- বই- মিথ
পঞ্চদশ – মন্দিরের
মিথ, মিথের
মন্দির
- লেখক
– কৌশিক দত্ত
- প্রকাশক
– পার্চমেন্ট
- প্রচ্ছদ
– সঞ্জীব চৌধুরী
- প্রকাশকাল
– নভেম্বর, ২০১৮
- মুদ্রিত
মুল্য – ২৮০
/-
- পৃষ্ঠা – ১৪৩
বছরখানেক আগে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা “ রঙ্কিণী দেবীর খড়্গ” গল্প পড়ে রঙ্কিণী দেবী সম্পর্কে জানার তীব্র কৌতূহল হয়। তাই খোঁজাখুঁজি শুরু করি। খুঁজতে গিয়ে কৌশিক দত্তর লেখা “রঙ্কিনী: দেবী মিথ মানবী” বইটির খোঁজ পাই। এই লেখকের কোনও লেখাই আগে পড়া না থাকায় আর কোন বই লিখেছেন তা জানতে গিয়ে “মিথ পঞ্চদশ”-এর খোঁজ পাই।সেই আগ্রহ থেকেই এই বই
পড়া শুরু।
পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার অন্যতম হল ভারতীয় সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার সময়কালকে ভারতীয় সভ্যতার সূচনাকাল রূপে চিহ্নিত করা হয়। ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস মানে শুধুই রাজা – বাদশাদের শাসনকাল, যুদ্ধ বিগ্রহ, কীর্তিকলাপ সমন্বিত কাহিনী নয়। ভারতীয় ইতিহাসে জড়িয়ে আছে বহু দেবদেবীর সম্পর্কিত প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনী ও লৌকিক- অলৌকিক গাঁথা। দেবদেবীদের প্রসঙ্গ এলে অবধারিতভাবেই উঠে আসে বিভিন্ন মন্দিরের নির্মাণ সংক্রান্ত ইতিহাস থেকে শুরু করে স্থানীয় মানুষের লৌকিক বিশ্বাস ও সেই বিশ্বাসকে ঘিরে বিভিন্ন কাহিনী।একটি মন্দির ঘিরে গড়ে ওঠে স্থানীয় জনজাতির বিশ্বাস, তাঁদের লোকাচার। মন্দিরের বিগ্রহের অলৌকিক শক্তির প্রচারে যে কোনও স্থানের মাহাত্ম্য জড়িয়ে তৈরি হয় ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ। এই সব কিছুই ছাপ ফেলে যায় সেই স্থানের জীবনযাত্রার ওপর। ভারত তথা বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই রকম বহু মন্দির এবং মন্দিরের বিগ্রহ সমূহ। এদের মধ্যে অনেকেরই অলৌকিকত্ব কিংবদন্তীর জন্ম দিয়েছে। বহু দূর থেকে মানুষ এই সব মন্দির দর্শন করতে আসেন নিজেদের মনস্কামনা পূরণ করার মনোবাঞ্ছা নিয়ে।
মন্দিরের ভাস্কর্য ও শিল্পকলা নিয়ে এর আগেও বেশ কিছু বই লিখিত হয়েছে। কিন্তু মন্দিরের সাথে জড়িত জনজীবন ও তাঁদের লৌকিক আচার – অনুষ্ঠানসহ মন্দির ও মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেব-দেবীর সম্পর্কে লৌকিক বিশ্বাস ও কাহিনী সম্বলিত বই বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত বিরল। লেখক কৌশিক দত্ত মন্দির - বিগ্রহ ও তৎসহ মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে গভীর গবেষণার মাধ্যমে বহু শ্রম ব্যয় করে বইটি লিখেছেন।এই বইয়ে পনেরোটি মন্দিরের বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে।
· অম্বুলিঙ্গ মহেশ্বর
· বাবা বড়ো কাছারি
· বাবা দক্ষিণ রায়
· বিপত্তারিণী ও বাবা দুলাল
· ইছাই ঘোষের দেউল
· যুগল কিশোর
· অপরাধভঞ্জন পাট কুলিয়া
· মহানাদ
· লীলাময় মদনমোহন
· মেলাইচণ্ডী
· মুলাজোড়ের ব্রহ্মময়ী
· পানিহাটির রাঘব ভবন
· রামকেলি
· সাবিত্রী মন্দির
· উলাই চণ্ডী
শ্রী গোপেন্দ্র কুমার বসু রচিত “বাংলার লৌকিক দেবতা” এবং অশোক মিত্র সম্পাদিত “পশ্চিমবঙ্গের পূজা পার্বণ মেলা” বই থেকে এই বিষয়ে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু এই বইয়ে প্রতিটি মন্দিরের ইতিহাসের সাথে সাথে তাতে অবস্থিত বিগ্রহের বিষয়ে বিভিন্ন কাহিনীও লিখিত আছে। আছে পুরাণ বর্ণিত মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলের স্থান মাহাত্ম্য এবং লৌকিক বিশ্বাসের সাথে সাথে অলৌকিক কাহিনীর বিবরণও ।যেমন অম্বুলিঙ্গ মহেশ্বর মন্দিরের কাহিনীসূত্রে এসেছে একটি কাহিনী।
“দক্ষিন চব্বিশ পরগনার বিশিষ্ট গবেষক প্রয়াত কালিদাস দত্তর ক্ষেত্রসমীক্ষায় জানা যায় এই অঞ্চলের কাছাকাছি “ছতর ভোগ" না্মে এক নদী বয়ে যেত। এমনও হতে পারে যে ওই নদীনামের সঙ্গে গ্রামনামের কোনো সম্পর্ক ছিল। আবার আঞ্চলিক গবেষক দেবীশংকর মিদ্দার মতে বিষ্ণুচক্রে ছিন্ন সতীর ছত্র বা বক্ষ পঞ্জর এখানে পতিত হয়েছিল, তাই নাম ছত্রভোগ। পীঠদেৰী ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীর প্রাচীন মন্দিরটি আর তাঁর ভৈরব অম্বুলিঙ্গ মহাদেব। এই ত্রিপুরা সুন্দরী দেবীর মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে বর্তমান দালানমন্দিরে দারুমূর্তিতে নিত্য পৃজিতা হন।
ভগীরথের সঙ্গে গঙ্গা ক্রমে দূর পথে যত যেতে থাকলেন মহাদেবের জটায় জলভার ততই কমতে থাকল। মহাদেব অনুভব করলেন তিনি ক্রমে গঙ্গাহারা হয়ে যাচ্ছন। ব্যগ্র হয়ে ভিনি চললেন গঙ্গার খোঁজে। গঙ্গার স্রোতধারা ধরে চলতে চলতে তিনিও এসে পৌঁছালেন ছত্রভোগে। দেখা হুল দু'জনায়, আকুল মহাদেব জড়িয়ে ধরতে গেলেন গঙ্গাকে। দারুন লজ্জায় গঙ্গা অন্তর্হিতা হলেন। ভর্ৎসনা করলেন মহাদেবকে, সন্তানসম ভগীরধের উপস্থিতিতে এই ধরনের অসৈরনের কাজের জন্য। মহাদেবও সম্বিত ফিরে পেয়ে লজ্জিত হলেন। বৃন্দাবন দাস তাঁর “চৈতন্য ভাগবত” -এ লিখেছেন-
গঙ্গার বিরহে শিব বিহ্বল হইয়া।
শিব আইলেন শেষে গঙ্গা স্মঙরিয়া।।
গঙ্গারে দেখিয়া শিব সেই ছত্রভোগে।
বিহ্বল হইলা অতি গঙ্গা অনুরাগে।।
গঙ্গা দেখি মাত্র শিব গঙ্গায় পড়িলা।
জলরূপে শিব জাহবীতে মিশাইলা।।
শিবের এই অম্বুত্ব প্রাপ্তির কারণে ভিনি এইখানে অম্বুলিঙ্গ নামে পূজিত হন। …"
এই প্রকারের বিভিন্ন কাহিনীর সাথে সাথে প্রতিটি মন্দিরের পূজা পার্বণের সময়কাল এবং যাত্রাপথের হদিসও বইয়ে দেওয়া আছে। আছে লেখকের নিজস্ব সংগ্রহের অজস্র দুষ্প্রাপ্য ছবি। রচয়িতার ইতিহাসচর্চা এবং মন্দির সংক্রান্ত দীর্ঘ গবেষণার সফল রূপায়ন এই বই।প্রাচীন ইতিহাস ও সমাজবিদ্যা সম্পর্কে আগ্রহী প্রত্যেক পাঠকের এই বই অবশ্যই পছন্দ হবে তা বলাই বাহুল্য। প্রাচীন মিথ যা সাধারণত লোকমুখেই প্রচলিত থাকে তা লিপিবদ্ধ আকারে একত্রিতভাবে পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর। লেখক অসীম ধৈর্যের সাথে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সেই সমস্ত লোকশ্রুতির উপাদানকে সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করেছেন।উদ্দেশ্য দেব দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার নয়, বরং মন্দিরগুলোকে নিবিড়ভাবে পরিচিত করানো, কাহিনীগুলোকে অন্তরঙ্গভাবে জানানো।লেখকের সেই উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে সফলতার দাবী করে।
0 মন্তব্যসমূহ