; নিজেদেরকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সমস্ত উপকরণই এখানে পরম যত্ন করে রাখা। অবশ্যি সেই সুযোগটাকে কে কতটুকু কাজে লাগিয়েছি বা লাগাতে পেরেছি সে প্রসঙ্গ স্বতন্ত্র। কলেজটি ছিল বেলুড়মঠ কর্তৃপক্ষেরই পরিচালনাধীন এবং পুরোপুরি 'Residential'। সম্ভবতঃ এখনও তাই আছে। চারটি হোষ্টেলের 'বিনয়ভবন' নামের একটিতে আমি থাকতাম। আমাদের অধ্যক্ষ ছিলেন পূজনীয় স্বামী তেজসানন্দজী মহারাজ। তাঁর স্নেহমিশ্রিত শাসন ছিল আমাদের সবার কাছে এক অন্যতম আকর্ষণ। নিজের সাম্মানিক যৎসামান্য মাসোহারাও তিনি ছাত্রদের চিকিৎসার ব্যবস্থায় ব্যয় করতেন এবং নিজের বরাদ্দ বাসস্থানের বড় অংশটাই ছাত্রদের জন্যে 'Health Centre' হিসেবে ছেড়ে দিয়েছিলেন।
বিদ্যামন্দিরে যারা পড়াতেন তাদের অনেক বেশী করে 'শিক্ষক' বলেই মনে হ'ত- আজকের মতো যেকোন বিষয় নিয়ে TV চ্যানেলের ডাক পেয়েই হুট করে একপেশে চিন্তা নিয়ে পর্দায় বসে যাওয়া সবজান্তা 'অধ্যাপক'-দের মতো লাগত না। সেইসব শ্রদ্ধাস্পদ শিক্ষকদের আভিজাত্য বাইরে তাদের পোষাকের চাকচিক্যে বা জ্ঞানীসুলভ হাবভাবে নয়- বরং ক্লাশে তাদের বিদ্যাদানভঙ্গীর চমৎকারিত্বে ফুটে উঠত। কলেজটা কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন হ'লেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের বাইরে সপ্তাহে একদিন সেখানে 'Religious Class' ও নেয়া হ'ত। অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ মহারাজ (স্বামী প্রভানন্দজী) নিজেরাই সেই ক্লাশ নিতেন। কি অপূর্বই না লাগত সুর করে উপনিষদের সেই শ্লোকশিক্ষাদান! এই উপাধ্যক্ষ মহারাজই আবার আমাদের ম্যাথ্স ক্লাশও নিতেন। সেখানে তিনি যেন আরেক মানুষ !
ভোর সাড়ে চারটায় ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার সাদা ধুতি ও জামা গায়ে প্রার্থনায় যোগ দেয়া ছিল বাধ্যতামূলক। ঘুম ভাঙানোর জন্যে বারান্দায় ঘুরে ঘুরে ঘন্টা বাজানো হ'ত। প্রার্থনার পর যার যার রুম সাফাইয়ের কাজ সেরে একটু দূরে খাওয়ার হলঘরে গিয়ে টিফিন খাওয়া, তারপর ফিরে এসে 'Study hour'। পরবর্তীতে পরপর বাজা ঘন্টা অনুসরণ করে সাড়ে আটটায় স্নানের, নয়টায় লাঞ্চের পর্ব সেরে পৌণে দশটায় অনার্স ক্লাশ ধরতে কলেজের উদ্দেশ্যে ছোটা। চারটায় কলেজ ছুটীর পর হোষ্টেলে ফিরে এসে টিফিন পর্ব সেরে অল্প খেলাধূলা ছিল অবশ্য-করণীয়। ছ'টায় সান্ধ্য প্রার্থনা সেরে আবার 'Study hour'। সাড়ে আটটায় রাতের খাওয়ার ঘন্টা বাজতেই আবার থালা হাতে দে ছুট্ ! ন'টায় রুমে ফিরে এসে ফের 'Study hour'। পৌণে দশটায় ক্ষণিকের আলো নেভার সঙ্কেতের পরেই ঘুমের প্রস্তুতি শুরু, আর দশটায় আলোর একবারেই নিভে যাওয়া। সেই সময়টায় কাউকে নিজের বিছানা ছাড়া অন্যত্র দেখা গেলে শাস্তি ছিল স্থির নিশ্চিত। বিষয়টা প্রিন্সিপাল মহারাজের বিচারসভা অব্দি গড়ালে তো আর রক্ষে নেই !
তখন সারা দেশে চাউলের ভীষণ সংকট। গমের যোগানও মার্কিন প্রশাসনের সাথে PL 480 চুক্তিতে আমদানী-নির্ভর। আমাদের জন্যে দিনের খাওয়ায় মাপা ছোট এক বাটি-পরিমাণ ভাত ও প্রয়োজনমতো রুটি বরাদ্দ ছিল। রাতে শুধুই রুটি। শুধু প্রতি মাসের শেষ তারিখে রাতে পেট ভরে ভাত মিলত। আমার মতো ভেতো বাঙালীদের- বিশেষতঃ গ্রাম থেকে আসা ছেলেদের পক্ষে এই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে প্রথমদিকটায় খুব কষ্ট হয়েছিল। সবাই মাসের শেষ তারিখটার জন্যে চাতক পাখীর মতো মুখিয়ে থাকতাম- পেট পুরে ভাত খাবার অপেক্ষায়।
প্রিন্সিপাল মহারাজের বিচারসভার কথা হচ্ছিল। একবার কিন্তু খোদ আমাকেই সেই বিচারসভায় আসামী হয়ে হাজির থাকতে হয়েছিল, যদিও সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা কারণে। একদিন কলেজে একটা ক্লাশে অনুপস্থিত ছিলাম; আর সেই রিপোর্টটা সেদিনই উনি অব্দি চলে গিয়েছিল। সন্ধ্যের পর আমাকে ডাকিয়ে মহারাজ কারণ জানতে চাইলে আমি কাচুমাচু হয়ে বললাম, "দুপুরে গঙ্গায় বান্ দেখতে গিয়েছিলাম মহারাজ; আমাদের আগরতলা শহরে তো বড় কোন নদী নেই, তাই। মহারাজ অবাক হয়ে বললেন, "সেকি? অনুমতি নেয়ার দরকারটুকুও মনে করলি নে?" আমি জানালাম- "বন্ধুরা সবাই বলল অনুমতি চাইলে যে তা পাব না সেটা নিশ্চিত; তাই যদি বান্ দেখতেই হয় এমনিতেই দেখে আসতে হবে- পরে মহারাজ ডেকে নাহয় একটু বকবেন; কিন্তু বান্ তো আর রোজ আসবে না"। শুনে মহারাজ হাসবেন না কাঁদবেন ঠিক স্থির করতে পারলেন না। মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য এনে বললেন, "ব্যাটা যদি ডুবে যেতিস কি হ'ত? সাঁতার জানিস্ না তো! আমি তোর বাবা-মাকে কি জবাব দিতুম?" আমি দারুণ উৎসাহে বলে উঠলাম, "সাঁতার জানি তো মহারাজ- সেই ছোটবেলা থেকেই আগরতলায় বড় দীঘিতে এপার ওপার সাঁতরে স্নান করে অভ্যেস"।
"তাই নাকি, সত্যি বলছিস? এখানকার শহুরে ছেলেগুলো তো জলে নামতেই ভয় পায়" (মহারাজের মুখে মৃদু খুশীর ঝিলিক)। আমার প্রত্যয়ী চেহারা দেখেই উনি ঠিক ধরতে পেরেছেন আমি মিথ্যে কথা বলছি না। হাতের লাঠিটা আস্তে করে আমার মাথায় ঠুকে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললেন, "এবার ছেড়ে দিলুম, তবে আবার এমনটি হ'লে আস্ত রাখব না এও বলে দিলুম। যা, মাথা থেকে বান্ দেখার ভূত ছাড়িয়ে মন দিয়ে লেখাপড়া করগে যা"।
মাঝে মাঝে রুটিনবাঁধা জীবনের বাইরে ছাত্রদের মধ্যে কিছু 'অনিয়ম' করবারও খুব ইচ্ছে হ'ত- যেমন দল বেঁধে সিনেমাহলে গিয়ে 'হিন্দী কোন হিট' ছবি দেখা। অনুমতি আদায়ে মিথ্যে বলা ছাড়া উপায় ছিল না। বানিয়ে কোন ঠাকুর-দেবতার ছবির নাম বলতে হ'ত- অমুক সিনেমাহলে 'হরিশ্চন্দ্র' বা 'সম্পূর্ণ রামায়ণ' অথবা 'পাগল ঠাকুর' চলছে, আমরা দেখতে যাচ্ছি- অনুমতি চাই। সরল বিশ্বাসে অনুমতি মিলেও যেত; শুধু হোষ্টেলে রাখা মোটা মুভমেন্ট-রেজিষ্টারটায় সেই অনুযায়ী এন্ট্রি করে যাওয়া চাই। ভাগ্যিস তত মিলিয়ে ফিলিয়ে কেউই দেখত-টেখত না। আমরা শুধু সতর্ক থাকতাম অন্ততঃ যেন ঐ নামে একটা হলের অস্তিত্ব সত্যিই থাকে।
কৈশোরের ঐসব স্বাভাবিক কিছু চপলতা বাদ দিলে বিদ্যামন্দিরে জীবনটা গঠনমূলকভাবেই কাটছিল। বিজ্ঞানের সাথে আধ্যাত্মিক শিক্ষার সমন্বয়ে ক্রমে বেড়ে উঠছিল আমাদের ভেতরের মানুষগুলি। সন্ন্যাসী-অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে সবার মধ্যে গড়ে উঠছিল সহজ সরল বন্ধুত্বের বন্ধন- যার ভিত্তি যতটা না ধর্মীয়, তার চাইতে অনেক বেশী মানবিক আত্মীয়তার বোধ-প্রসূত।
কিন্তু এক বছরের মধ্যেই রাজ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতা সাময়িকভাবে বিদ্যামন্দিরেও এক অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ভেতরে কারা যেন তলে তলে বিদ্রোহ আর প্রতিবাদের আবহাওয়া সৃষ্টি করতে চেষ্টা করে। সেসবের ন্যায্যতা বা অন্যায্যতা কিছু বোঝার আগেই 1968- র এপ্রিল মাস নাগাদ কর্তৃপক্ষ গ্রীষ্মের ছুটী কিছুটা এগিয়ে এনে আমাদেরকে বাড়ী পাঠিয়ে দেন- ছাত্রদেরকে সেই অস্থির অবস্থার ছোঁয়ার বাইরে রাখতে। সেই অস্থিরতা কতদিনে মিটবে তা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছিল না। দীর্ঘ চারমাস অব্দিও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় 1967- র ডিসেম্বর মাসে নেয়া 'Half Yearly Exam'- এর ভিত্তিতে 1968-র আগষ্টে নতুন ব্যাচের সবাইকে 2nd year-এ Promotion দিয়ে দেয়া হয়। সেই সাথে অভিভাবকদের বলা হয় ইচ্ছে করলে তারা কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অন্য কোন ভাল কলেজে ছাত্রদেরকে 2nd year-এ ভর্তি করিয়ে নিতে পারেন যাতে শিক্ষাবর্ষের কোন ক্ষতি না হয়। বিদ্যামন্দির কর্তৃপক্ষ এবিষয়ে সবরকমের সহযোগিতারও আশ্বাস দেন। আমার বাবা আর কোন ঝুঁকি না নিয়ে আমাকেও নিজ শহর আগরতলার সুবিখ্যাত মহারাজা বীরবিক্রম কলেজে 2nd year-এ ভর্তি করিয়ে দিলেন। কাজটা অবশ্যি খুব কম ঝক্কির ছিল না। আমাকে 'adjust' করে একেক দিন একেক গ্রুপের সাথে অনার্সের 'Practical' ক্লাশ করতে হ'ত।
সমস্ত ঘটনাটায় স্নাতক হবার পরীক্ষার ফলাফলে খুবই প্রতিকূল প্রভাব পড়েছিল। যাই হোক, এ'সংক্রান্ত ব্যক্তিগত লাভক্ষতির বিশ্লেষণে না গিয়ে আমি মন উজাড় করে দিয়ে শুধু জানাতে চাই- বিদ্যামন্দিরের কত না মধুর স্মৃতি এখনো আমার সত্তাকে ভীষণভাবে জড়িয়ে আছে ! প্রিয় বিদ্যামন্দিরকে এখনো 'মিস' তো করিই- সেই সাথে জড়িয়ে আছে বন্ধুবিরহের আরো একটি বিষাদের অধ্যায়। হঠাৎ করে সেখানকার বন্ধুদের সাথে এমনভাবে দূরত্ব তৈরী হয়ে যাবার কোন আগাম ধারণা না থাকায় এবং সেই সময়ে সরাসরি যোগাযোগের মোবাইল-ফোন জাতীয় কিছু ছিল না বলে ঘটনার ঝটকা-আবর্তে সেই বন্ধুরা সবাই যেন সবার থেকে আচমকা হারিয়ে গেল।
সবশেষে বলব, "হে আমার বিদ্যালয়োত্তর জীবনের প্রথম শিক্ষা নিকেতন! আমার গভীর ভালবাসার আমার একান্ত শ্রদ্ধার বিদ্যামন্দির! তোমার বর্তমান সাফল্যে আমি আপ্লুত; তুমি আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণতি গ্রহণ করো"।
0 মন্তব্যসমূহ