ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

খাদ - পুষ্পার্ঘ্য দাস

 


মেন রোড থেকে প্রায় এক কিমি জুড়ে তিন তিনটে গলি পেরোলেই দারুণ একটা খোলা জায়গায় পৌঁছে যাওয়া যায়। সেখানে যেদিকে দু’চোখ যায় শুধুই সবুজ ধানের ক্ষেত। আর ওই ধানক্ষেতের মাঝে একটাই মাত্র একতলা বাড়ি দাঁড়িয়ে। সে বাড়ির রংও সবুজ। মনে হয় যেন রংয়ের বাক্সে শুধু সবুজ রং ছাড়া বাকি সব রং ফুরিয়ে গেছিল। এই গলির মধ্যে দিয়ে আসার সময় কারও বোঝার সাধ্যি নেই যে গলির শেষে রয়েছে এমন সবুজ স্বর্গ। আমিও জানতাম না। প্রথমবার জায়গাটার কথা শুনি তাপসের কাছে। তাপস আমার বন্ধু কাম ব্যাঙ্কের সহকর্মী। ও নাকি গলির মধ্যে কোন এক বন্ধুর বাড়ি আসার সময় ভুল করে চলে এসেছিল এখানে। তারপর এই বাড়ির সামনে দ্যাখে বোর্ড টাঙানো – ‘এখানে ঘর ভাড়ায় পাওয়া যায়’ আর তার নীচে মোবাইল নাম্বার লেখা। প্রোমোশনটা হওয়ার পর আমারও আর ওই ঘিঞ্জি মেসে থাকা পোষাচ্ছিল না। নোংরা বাথরুম, চিৎকার চেঁচামেচি, বাওয়াল এসব ছেড়ে মন একটু শান্তি খুঁজছিল। তাপস এমন একটা খালি বাড়ির হদিশ দেওয়ার পর আর একটুও সময় নষ্ট করিনি।

বোর্ডে লেখা ফোন নাম্বারে ফোন করে ঠিক করলাম পরের দিন দেখতে আসব। ফোন নাম্বারটি ছিল মালিকের শ্যালকের। মালিক বাইরে থাকেন। শ্যালকের ওপরেই যত দায়িত্ব। তো সেই শ্যালক পলাশবাবু হাসিমুখে দেখালেন সবকিছু। দুটো ঘর। প্রতিটিতেই অ্যাটাচড বাথরুম আর কিচেন। দুটো ছোটো ফ্যামিলি আরামসে থাকতে পারে। আমার একার জন্য তো পারফেক্ট। রান্নাও আমি নিজেই করি, তাই সেদিকেও অসুবিধে নেই। ভাড়াও যৎসামান্য। এত ভেতরে বলে কেউ নাকি আসতেই চায় না। ভালোই হল, মেসের ভাড়াতেই পেয়ে গেলাম। কিছু অ্যাডভান্স দিয়ে দুটো ঘরের মধ্যে একটা আমি নিজের জন্য বন্দোবস্ত করে নিলাম। সেও প্রায় মাস ছয়েক আগের কথা।

আজ সব কাজকর্ম মিটিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে বেরোতে বেরোতে আটটা বেজে গেল। অটো থেকে নেমে গলির মুখে যখন ঢুকছি, তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটা পেরিয়ে গেছে। অটোর ভাড়া মিটিয়ে একটা বিশাল হাই তুলতে তুলতে গলির ভেতর ঢুকলাম। আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে ছুটকোছাটকা আলো এসে গলিটাকে আলো-আঁধারি করে তুলেছে। একটু হাঁটার পর চোখে সয়ে এল অন্ধকার। এখন সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। শেষ গলিটায় ঢুকতে যাব, এমন সময় সামনের দিকে তাকিয়ে বুকটা ছাঁৎ করে উঠল। থমকে দাঁড়ালাম। দেখি, মাটির কাছাকাছি দুটো সবুজ আলো জ্বলছে। কয়েক মুহূর্ত পরেই আলোজোড়া একলাফে পাঁচিলে। পাশের বাড়ির জানালা দিয়ে আলো এসে পড়ল তার গায়ে, কুচকুচে কালো একটা বিড়াল। উফফ, হঠাৎ করে দেখে কিছুক্ষণের জন্য সত্যিই ভয় পেয়ে গেছিলাম। হাঁফ ছেড়ে চলতে শুরু করলাম আবার।

 শেষ গলিটা পেরিয়ে ফাঁকা জায়গায় বেরোতেই দেখতে পেলাম, আমার আস্তানায় একটা আলো দেখা যাচ্ছে। কী ব্যাপার? পা চালিয়ে বাড়ির সামনে এসে দেখি, বাইরে পলাশবাবুর বাইকটা দাঁড় করানো। দূর থেকেই দেখতে পেলাম আমার পাশের ঘরটা খোলা। ওটাতেই আলো জ্বলছে। দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখা হয়ে গেল পলাশবাবুর সাথে। হেসে বললেন, “আরে বিনোদবাবু, কেমন আছেন বলুন।”
“এই তো ভালোই। আপনি কেমন আছেন?”, আমিও হেসে জিজ্ঞেস করলাম।
“আমারও ওই একই, ভালোই। এই নিঝুম পুরীতে এবার আপনার সঙ্গী হবে মশাই”, বলে ঘরের ভেতরের দিকে মুখ করে হাঁক দিলেন, “আলোকবাবু… ও আলোকবাবু…”
ডাক শুনে চশমা চোখে একজন গৌরবর্ণ, সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। বয়সে আমার থেকে পাঁচ-ছয় বছর বড়ই হবেন। এত মসৃণভাবে কাটা দাড়ি যেন গালে মাছি বসলে পিছলে যাবে। দেখলেই মনে হয়, সফিস্টিকেটেড ভদ্রলোকের জলজ্যান্ত উদাহরণ সামনে দাঁড়িয়ে। পলাশবাবু আলাপ করিয়ে দিলেন, “এই যে ইনি আলোকবাবু। আর ইনি হলেন বিনোদবাবু, পাশের ঘরে থাকেন।”
আমি হাসিমুখে নমস্কার জানালাম। আলোকবাবুও প্রত্যুত্তরে হাসিমুখে নমস্কার জানালেন। কিন্তু সেই হাসিমুখ আমি দেখতে পেলাম না। কারণ ততক্ষণে আমার চোখ চলে গেছে আলোকবাবুর পেছনে। সেখানে দরজার চৌকাঠে আরেকজন এসে দাঁড়িয়েছে। শাড়ি পরিহিতা, ফরসা, তন্বী এক মহিলা। চোখদুটো সমুদ্রের মতন গভীর। কিন্তু কেমন যেন বিষাদ মাখা। নীচের পুরু গোলাপী ঠোঁটে সর্বনাশের অমোঘ হাতছানি। নাক আর ঠোঁটের মাঝে বিন্দু বিন্দু জমা ঘাম। কিছু অবাধ্য চুল বারবার চোখেমুখে এসে পড়ছে। শাড়ির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে উপত্যকা। এমন সেই উপত্যকা, যার খাঁজে সময়ও পথ হারাবে। এত আকর্ষণীয়া কাউকে আমি খুব কমই দেখেছি। আটকে গেছিলাম। চটক ভাঙল আলোকবাবুর কথায়, “এই যে আমার স্ত্রী শ্রীলেখা।”
শুনেছি, কালো বেড়াল রাস্তা কাটলে নাকি অমঙ্গল হয়। তা সেই অমঙ্গলের নমুনা যদি এরকম হয়, তাহলে আমি চাই এমন অমঙ্গল রোজ হোক আমার সাথে।


শ্রীলেখাকে দেখার পর থেকেই আমার জীবনের পাতায় আঁকাবাঁকা দুর্বোধ্য কিছু অক্ষর লেখা হয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে যেন ঘেঁটে গেছি পুরো। কেউ যেন আমার শান্ত দীঘিতে সুনামির ঢেউ তুলেছে। এমনিতে আমি মেয়েদের সামনে এলেই ক্যাবলা হয়ে যাই, তাই পারতপক্ষে মেয়েদের ধারেকাছে ঘেঁষি না। কিন্তু শ্রীলেখার শরীরের প্রতিটি বাঁক যেন চুম্বকের মত টানছে আমায়। ঘুমোলে স্বপ্নজুড়ে তার অবাধ বিচরণ, এমনকি জেগে থাকলেও সর্বক্ষণ চোখের সামনে ভেসে উঠছে ওই হিল্লোলিত শরীর। ঘরের দরজা সবসময় খোলা রেখেছি। সে বেরোলেই যেন দেখতে পাই। ব্যাঙ্কে গিয়ে কাস্টমারের নাম শ্রীতমাকে পড়ছি শ্রীলেখা। পাগল-পাগল অবস্থা।

আলোকবাবু খুব ভোরে বেরিয়ে যান, আসেন রাত করে। ওঁর অফিস যেতে নাকি এখান থেকে আড়াই-তিন ঘন্টা লাগে। কীসের অফিস অবশ্য জানিনা। কৌতূহলও দেখাইনি বিশেষ। কিন্তু যত রাতেই আসুন না কেন, প্রতি রাতেই আমি শুনতে পাই উদ্দাম শারীরিক সম্পর্কের আওয়াজ। দেওয়ালগুলো খুব মোটা নয়। প্রথম প্রথম চাপা আওয়াজ পেতাম, খাটের নড়াচড়ার, শীৎকারের। মাঝে মাঝে মনে হত, দুটো প্রাণী যেন ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে। আওয়াজটাও কেমন যেন গোঙানির মত শোনাত। কোনটা সত্যি? শীৎকার না গোঙানি? কনফিউজড হয়ে যাই। ধীরে ধীরে আমারও নেশা লেগে গেল। ফাঁকা গ্লাস দেওয়ালে চেপে ধরে কান চেপে ধরতাম গ্লাসে। অনেক স্পষ্ট শোনা যেত। শুধু শারীরিক মিলনের শব্দ নয়। এখন ওদের কথাবার্তা শোনাটাও নেশার মত হয়ে যাচ্ছে। রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে রেডি হয়ে যাই। আলোকবাবু ঢুকলেই গ্লাস চেপে ধরি দেওয়ালে। যদিও খুব বেশি কথা যে ওদের মধ্যে হয়, তেমন নয়। নিতান্তই কাঠ কাঠ কেজো কয়েকটা কথা। খাওয়ার টেবিলে শ্রীলেখা কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেও আলোকবাবুর মধ্যে কথা বলার তেমন কোনো আগ্রহ দেখি না। আমি ভাবি, এত সুন্দরী বউয়ের সাথে লোকে এত নীরস হয়ে থাকে কি করে? যত দাপট শুধু বিছানায়! ওঁর আবার মনে হয় নিয়মিত মদ্যপানেরও অভ্যেস আছে। একদিন রাতে মুখোমুখি হয়ে যেতেই দেখি মুখ থেকে ভকভক করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। রুমাল দিয়ে মুখ আড়াল করার চেষ্টা করেও শেষরক্ষা হয়নি। সে যাকগে। আমি শুধু অপেক্ষা করি, গভীর রাতে নিস্তব্ধ চরাচরের মধ্যে শ্রীলেখার শীৎকার শোনার। শীৎকার না গোঙানি? যে গোঙানির তালে তালে হস্তমৈথুনের মধ্য দিয়ে দিন শেষ হয় আমার।  
শুনেছি মেয়েরা নাকি অতি সহজেই চোখের ভাষা পড়তে পারে। যে কয়েকবার চোখে চোখ পড়েছে, শ্রীলেখা কি আমার মনের ভেতরের ঝড়টা দেখতে পায়নি? নির্ঘাত পেয়েছে। নাহলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ও বিব্রত হয় কেন? আলোকবাবু সকালে বেরিয়ে যাওয়ার পর জামাকাপড় কেচে শ্রীলেখা যখন ছাদে শুকোতে দিতে চায়, আমিও উঠে পড়ি ছাদে। এদিকওদিক দেখার ফাঁকে ফাঁকে আমার নজর ছুঁয়ে যায় শ্রীলেখার ঠোঁট, ঘাড়, স্তন, পিঠ, কোমর, নিতম্ব। আড়চোখে দেখেই বুঝে যায় সে। আরও বেশি করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে শাড়ী। আমি লোভী কুকুরের মত হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। পাশ দিয়ে নেমে যাওয়ার সময় শ্রীলেখার চোখে দেখি এক অন্যরকম ভয়। সেই কতদিন আগে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কথা পড়েছিলাম। আমার জাহাজটাও কি হারিয়ে যাবে চিরদিনের মত?


দিনকয়েক পরে প্রতিদিনের মতই আলোকবাবু বাড়ি ফেরার পর আমি ফাঁকা গ্লাস নিয়ে দেওয়ালে কান পেতেছি। খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত তেমন কোনো কথাই হয়নি। শুতে যাওয়ার ঠিক আগে শ্রীলেখার গলা শুনতে পেলাম, “আজকের রাতটা একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে গো? স্পন্ডেলাইটিসের যন্ত্রণাটা খুব বেড়েছে। কাঁধ থেকে পুরো শিরদাঁড়া জুড়ে অসহ্য যন্ত্রণা। একটা ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারলে একটু কম সইতে হত।”

কথা শেষ হতে না হতেই চিৎকার করে উঠল আলোক, “আমার সাথে শোয়ার সময় এলেই শুধু বাহানা, তাই না? আজ মাথার যন্ত্রণা, কাল পেটের যন্ত্রণা… কেন রে? নতুন নাগর জুটিয়েছিস নাকি? দিনেই খিদে মিটিয়ে নিচ্ছিস? তাই রাতে আর আমার দরকার পড়ছে না?”

আলোকবাবুর মুখের ভাষা শুনে আমি তো অবাক। যে মানুষটাকে বাইরে থেকে একেবারে ধোপদুরস্ত মনে হয়, সেই লোকটাই ভেতরে ভেতরে এরকম? ওকে ‘বাবু’ আর ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে মনে হল।

নীচুস্বরে বলল শ্রীলেখা, “কী করে এত খারাপ খারাপ কথাগুলো বলো গো তুমি? কোনোদিন কি তোমাকে বারণ করি? শুধু যে দিনগুলোয় খুব যন্ত্রণা হয়…”

“ওসব অজুহাত অন্য কারো কাছে দিস রে ছেনালি। কিচ্ছু শুনতে চাই না আমি। তোর শরীরটা আমার চাই তো চাই। তাড়াতাড়ি চলে আয় বিছানায়।”

এরপর কিছুক্ষণ আর কোনো কথা শুনতে পেলাম না। অবশ্য শোনার আর কীই বা বাকি ছিল? গ্লাসটা নামিয়ে নিলাম দেওয়াল থেকে। ধর্ষণের আওয়াজ শোনার প্রবৃত্তি হল না।

পরেরদিন সকালে অবশ্য ভুলে গেলাম রাতের কথা। একটাই কথা মনে হল, যার ছাগল সে বুঝবে কোনদিকে কাটবে! বেশি ভেতরে ঢুকে কী লাভ? আমার চোখের সুখ হলেই হল। কিন্তু আমাকে দেখলেই তো গুটিয়ে যায় শ্রীলেখা। শাড়ি সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চোখেমুখে কুণ্ঠা, অস্বস্তি দেখতে পাই ওর। তাহলে আমিও কি একরকম ধর্ষণই করছি? চোখ দিয়ে?

ধুস! দেখাটা আবার কোনো পাপ নাকি? নিজেকে প্রবোধ দিই আমি। আজ সকালে কিন্তু ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হল। কাচা কাপড় মেলার জন্য শ্রীলেখা ছাদে উঠে গেলে আমিও যাই পেছন পেছন। আজ দেখলাম শাড়িটা একটু তুলে পরা। ফর্সা, মোলায়েম পা দুটোর মাঝে মাঝে গোলাপী আভা। বুকের কাছেও কাপড়টা কি একটু সরানো? স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে গভীর বিভাজিকা। ইচ্ছে করছে ওখানে মুখ ডুবিয়ে দিতে। বুক থেকে ওপরে মুখ ওঠাতেই দেখি শ্রীলেখা সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে ‘ধরে ফেলেছি’র হাসি। আজ আমিই অপ্রস্তুত হয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিলাম। নীচে নেমে যাওয়ার সময় যে চোরা চাউনি দিয়ে গেল শ্রীলেখা তাতে অনেকটা প্রশ্রয় মাখা ছিল। তাহলে কি এবার…?

সেই থেকে আমি যেন ঘোরের মধ্যে আছি। কাজেকর্মে মন নেই। ভুলভাল করে ফেলছি বারবার। ম্যানেজারের কাছে ঝাড় খাওয়াটা রোজের রুটিনে পরিণত হয়েছে। আমি শুধু একটা জিনিসের জন্যই মুখিয়ে থাকি - কখন বাড়ি ফিরব। কারণ বাড়ি ফিরলেই এখন দেখি শ্রীলেখা দাঁড়িয়ে আছে ওর ঘরের চৌকাঠে। মুখে ভুবনমোহিনী হাসি। আমার কেমন যেন মনে হয়, বুকের কাছে শাড়িটা ইচ্ছে করেই অনেকটা সরিয়ে রাখে। দুই পর্বতের মাঝে যেন হাতছানি দেয় নদী। ঘরের চাবি খোলার সময় হাত কেঁপে যায়। তিন-চারবারের চেষ্টায় খুলতে পারি।

কয়েকদিন থেকে আলোক রাতে বাড়ি ফিরেই অশান্তি শুরু করছে। মদ খেয়ে এসে হাতও তোলে বউয়ের গায়ে। ঘরটাকে একেবারে বস্তি বানিয়ে ফেলেছে। একদিন শ্রীলেখার চোখের নীচে কালশিটে দেখে আর চুপ থাকতে পারলাম না, “একটা কথা বলব? মুখ বুজে এত অত্যাচার সহ্য করলে অত্যাচারীর সাহস কিন্তু বেড়ে যায়।”

শ্রীলেখা কোনো উত্তর দেয়নি। চোখদুটোতে টলটল করছে জল। আমার সামনে থেকে ছুটে চলে গেল। কার জীবনে যে কী জটিলতা আছে কে জানে!

এর কয়েকদিন পর সকালে দেখি আলোক ঘোরাঘুরি করছে ঘরের বাইরেটায়। তার মানে অফিস যায়নি। আজ আর শ্রীলেখার পিছু পিছু ছাদে যাওয়া হল না। সকাল সকাল খিঁচড়ে গেল মেজাজটা।
রাতে ব্যাঙ্কের কাজকর্ম সেরে যখন অফিস থেকে বেরোলাম তখন দেখি ঝড় উঠেছে। চোখেমুখে এসে পড়ছে ধুলোবালি। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে কয়েক সেকেন্ড ছাড়া ছাড়া। অটো থেকে যখন নামলাম, তখন শুরু হয়েছে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। অফিসের ব্যাগটা মাথার ওপর ধরে প্রায় দৌড় লাগালাম।

বাড়িতে ঢোকার সময় দেখি শ্রীলেখার ঘরের দরজা বন্ধ। ধুস! সকালেও দেখতে পেলাম না। আর এখনও নেই। জালি মালটা শালা কেন যে অফিস যায়নি! কারেন্টও নেই। ঘরে ঢুকে মোবাইলের আলো জ্বেলে একটা চিমনি জ্বাললাম। চিমনি অর্থাৎ বাবুইপাখির বাসার মত দেখতে কাচ দিয়ে ঘেরা লন্ঠন। ওপরটা ফাঁকা। ভিজে জামাকাপড় বাথরুমে ছেড়ে, ফ্রেস হয়ে, টিশার্ট আর ট্রাউজার গায়ে চাপিয়ে একটু শুয়ে পড়লাম বিছানায়। আহ! সারাদিনের পর এই তো একটু শান্তি।

বাইরে বৃষ্টির জন্য বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আজ রাতে ঘুমটা দারুণ হবে। একটু খিচুড়ি করলে মন্দ হয় না। ইলিশ মাছ থাকলে জমে যেত। যাইহোক, এখন ডিমভাজা দিয়েই কাজ চালিয়ে নেব। এইসব ভাবতে ভাবতে ঠান্ডা হাওয়ায় কখন যে একটু চোখ লেগে গেছে! হঠাৎ শুনি দরজায় খটখট! ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লাম। এখানে তো কেউ আসে না। তাও আবার এই দুর্যোগের রাতে? পাশের ঘরে কিছু হল নাকি?

তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজার ছিটকিনিটা খুললাম। দরজার বাইরে শ্রীলেখা দাঁড়িয়ে। দুহাতে একটা চিমনি ধরা। মুখে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি। কিন্তু তাকে উপেক্ষা করে আমার নজর চলে গেল ওর বুকের দিকে। কারণ শ্রীলেখা ব্লাউজ পরেনি। গায়ে জড়ানো শাড়িটা থেকে বুকদুটো যেন ফেটে বেরোতে চাইছে। উঁচু হয়ে আছে বৃন্তদুটো। চোখ সরাতে পারছিলাম না। কোনোমতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কী ব্যাপার?”

“উফফ! স্পন্ডেলাইটিসের ব্যথাটা খুব বেড়েছে। দু দুটো ব্যথা কমার ওষুধ খেয়েছি। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ও-ও সেই কোন বিকেলে বেরিয়েছে। এই বৃষ্টি বাদলার দিনে কখন ফিরতে পারবে জানি না। আমি নিরুপায় হয়ে আপনার কাছে এসেছি। ট্যাবলেটের থেকেও আমার এই রোগের মূল ওষুধ হল গরম সেঁক। কাঁধে, শিরদাঁড়ায়, পিঠে ভালো করে সেঁক নিলে একটু কমে। অনেকক্ষণ ধরে সহ্য করছি। কিন্তু আর পারছি না। কিছু যদি মনে না করেন, একটু সাহায্য করবেন?”

ওর যন্ত্রণা নিয়ে আমার তেমন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু বৃষ্টির রাত, কারেন্ট নেই, রহস্যময় হলুদ আলো আর সামনে শ্রীলেখার খোলা পিঠ। উফফ, ভেবেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। তড়িঘড়ি বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই।”

শ্রীলেখার পেছনে পেছনে আমি ওর ঘরে ঢুকলাম। আমি ঢুকে যাওয়ার পর ও দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। সাইডে রাখল চিমনিটা। ঘরের এক কোণে দেওয়ালের ধারে একটা টেবিলের ওপর হ্যারিকেন রাখা। তার পাশেই একটা ভাঁজ করা কাপড়। শ্রীলেখা সেদিকে এগিয়ে গেল। ওর পেছন পেছন আমি। আমার হার্টবিট আমি নিজেই শুনতে পাচ্ছি।

চিমনির আর হ্যারিকেনের আলো ঘরের কোণ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। ইতিউতি অন্ধকার। ভাঁজ করা কাপড়টা শ্রীলেখা হ্যারিকেনের মাথায় রাখল। একটু পরে গরম হয়ে যেতে কাপড়টা ধরিয়ে দিল আমায়। তারপর পিঠের কাছ থেকে সরিয়ে নিল শাড়ি। চোখ পুড়ে যাচ্ছে আমার। ফর্সা পিঠে অনেকগুলো লাল তিল। হাত কাঁপছে। মনে হচ্ছে হাত থেকে কাপড়টা পড়ে না যায়। ধীরে ধীরে পিঠের উপর কাপড়টা রাখলাম। আমার বুড়ো আঙুলও স্পর্শ করল ওর পিঠ। কী নিদারুণ উত্তাপ সেখানে। সে আগুনে মোমের মত গলে যাচ্ছিল আমার হাত। ইচ্ছে করছিল পেছন থেকে জাপটে ধরি ওকে।
“আরেকটু বাম দিকে”, বলে শ্রীলেখা নিজের ডান হাতটা বুকের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে পেছনে আমার হাতটা ধরল। তারপর ওর হাত ধরে আমার হাত পৌঁছাল বিপদসীমার খুব কাছাকাছি। সুখের আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল।

“দাঁড়ান এক মিনিট, আসছি”, শ্রীলেখার কথায় ছেদ পড়ল আমার স্বর্গারোহণে। শ্রীলেখার চোখে কেমন যেন বিজয়ীর তৃপ্তি। সেই চিরাচরিত বিষাদ, আতঙ্ক ছিল না কোথাও। ঘাড় কাত করে সায় দিলাম। দেওয়ালের দিকে মুখ করে অপেক্ষা করছি কখন শ্রীলেখা আসে। হঠাৎ মাথার পেছনে খুব জোরে ভারী কিছুর আঘাত পেলাম। এক লহমায় চারিদিক অন্ধকার।


চোখ যখন খুললাম, দেখি একটা হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। বেডের পাশে একজন পুলিশ অফিসার চেয়ারে বসে কিছু একটা কাগজ উল্টে পাল্টে দেখছেন। আমি ধীরে ধীরে উঠে বসতে চাইলাম। সচকিত হয়ে গেলেন অফিসারটি।
“ও আপনি উঠে পড়েছেন”, বলে আমাকে সাহায্য করলেন পিঠে বালিশ দিয়ে বসতে।
“উফফ! খুব যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়। আমি এখানে, এভাবে…?”, এই ক’টা কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে দারুণ।
অফিসারটির মুখে রহস্যজনক হাসি। বললেন, “ভালোই তো ছিলেন বেশ। ব্যাঙ্কে চাকরি, সমাজে সম্মান ছিল একটা। কেন খামোখা মেয়ের চক্করে পড়তে গেলেন বলুন তো?”
আমার মাথা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছিল। মনে পড়ে গেল সব কথা।
“শ্রীলেখা কোথায়? ও ঠিক আছে তো?”, উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলাম আমি।
ভ্রু দুটো কপালে তুলে অফিসার বললেন, “বাব্বাহ! পারেনও বটে অভিনয় করতে। যাকে ধর্ষণ করতে গেলেন, এমনভাবে তার খোঁজ নিচ্ছেন যে আপনি সত্যিই উদ্বিগ্ন।”
“মানে?”, চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
“আস্তে… আস্তে… এটা হসপিটাল। আপনার এগেইনস্টে মার্ডার আর অ্যাটেম্পটেড রেপের এফআইআর করা হয়েছে।”
“কী?”
“উফফ! ন্যাকা ষষ্ঠী একেবারে! শুনুন তাহলে! শ্রীলেখাদেবীকে একা পেয়ে রাতের অন্ধকারে দেশলাই চাওয়ার ছুতোয় তার ঘরে ঢোকেন। তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। শ্রীলেখাদেবী বাধা দিতে থাকেন, কিন্তু আপনার শক্তির কাছে পেরে ওঠেন না। এমন সময় শ্রীলেখাদেবীর স্বামী আলোকবাবু ফিরে আসেন। আপনাদের দুজনের মধ্যে ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়। আপনি তাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে ছুটে গিয়ে হাতে তুলে নেন দরজার হুড়কো। তারপর সেটা দিয়েই আলোকবাবুর মাথায় সজোরে আঘাত করেন। তৎক্ষণাৎ তিনি মারা যান। বিপদ বুঝে মারামারির সময় শ্রীলেখাদেবীও হাতে তুলে নিয়েছিলেন পাঁচ সেলের একটা টর্চ। তিনি যখন দেখেন, এই নির্জনপুরীতে তাঁকে কেউ বাঁচাতে আসবে না, তখন হাতের ওই টর্চ দিয়েই পেছন থেকে আপনার মাথায় আঘাত করেন। তারপর বৃষ্টির মধ্যেই দৌড়ে দৌড়ে আমাদের থানায় এসে পৌঁছান। কোথাও কোনো অসঙ্গতি খুঁজে পাচ্ছেন কি?”

আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না। আমতা আমতা করে বলতে লাগলাম, “বিশ্বাস করুন… আমি… মানে… শ্রীলেখাই আমাকে ডেকেছিল… ওর স্পন্ডেলাইটিসের ব্যথা… আলোক তো বাড়িতে ছিল না তখন…”
“ওসব গল্প পরে শোনাবেন। এখন থাক।”
ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছিল আমার মাথা। তার মানে আমি ওদের ঘরে ঢোকার আগেই আলোক… তখন হয়ত তার নিষ্প্রাণ শরীরটা রান্নাঘরে পড়ে আছে… অথবা বাথরুমে… শেষবারের মত দেখা শ্রীলেখার চোখদুটো মনে পড়ল। ঘরে, বাইরে ধর্ষণের স্বীকার হতে হতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর, প্রতিআক্রমণে জয়ী হওয়ার নৃশংস চিহ্ন ফুটে উঠেছিল যে চোখে। আমার আবার বারমুডা ট্রায়েঙ্গেলের কথা মনে পড়ে গেল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ