বছর কয়েক আগে জি-বাংলা চ্যানেলে ‘জামাই রাজা’ বলে একটা টিভি
সিরিয়াল চলেছিল। নামটায় ব্যবহৃত ‘জামাই’ শব্দটা আমার কাছে অফিসের বহু আগের কিছু
স্মৃতি বয়ে নিয়ে আসে। আসলে একাত্তরে আগরতলায় এজি আসাম,
মেঘালয় ইত্যাদির নতুন শাখা-অফিসে ঢুকেই আমরা নতুনেরা শিলং থেকে আসা
সিনিয়র দাদাদের মধ্যে এক ‘মহান্’ ব্যক্তিত্বের সন্ধান পেলাম- যাকে ওনার সমসাময়িক
সহকর্মী-বন্ধুরা ‘জামাই’ বলে ডাকত। কারণটা আমাদের ঠিক জানা ছিল না, তবে তার ধুতি-পাঞ্জাবী পরিহিত সদা ফিটফাট ভাবটা এর কারণ হলেও হতে পারে।
আমাদের মধ্যে কিছু পাকা বন্ধু আবার সাহস করে উনাকে ‘জামাইদা’ও ডেকে ফেলত। তবে আমার
কোনদিন সে সাহস বা ইচ্ছে হয় নি।
যাই হোক, সেই মানুষটি ছিলেন মধ্যবয়সী, সুদর্শন, আপাত-নিরীহ গোছের একজন ইউ ডি সি, শ্রী কবীন্দ্র চক্রবর্তী (নাম পরিবর্তিত)। তাকে নিয়ে একাধারে মজার এবং
করুণ বেশ কিছু ঘটনা রয়েছে। তবে লেখার মাধ্যমে তা পেশ করায় কিছু জটিলতা আছে। তবুও
ব্যক্তিবিশেষের নাম পাল্টে আজ সুহৃদ পাঠকবর্গকে অন্তত: একটি ঘটনা জানাবার লোভ দমন
করতে পারছি না।
আপাতদৃষ্টিতে যে কারো চোখেই উক্ত 'জামাই'
নামপ্রাপ্ত মানুষটাকে বাঙালী আভিজাত্যে পূর্ণ বিশেষ একজন ভদ্রলোক
বলেই মনে হবে। আর এমনিতেও ভদ্রলোক তো উনি বটেই; দোষ ছিল শুধু
একটাই। একটা বিশেষ লক্ষ্যে নতুন জয়েন করা ছেলেগুলি ওনার টার্গেট হ’ত। সেটা হ’ল
ওদের কাছে ওনার টাকা ধার চাওয়ার প্রবণতা। ধার করবার কৌশলটাও ছিল তারিফ করার মতো।
প্রথমে যৎসামান্য কিছু টাকা (যেমন দুই থেকে পাঁচ) ধার চেয়ে সেটা পরের দিনই ফিরিয়ে
দেয়া; কিন্তু একটু গ্যাপ দিয়েই আবার নতুন করে হাত পাতা। পরের
বারের ধার চাওয়ার পরিমাণটা তুলনামূলক বেশী হ’ত। তখন সত্তর দশকের প্রথম দিক। একজন
নতুন ইউডিসি (পরবর্তীকালে ‘রি-ডেসিগনেটেড’ হয়ে অডিটর) সর্বসাকুল্যে সাড়ে তিনশ
টাকার মতো বেতন পেত। কেটেকুটে হাতে আসত আরো কম। তাদের কাছেই উনি নির্বিচারে
বিশ-পঁচিশ টাকা ধার চেয়ে বসতেন। এবারের ঘোষিত দরকারটা, মানে
ধার চাওয়ার কারণটাও খুব সংবেদনশীল কিছু একটা হ’ত- যেমন, পরিবারের
কারো সিরিয়াস অসুখে খুব দামী একটা ওষুধ এক্ষুণি সংগ্রহ করতে হবে, কিন্তু এই মুহূর্তে ওনার হাতে যথেষ্ট টাকা নেই- এই জাতীয় কিছু।
প্রথমবার খুবই তাড়াতাড়ি ধার মিটিয়ে ফেলা জামাইদার লোকদেখানো
ভালমানুষির সুবাদে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়বারের নতুন ধারটাও উনি পেয়ে যেতেন।
তারপরেই ধারশোধের ক্ষেত্রে শুরু হ’ত যত টালবাহানা। অন্তত: মাসখানেকের আগে সে টাকা
ফিরে পাওয়া কারো পক্ষে কষ্টকর হতো। ক্রমাগত পিছু লেগে না থাকলে তাও সম্ভব হ’ত না।
পুরোটাই ছিল দাদাদের প্রতি জুনিয়রদের সমীহভাবের সু্যোগ নিয়ে তাদের শোষণ করবার
কৌশলাস্ত্র। অনেকে জুনিয়রসুলভ সংকোচের শিকার হয়ে উনাকে চিরঋণী রেখেই যুদ্ধে ইস্তফা
দিতে বাধ্য হ’ত। ততদিনে উনি নতুন আরেকজনকে টার্গেট করে ফেলতেন।
এইভাবে ধার চাওয়ার পাত্র ঘন ঘন পরিবর্তিত হতে হতে ক্রমে সীমায়িত
হয়ে যাবার কথা ছিল বটে; কিন্তু ঐ সময়টায়ই নতুন নতুন বহু সংখ্যায় স্টাফ
রিক্র্যুট্মেণ্ট ওনার ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছবার প্রক্রিয়াকে বেশ দীর্ঘস্থায়ী হতে
সাহায্য করল। ওনার বিশেষ প্রতিভার ছোঁয়ায় এধরণের ধারের মোট পরিমাণও দিনদিন বেশ
বৃদ্ধি পেতে লাগল।
নতুন অফিসে প্রায় বছর দুয়েক উনি এই উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে বেশ
সফল হচ্ছিলেন। কিন্তু সবকিছুরই তো একটা শেষ থাকে। যারা একটু সিনিয়র হচ্ছিল তাদের
একদিন মনে হ’ল- নিজেরা ঠকেছি, কিন্তু এখনো যারা নতুন
আসছে, তাদেরকে ধারপ্রার্থী জামাইয়ের এই আপাত-নিরীহ পদ্ধতির
শোষণ থেকে বাঁচাতেই হবে। তাই প্ল্যান করে চুপিচুপি আন্কোরা নতুনদের কানে মন্ত্র
দিয়ে দেয়া হ’ল- উনাকে যেন কেউ একটা টাকাও ধার না দেয়। স্বাভাবিকভাবেই ওনার ধার
চাইবার 'বিশেষ' কৌশলটিও ছোটদের কাছে
খোলসা করতেই হ’ল।
তিয়াত্তরের শেষ দিকটায় নাটক বেশ জমে উঠল। একদিকে তৃতীয় বেতন
কমিশনের সুপারিশ লাগু হয়ে সবার বেতন বেশ বেড়ে গিয়েছে। 'জামাই-বাবু' টির প্রতিভাবলে প্রাপ্য ধারের পরিমাণটা সেই
হারে বাড়তেই পারত। অথচ তেমনটা আর সহজে হতে পারছে না। এমন সুবর্ণ সুযোগ বৃথাই চলে
যাচ্ছে। তখনকার বর্ধিত বাজারের হিসেবে প্রথম ধারের পরিমাণটা দশ-বিশ হতেই পারত,
আর দ্বিতীয়টা আগের অনুপাতে অনায়াসেই পঞ্চাশ-একশ হওয়া উচিৎ ছিল।
কিন্তু বাস্তবে এক পয়সাও জুটছিল না। পুরনোদের কাছে যাবার তো সাহসই নেই- নতুনরাও
কেউ প্রথম ধারটাই দিচ্ছে না। একবার প্রথম ধারটা নিয়ে, সুবোধ
সেজে সেটা দ্রুত ফেরত দিয়ে, তবে তো দ্বিতীয়বারের বড় ধারটা
চাইতে হবে। কিন্তু ওনার নিজের ভাষায় "কিছু দুষ্ট বজ্জাত সিনিয়র স্বার্থপরগো
লাইগ্যা" সে গুড়ে প্রায় বালি।
আমরা জুনিয়ররা তখন দূর থেকে প্রতিনিয়ত ওনার গতিবিধি লক্ষ করতাম।
শব্দপ্রয়োগে হয়ত কিছুটা ঘাটতি থেকে গেল। ‘লক্ষ করতাম’ না বলে বোধহয় ‘উপভোগ এবং
বিশ্লেষণ করতাম' বলাটাই অধিকতর সঙ্গত। দেখা গেল- উনি ইদানীং বহু
নতুন ছেলের সাথে বসে নানা বিষয়ে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করছেন, কিন্তু
কারো কাছেই ধার চাইছেন না। প্রথমে আমাদের মনে হ’ল নতুন ছেলেদেরকে কানমন্ত্র দেয়ার
পরের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়ত ওনার মধ্যে একধরণের বৈরাগ্য এনে দিয়েছে। কিন্তু
ক’দিন পরে বুঝলাম ধার না চেয়ে কায়দা পাল্টে নতুন ছেলেদের সাথে ঘনিষ্ট হয়ে
মন:স্তাত্বিক বিশ্লেষণ করে উনি বুঝতে চাইছেন কার মনটা কিছুটা হলেও নরম। সেই
লক্ষ্যে উনি মানবিকতার কত যে গল্প-সম্ভার নিয়ে প্রতিদিন ওদের কাছে জনে জনে উপস্থিত
হচ্ছেন ! মানতে হবে, মানুষটার এলেম ছিল। রামায়ণ-মহাভারত,
বিবিধ-দর্শন, পুরাণের নানা কাহিনীর উপর ছিল
অগাধ জ্ঞান! সেইসব নীতিকথার ফুলঝুরির আড়ালে ওনার অন্তর্লোকে ধার চাইবার গুপ্ত
বাসনার খবর উনি না চাইলে আগে থেকে কেউ এতটুকুও টের পেত না।
একদিন হ’ল কি, নতুন একটি নিরীহগোছের
ছেলের সাথে নানা কথা বলে ভাল ভাল ‘রেসপন্স্’ পেয়ে ওনার কেন যেন মনে হল এই কোমলমতি
ছেলেটিকে কায়দামতো ধরতে পারলে কিছু মোটা দাঁও মারা যাবেই। আর যেহেতু দীর্ঘদিনের
উপোসী বাঘ এতদিন পরে একটা হরিণশিশু বাগে পেয়েছে, তার চাহিদার
মাত্রাটা প্রচণ্ড বেশী হয়ে গেল। প্রথমবারেই উনি ওনার ছেলের পড়াশুনার ব্যাপারে কি
একটা প্রয়োজন দেখিয়ে পঞ্চাশ টাকা ধার চেয়ে বসলেন। এতক্ষণ স্রেফ গল্পে মশগুল কমবয়সী
ছেলেটির সম্বিৎ এবার ফিরে এল। ক’দিন আগে বড়দের দেয়া কানমন্ত্র এবার কাজ করতে শুরু
করল। কিন্তু নিজস্ব প্রকৃতি অনুসারে বয়স্ক মানুষটির সাথে কোন কড়া ব্যবহার না করে
সে অত্যন্ত বিনয়ের ভঙ্গীতেই জানাল তার পক্ষে এখন কোন ধার দেয়া সম্ভব নয়। জামাইবাবুটি
হয়ত তখন মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করতে লাগলেন কেন একলাফে এত বেশী টাকা চাইতে গেলেন।
যাই হোক, তাড়াতাড়ি কথার মারপ্যাঁচে টাকার অঙ্ক নামিয়ে
একেবারে ‘কুড়ি’তে নিয়ে এলেন। বললেন, “না, ছুটুভাই, অখন কুড়ি টাকা পাইলেই বাকীটা আমি ম্যানেজ
কইরা লমু। আসলে কি জান ......”। ছেলেটি ওনার কথা শেষ করতে না দিয়ে মাঝপথেই বলে
উঠে- না কাকু, কুড়ি টাকা দেওন অ আমার পক্ষে সম্ভব হইত না। 'ভদ্রলোক' কিন্তু এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র ন’ন। উনি
ছেলেটির পিঠে হাত রেখে আদরের ভঙ্গীতে বললেন, “এই তো, কি সুন্দর কাকু ডাকছ, আইজকাইল অন্য পোলাপানের ত দাদা
ডাকতেই মন কয় না য্যান্- অভদ্রের মতো বড়রারে নামের পিছে বাবু লাগাইয়া ডাকে। তা
ভাতিজা, ঠিক আছে, তুমার খুব অসুবিধা
থাকলে তুমি দশটা টাকাই দ্যাও, আমি অন্য কুনুভাবে ম্যানেজ
কইরা লমু নে”।
এবার ছেলেটির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে রেগে বলল,
“আপনে ত দেখি জব্বর আঁটালি। দশটাকা ক্যান্, আপনেরে
একটা পয়সা অ আমার দ্বারা দেওন সম্ভব হইত না”। এবার ভদ্রলোক হতাশার চূড়ান্তে পৌঁছে
একজন বিজ্ঞ সমাজতাত্ত্বিকের মতো গম্ভীর স্বরে অফিসে হাজির অন্য সবার উদ্দেশ্যে
জোরে জোরে বলতে লাগলেন, “হ্যালো গাইস্ ! অল্ অফ ইউ জাস্ট
সি; অ্যান ইয়ং ম্যান হেভিং নো লায়েবিলিটিস্ ক্যান্ট
অ্যাফোর্ড ইভেন রুপিস টেন ফর হিস্ ফেলো কলিগ ! হোয়াট্ এ শেম্ ফর সাচ এ সেল্ফিস্
সোসাইটি ! রিয়ালি, হোয়াট এ শেম ......”।
হলঘরের মতো বড় রুমের এককোণে জামাইয়ের জোরদার বক্তৃতার বাক্যবাণে
আকৃষ্ট হয়ে সবাই কাছাকাছি ছুটে এল। ওনার সমসাময়িক এবং বন্ধুস্থানীয় একটা ঠোঁটকাটা
দাদা কৃত্রিম সান্ত্বনার ভঙ্গীতে উনাকে সরিয়ে নিয়ে বলল,
“কি আর করবি রে জামাই, যত দিন যাইতাছে,
তোর মতো নি:স্বার্থ মানুষ ক্রমেই কইম্যা আইতাছে"। পরক্ষণেই
দুষ্টু বুদ্ধি খাটিয়ে জামাইয়ের খুব কাছে গিয়ে বলে উঠে, "অখন থিক্যা তুইই দয়া কইরা নিজে একটু স্বার্থপর হইয়া চুপচাপ থাইক্যা আমরারে,
আর সারা এজি অফিসটারে বাটপারির উপদ্রব থিক্যা রেহাই দে দেখি”।
0 মন্তব্যসমূহ