ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

কবিরাজ সূর্যনাথের মহৌষধি -পুষ্পার্ঘ্য দাস





 

কাল সারারাত ধরে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে, সাথে বাজ পড়েছে অবিরত। সে যে কী ভয়ানক শব্দ! বৃষ্টির ধাক্কায় একসময় তো মনে হচ্ছিল টুপুরদের টালির চালটাই বুঝি ভেঙে পড়ে! বাজের আলো আর আওয়াজ দুটোকেই ভয় পায় টুপুর, সারারাত ঘুমোতেই পারেনি। গুটিসুটি মেরে মাকে জড়িয়ে থিরথির করে কাঁপছিল সে, বাঁশের পাতায় জল পড়লে যেরকম কেঁপে ওঠে ঠিক সেরকম। টুপুরের মা শ্যামলী ওকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে অবশ্য ঘুমিয়েও পড়ছিল শ্যামলী। সারাদিন বাড়ির হাজারটা কাজ করার পরিশ্রম, রাতে তো তার শোধ তুলবেই।

টুপুর আর শ্যামলীর পাশে আরও একজন সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি, টুপুরের বাবা সূর্যনাথ। রেডিওতে বলেছে, এই মুষলধারে বৃষ্টি নাকি আরও এক সপ্তাহ চলবে। আরও এক সপ্তাহ? সূর্যনাথ ভেবে উঠতে পারে না, এই বৃষ্টিতে সে বেরোবে কী করে! এমনিতেই তার ঠান্ডা লাগার ধাত! তার ওপর আগের বছর অনেক কষ্টে জমানো টাকা দিয়ে ফুটপাত থেকে যে রেনকোটটা কিনেছিল, সেটাতেও ফুটো হয়ে গেছে। কোনো পোকায় কেটেছে বোধহয়। জল ঢুকে যায়। পরা বা না-পরা সমান।

রোজ রোজ খুব ভোরে উঠে তিন চাকার ভ্যানরিকশা নিয়ে তাকে বেরিয়ে পড়তে হয় দূর নসিবগঞ্জে পাইকারি সবজি তুলতে। তারপর সেই সবজি নিয়ে সোজা চলে যায় হাটে। আজ আকাশের যা অবস্থা, খদ্দের কজন আসবে তার ঠিক নেই। নসিবগঞ্জ ওর বাড়ি থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার। ভিজে ভিজে যদি যায়ও বা, রোজগারে পোষাবে কি? আর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত ঠান্ডা লেগে গেলে তো আর কথাই নেই। ডাক্তার-ওষুধে বেরিয়ে যাবে অনেকগুলো টাকা।

এমনিতে জন্ম থেকেই মেয়েটার একটার পর একটা রোগ লেগেই আছে। যখনই সূর্যনাথ কিছু টাকা জমিয়েছে, ঠিক তখনই মেয়ের রোগ এসে খেয়ে ফেলেছে সেই সঞ্চয়। এই তো কদিন আগেই ম্যালেরিয়াতে ভুগল মেয়েটা। সূর্যনাথ শেষ ক’মাসে যা জমিয়েছিল, সব বেরিয়ে গেছে। এখন আবার সত্যি সত্যি দিন আনি দিন খাই অবস্থা।

এই অবস্থায় যখন সূর্যনাথ ভাবছে যে কী করবে সে, ঠিক তখনই শুনতে পেল ঘরের মধ্যে জল পড়ার আওয়াজ। বহুদিনের জীর্ণ টালির চাল ফুটো হয়ে গেছে। আবার অতিরিক্ত খরচ! কোথা থেকে এত টাকা জোগাবে সে? সূর্যনাথের হঠাৎ খুব বেশি করে শীত শীত করতে লাগল। মনে হচ্ছে, জ্বর আসবে। হাঁটু দুটো বুকের কাছে তুলে গুটিসুটি মেরে ছেঁড়া কাঁথাটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিল। প্রবল আলস্য ঘিরে ধরল তাকে। মনে হল, জীবনযুদ্ধ থেকে কেউ যদি ছুটি দিয়ে দিত! বছরখানেক আগেও কিন্তু ব্যাপারটা এ'রকম ছিল না।

 

 

আগের কথা, যখন আকাশ পরিষ্কার ছিল –

“দাদারা, দিদিরা, ভাইয়েরা, বোনেরা, বন্ধুরা… মোবাইল বা খবরের কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে একটু তাকাবেন এদিকে! বেশি নয়, মাত্র দু-তিন মিনিট সময় নেব আপনাদের! যারা ডেইলি প্যাসেঞ্জার, তারা আগে থেকেই আমায় চেনেন। যারা নতুন, তাদের জন্য বলছি, নিজের জীবনের দু-তিন মিনিট আমাকে দিন, আমি আপনার পুরো জীবন পালটে দেব।” এই পর্যন্ত বলে সূর্যনাথ একটু থামল। নিজের কাঁধে ঝোলানো কালো ব্যাগটা থেকে হোমিওপ্যাথি ওষুধের ছোট্ট শিশির মত একটা শিশি বের করল। শিশির ভেতর কিছু একটা তরল রয়েছে। ভেতরের তরলের রংটা বোঝা যাচ্ছে না শিশির রঙের জন্য। বাইরে হলুদ রঙের একটা কাগজ সাঁটা। তাতে বড় বড় করে লেখা – ‘কবিরাজ সূর্যনাথের মহৌষধি’। নীচে আরও ছোট ছোট করে কিছু লেখা আছে, সেগুলো ঠিক পড়া যাচ্ছে না।

সূর্যনাথ বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মাঝে শিশিটা ধরে হাতটাকে সামনে এগিয়ে আবার বলতে শুরু করল, “আপনি বা আপনার আশেপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা কিছু একটা খেতে গেলেই পাঁচ-সাতবার ভাবেন। হয়ত খাবারটা অত্যন্ত লোভনীয়- মুখে তোলার জন্য হাতটা নিশপিশ করছে; কিন্তু খেতে পারছেন না। কারণ আর কিছুই নয়- গ্যাস, অ্যাসিডিটি, পেটব্যথা। হয়ত একটা চপ বা সিঙ্গাড়া খেলেন। দশ-পনেরো মিনিট পর থেকেই চোঁয়া ঢেঁকুর ওঠা শুরু। জীবন থেকে লুচি-মাংস বহুদিন হল বাদ দিয়েছেন। পাপড়ি চাট দূর থেকে দেখেই আহা-উহু করেন। জিভে জল এলেও ঢোঁক গেলা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। প্রচুর বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না! এ'রকম সমস্ত দুশ্চিন্তা থেকে আপনাদের মুক্ত করতে এবার চলে এসেছে কবিরাজ সূর্যনাথের মহৌষধি। দীর্ঘদিনের অধ্যবসায় এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যষ্টিমধু, আমলকী, লবঙ্গ, আদা, হিং, জোয়ান, কালো মরিচ ইত্যাদি ঘরোয়া জিনিসের সাথে সাথে কিছু গোপন গাছের শিকড় মিশিয়ে আমি নিজের হাতে তৈরী করেছি এই ঔষধ। অন্যান্য আয়ুর্বেদ ওষুধের মত একে নাক-মুখ চেপে খাওয়ার কোনো দরকার নেই। বেশ সুস্বাদু খেতে। আজ অনেকগুলো বছর আমার এই লোকাল ট্রেনের কামরায় কেটে গেল। সূর্যনাথের ঔষধ আজ পর্যন্ত কোনোদিন ফেল করেনি। অনেক তো আজেবাজে খরচ করেন। এই ওষুধটা কিনে দেখুনই না। মাত্র একশো টাকা দাম। দুপুরে এবং রাতে খাবার পরে দশ ফোঁটা করে খান আর তাহলেই ম্যাজিক। কিন্তু মনে রাখবেন, ভুলেও খালি পেটে খাবেন না যেন। দিন পনেরো খাওয়ার পর থেকেই পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন। আর কাজ যদি না হয়, তাহলে আমি তো থাকলামই এই লোকাল ট্রেনের কামরায়। বিশ্বাস করে কিনুন একবার। কথা দিচ্ছি ঠকবেন না।”

একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে থামল সূর্যনাথ। এ তার নিত্যদিনের অভ্যেস। কথাগুলো বারবার বলে বলে মাথার মধ্যে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছে যে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও সে পুরোটা বলে দিতে পারবে। কোন কথায়, কখন কতটা জোর দিতে হবে, গলার ভ্যারিয়েশনই বা কেমন হবে, এসব নিয়ে সূর্যনাথ অত্যন্ত খুঁতখুঁতে। সে বিশ্বাস করে, কথাতেই মানুষের অর্ধেক রোগ সেরে যায়। নিজেও যতবার ডাক্তারের কাছে গিয়েছে, দেখেছে যে- ডাক্তার কথায় মানুষকে মুগ্ধ করে রাখে, তার চেম্বারে লম্বা লাইন। আর যে ডাক্তারের মুখে কথা নেই, বা থাকলেও অত্যন্ত উদ্ধত, সে বসে বসে মাছি তাড়ায়।

 

 

সূর্যনাথের কবিরাজি শেখা তার বাবার কাছ থেকে। সূর্যনাথের বাবা বিশ্বনাথের হাতযশ মোটামুটি ভালোই ছিল। তাদের কুঁড়েঘরে সকাল-বিকেল মিলে রোগীর সংখ্যা মন্দ ছিল না। কিন্তু গ্রামের মানুষদের কাছ থেকে টাকা নিতে বিশ্বনাথের ছিল প্রবল অনীহা। কেউ নিজে থেকে কিছু দিয়ে গেলে ঠিক আছে, নাহলে লবডঙ্কা। বিশ্বনাথের এই সরলতার সুযোগ নিয়ে বেশিরভাগ গ্রামবাসীই বিনা পয়সায় চিকিৎসা করিয়ে যেত। কিছু সহৃদয় ব্যক্তি কখনো দশ-কুড়ি টাকা বা তাদের বাড়িতে যেসব শাক-সবজি, ফলমূল হত সেসব দুয়েকটা দিয়ে যেত। কিন্তু সে আর কী এমন?

পৈতৃকসূত্রে বিশ্বনাথ পেয়েছিলেন বিঘা খানেক জমি। সে জমি চাষ করত ভাগচাষিরা। সংসার কোনোরকমে টেনেটুনে সেখান থেকেই চলত। কোনোদিনও চাষবাসের তদারকি করেননি। তাঁর ধ্যানজ্ঞান সবকিছুই ছিল আয়ুর্বেদ। নতুন নতুন ওষুধ তৈরী করার নেশায় দিনরাত এক করে দিতেন। রাতবিরেতে যে যখন ডেকেছে, এক ডাকে ছুটে গিয়েছেন। কঠিন রোগে আক্রান্ত রোগীর সেবা করেছেন সারারাত। এক মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করেননি। এভাবে বাঁচিয়েও তুলেছেন বহু লোককে।

এভাবেই হয়ত কেটে যেত। কিন্তু সূর্যনাথের মাকে ধরল যক্ষ্মা রোগে। বিশ্বনাথ নিজেই বাড়িতে স্ত্রীয়ের চিকিৎসা করতে লাগলেন। রোগ খুব একটা যে নিরাময় হল তা কিন্তু নয়, বরং উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। সূর্যনাথের শত অনুরোধ সত্ত্বেও চিরকাল আয়ুর্বেদ চিকিৎসা করে আসা বিশ্বনাথ গোঁ ধরে বসে রইলেন, কিছুতেই স্ত্রীয়ের অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা করাবেন না। একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে বাবার কথা অমান্য করে সূর্যনাথ নিজে থেকেই ছোটাছুটি আরম্ভ করল। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত সব চেষ্টা বিফলে গেল, বাঁচাতে পারল না মাকে। মাঝখান থেকে তাদের নামমাত্র সম্পত্তির অর্ধেক জমি চিকিৎসার খরচ জোগাতে বিক্রি হয়ে গেল।

সূর্যনাথের মা যখন মারা যান, তখন সূর্যনাথের সবে ঊনিশ পূর্ণ হয়েছে। বাবার কাছ থেকে সে ততদিনে শিখে নিয়েছে ছোটোখাটো অসুখ-বিসুখ সারানোর মত কাজ। স্ত্রীয়ের মৃত্যু আয়ুর্বেদের প্রতি বিশ্বনাথের বিশ্বাসের ভিত কিছুটা হলেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। নারীহীনা সংসার বিচ্ছিন্ন, অগোছালো হয়ে পড়ে রইল। নদীর মাঝখানে ব-দ্বীপের মত তাদের কুঁড়েঘরের দুপ্রান্তে দিন কাটাতে লাগল দুটি প্রাণী। পূর্ব প্রান্তে সূর্যনাথ আর পশ্চিম প্রান্তে তার বাবা।

বিশ্বনাথ কবিরাজি ছেড়ে দিলেন। অল্প বয়সেই দিনে দিনে ক্রমশ শুকিয়ে যেতে লাগলেন। ভাগচাষিরা ঠকাতে আরম্ভ করল। জমিজমার ব্যাপারে তিনি আগের মতোই উদাসীন হয়ে রইলেন। সূর্যনাথ টুকটাক কবিরাজি শুরু করল। বাবার মত প্রতিভা তার ছিল না। কোনোরকমে ঘষটে ঘষটে চলছিল।

 

 

সংসারের হাল ধরার জন্য বাড়িতে একজন মেয়ের উপস্থিতি খুব দরকার ছিল। নারী বর্জিত সংসার সর্বদাই অসম্পূর্ণ। বছর চারেক পর বিশ্বনাথ ছেলের বিয়ের ব্যবস্থা করলেন তাঁরই ছোটবেলার বন্ধু শশীকান্তের মেয়ে শ্যামলীর সাথে। সংসারে আয় বলতে বলার মত কিছুই ছিল না। তিনজনের সংসার একটা সময় যখন দরিদ্রতার চরমে পৌঁছাল, তখন সূর্যনাথ বাবাকে ধরল বাকী জমিটাও বিক্রি করার জন্য। জমি বিক্রির কিছু টাকা ব্যাঙ্কে রেখে বাকি টাকা দিয়ে সূর্যনাথ বানিয়ে ফেলল ‘কবিরাজ সূর্যনাথের মহৌষধি’। এই ঔষধের পেছনে অবশ্য একটা ইতিহাস রয়েছে, সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। সেই থেকে তার হকারি শুরু। এই নতুন ওষুধের ব্যাপারে বিশ্বনাথ জানতে চাইলেও নানা কৌশলে সেসব প্রশ্ন সে এড়িয়ে যায়। বাবাকে কিছুতেই বলে না, কোন্ গোপন গাছের শিকড় দিয়ে তৈরী তার এই নতুন ওষুধ। সূর্যনাথের হকারি শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই একদিন ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে চলে গেলেন বিশ্বনাথ। এর বছরখানেক পরে টুপুর এল। এই বর্ষায় টুপুর পাঁচে পা দিয়েছে।

‘কবিরাজ সূর্যনাথের মহৌষধি’ প্রথম প্রথম খুব একটা না চললেও একটা সময় পর বিক্রি বাড়তে শুরু করল। লোকের উপকার হল। আর মুখে মুখে ওষুধের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। সহজলভ্য উপকরণগুলো ঢাক ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিলেও গোপন গাছের শিকড়টি সম্বন্ধে সূর্যনাথ আজ পর্যন্ত কারও কাছে মুখ খোলেনি, এমনকি শ্যামলীর কাছেও না। শিকড়ের পেছনের গল্পও এমনি কোনো সাধারণ গল্প নয়। অনেকে হয়ত হেসেই উড়িয়ে দেবে। সূর্যনাথ এও ভাবে, মেয়েমানুষ, বলা তো যায় না, পেটে কথা থাকবে কিনা! পাড়ার অন্য বউদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে দেখা গেল বলেই দিল কোনোদিন। আর একবার যদি জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে তো সে শেষ।

সূর্যনাথ শ্যামলীকে প্রথম থেকেই জানিয়ে দিয়েছে যে, ও যখন ওষুধ তৈরী করবে তখন কেউ যেন ওর ধারেকাছে না আসে। কিন্তু টুপুর তো ছোট মেয়ে। সে তো কথা শোনে না। এই তো সেদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর সূর্যনাথ যখন ঘরের এক কোণে ওষুধ তৈরীতে ব্যস্ত, শ্যামলীর নজর এড়িয়ে টুপুর ঠিক সেখানে উপস্থিত। টুপুর শুধাল সূর্যনাথকে, “বাবা, তুমি কী কাজ করছ?”

সূর্যনাথ কাজে মগ্ন ছিল। হঠাৎ টুপুরের প্রশ্নে প্রথমটা সে হকচকিয়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নিল। ওইটুকু মেয়ে, ও আর এমন কী বুঝবে। হেসে বলল, “ওষুধ তৈরী করছি মা।”

“কিসের ওষুধ বাবা?”

“পেটব্যথার ওষুধ সোনা।”

“আমাকেও একটু ওষুধ দাও না।”

“তোমার কি অসুখ করেছে সোনা যে তুমি ওষুধ খাবে?”

“না করেনি তো, তবু একটু খেয়ে দেখব। দাও না বাবা, এক্কেবারে একটু খাব। দেখব কেমন খেতে।”

মেয়ে নাছোড়বান্দা দেখে সূর্যনাথ বলল, “ঠিক আছে। হাঁ করো।”

টুপুর হাঁ করতে ওর মুখে দু-তিন ফোঁটা ওষুধ দিয়ে দিল সূর্যনাথ। টুপুর মুখে আওয়াজ করে খেয়ে বলল, “বাঃ! দারুণ খেতে তো!”

“হ্যাঁ, খেতে তো ভালোই। কিন্তু তুমি আমাকে কথা দাও, আমাকে না বলে কোনোদিন এই ওষুধ তুমি খাবে না।”

“এতটুকুও না?”

“না, এতটুকুও না।”

“বেশ, কথা দিলাম।”

 

 

প্রতি তিনমাস অন্তর পূর্ণিমার রাত একটার পর সূর্যনাথ বাড়ি থেকে বেরোয় সেই গাছের শিকড় জোগাড় করতে, যখন শ্যামলী আর টুপুর দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে। ওর বাড়ি থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে শুরু হয়েছে সাধুবাবার জঙ্গল। অনেক বছর আগে এক সাধুবাবা এই জঙ্গলে এসে ডেরা বেঁধেছিল, সেই থেকে এই নাম। সূর্যনাথের তখন জন্মও হয়নি। সাধুবাবা সম্বন্ধে গ্রামের লোকের মুখে নানারকম গল্প শোনা যায়।

সাধুবাবা ছিলেন সিদ্ধ পুরুষ। দিনের বেশিরভাগ সময়টাই ধ্যানমগ্ন থাকতেন। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি কোনো কিছু যেন তাঁকে ছুঁতে পারত না। গ্রামের বহু মানুষ সাধুবাবার কৃপা পাওয়ার আশায় হত্যে দিয়ে তাঁর চরণে পড়ে থাকত। যারা একটু অবস্থাসম্পন্ন, তারা নানান ভেট নিয়ে যেত সাধুবাবাকে প্রসন্ন করার জন্য। সাধুবাবা সেসব ছুঁয়েও দেখতেন না। যারা লোভী, জীবনে টাকার অঙ্ক ছাড়া আর কিছু বোঝে না, তারা দিনের পর দিন মাসের পর মাস পড়ে থেকেও সাধুবাবার কাছ থেকে কিছুই আদায় করতে পারল না। শেষের দিকে রাগে তারা সাধুবাবাকে ভন্ড বলে প্রচার করতে আরম্ভ করল। সাধুবাবা যেমন হঠাৎ করে উদয় হয়েছিলেন, তেমনই একদিন হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। শুধু তিনি চলে যাওয়ার পরে পরেই কিছু মানুষের জীবনে অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটল। সেই লোকগুলো কিন্তু দিনরাত পড়ে থাকত না সাধুবাবার কাছে। তবে ভালো লোক হিসেবে বাজারে বেশ সুনাম ছিল তাদের। গ্রামের অনেকেই তাদের এই হঠাৎ উন্নতির পেছনে সাধুবাবার হাত দেখতে পেল।

 

 

তারপর বহু বছর কেটে গেছে। মা মারা যাওয়ার পর থেকে সূর্যনাথ তখন বাবাকে এক মুহূর্ত সহ্য করতে পারছে না। বাড়িতে থাকেই না প্রায় সারাদিন। উদ্দেশ্যহীন ভাবে এদিকওদিক ঘুরে বেড়ায়। সংসারে মা তার অনেক কাছের ছিল। বাবাকে তো সারাদিন প্রায় পেতই না। সব আবদার তার মায়ের কাছে। সেই মা যখন জীবন থেকে মুছে গেল সূর্যনাথের, তখন সে সবকিছুর জন্যই তার বাবাকে দায়ী করতে শুরু করল। চীৎকার করে অনেক কিছু বলার ছিল তার। কিন্তু কিছুতেই বাবার সামনে দাঁড়ানোর সাহসটুকু জোগাড় করে উঠতে পারছিল না। শেষমেশ আর থাকতে না পেরে, একদিন সন্ধেবেলা সে হানা দিল চুল্লুর ঠেকে।

খড়ের চাল দেওয়া একটা ছিটেবেড়ার ঘর। দিনেরবেলাতেও আলো ঢোকে না সেখানে। আর এই ভর সন্ধেবেলা অন্ধকারের মধ্যে দু-একটা নিভু নিভু লম্ফ জ্বলছে। তারই মাঝে ছায়ার মত বসে আছে অনেকে। সূর্যনাথের একবার মনে হল, এরা সত্যি সত্যি ছায়া নয় তো? কিন্তু পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে নিল সে। বলা তো যায় না, কোন ছায়া আবার কবিরাজ বিশ্বনাথের ছেলে বলে তাকে চিনে ফেলে।

যে ছেলে একদিনও কোনো নেশার দ্রব্য ছুঁয়ে দেখেনি, সেই ছেলে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। আকন্ঠ মদ খেয়ে টলতে টলতে বাড়ি ফিরল সে। ব-দ্বীপের পশ্চিম প্রান্তের দরজা ঘিরে দাঁড়াল। জড়ানো গলায় বলল, “এই যে মহান কবিরাজ মশাই, শুনতে পাচ্ছেন?”

পূর্ণিমার রাত। বিশ্বনাথ বালিশে ঠেস দিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে বসেছিলেন। আদৌ কিছু দেখছেন কিনা বোঝা শক্ত। সূর্যনাথের গলার স্বরে চমকে উঠে পেছনে তাকালেন। সূর্যনাথের পা দুটো নেশায় টলছে। মুখ দিয়ে ভক ভক করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। বিশ্বনাথ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন কয়েক মুহূর্তের জন্য। তাঁর ছেলে হয়ে সূর্যনাথ নেশা করে বাড়ি ঢুকবে, একথা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। আয়ুর্বেদ শেখানোর সময়টুকু ছাড়া ছেলেকে একেবারেই সময় দিতে পারতেন না। একমাত্র যোগসূত্র ছিলেন সূর্যনাথের মা। সেই যোগসূত্রটুকু ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর থেকে বিশ্বনাথ বুঝতে পারছিলেন, ছেলে যেন আরও দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু এতটা অধঃপাতে যাবে, তিনি আশা করেননি।

ইস্পাতকঠিন স্বরে বললেন, “এখন তুমি কথা বলার মত অবস্থায় নেই। শুয়ে পড়ো। কাল সকালে কথা বলব।”

সূর্যনাথ উচ্চস্বরে এমনভাবে হা হা করে হেসে উঠল, যেন বিশ্বনাথ দারুণ কোনো মজার কথা বলেছেন। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে সে কেটে কেটে বলল, “তোমার জন্যই তো এত আয়োজন, বাওয়া! কতগুলো কথা যে তোমায় বলতেই হবে। না হলে বুকের ভেতর জ্বলা আগুনটা যে কিছুতেই নিভছে না। আর সেই কথাগুলো বলার জন্যই তো নেশা করলাম। কাল সকালে নেশা উড়ে গেলে তো আবার সাহসের বেলুন থেকে হাওয়া বেরিয়ে যাবে। তাই যা বলার আমি এখনই বলব।”

বিশ্বনাথ বুঝলেন, মাতাল অবস্থায় ছেলের সাথে বেশি কথা বলে লাভ নেই। তাই ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি সম্মত হলেন, “বেশ… বলো… শুনছি।”

একটা বড়সড় ঢেঁকুর তুলল সূর্যনাথ। দুর্গন্ধে বিশ্বনাথ নাক চেপে ধরলেন। মনে হল দুপুরে যা খেয়েছেন, হজম হওয়া খাবারগুলোও তাদের পুরানো রূপে ফিরে বমি হয়ে উঠে আসবে। মুখে আলতো করে হাত চাপা দিয়ে ধীরে ধীরে সূর্যনাথ বলতে শুরু করল, “সেদিন একটা স্বপ্ন দেখলাম জানো বাবা? দেখলাম যে আমাদের এই দু পয়সার ঘরের সামনে প্রচুর ভিড়। টিভির আর খবরের কাগজের লোকেরা সব গাড়ি নিয়ে ধর্না দিয়েছে, শুধু তোমার ইন্টারভিউ নেবে বলে। বেশ কিছু পুলিশ ভিড় আটকাবার চেষ্টা করছে, যাতে ওরা বাড়ির মধ্যে ঢুকে না পড়ে। তুমি বাইরে যেতেই কয়েকজন সাংবাদিক চীৎকার করে উঠল, ‘নিজের স্ত্রীকে খুন করে আপনি এখন কেমন অনুভব করছেন?’ আমিও সেদিন থেকে ওই প্রশ্নটাই করতে চাইছি, ‘মাকে মেরে তোমার কেমন লাগছে বাবা?’”

বিশ্বনাথের চোখেমুখে ফুটে উঠেছে অবিশ্বাস। ভাবতেই পারেননি সূর্যনাথ সরাসরি তাঁকে এভাবে দায়ী করবে। অস্ফূটে বললেন, “আমি?”

চীৎকার করে উঠল সূর্যনাথ, “হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা তুমি! তুমি না তো আবার কে? পইপই করে বলেছিলাম, চলো মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। তুমি শুনেছিলে আমার কথা? মায়ের প্রাণের থেকে তোমার কাছে তোমার অহংকার আর জেদটাই বড় হল?” বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সে। চৌকাঠের ওপরেই শুয়ে পড়ল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলতে থাকল, “শুধু তোমার জন্য আমার মা-টা মরে গেল। জীবনেও তোমায় ক্ষমা করতে পারব না আমি। কোনোদিনও না।”

বিশ্বনাথের মনে হল, ছেলে তো একবর্ণও মিথ্যে বলছে না। এই অভিযোগের জবাব দেওয়ার মত তো কিছু নেই তাঁর কাছে। ছেলের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে আবার আগের মত শূন্যদৃষ্টি নিয়ে, জানালা দিয়ে রাতের আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন। চোখের পাতা ভিজে উঠল তাঁর।

কিছুক্ষণ পরেই বমি উঠে এল সূর্যনাথের। একছুটে বাড়ি থেকে কোনোমতে বেরিয়ে উঠোনের কাছেই হড়হড় করে একগাদা বমি করে ফেলল সে। কোনোদিন মদ খায়নি। এরকমটা তো হওয়ারই ছিল। মিনিট পাঁচেক পর উঠে পাশের বাড়ির টিউবওয়েলে গিয়ে নিজেকে ভালো করে পরিষ্কার করল। বমি হয়ে যেতেই নেশাটা কেটে গেছে। জ্যোৎস্নার মায়াবী আলোয় চারিদিক উদ্ভাসিত। জগৎ সংসারের প্রতিটি জিনিসকে রুপোর তৈরী বলে মনে হচ্ছে। সে এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য। যদিও এই পরিবেশ উপভোগ করার মত মনের অবস্থা সূর্যনাথের নেই। এই মুহূর্তে বাড়ি ঢুকতেও ইচ্ছে হল না তার। সাতপাঁচ না ভেবেই হাঁটতে লাগল সে।

 

 

চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর সে সাধুবাবার জঙ্গলের সামনে উপস্থিত হল। এদিকটায় একেবারেই বাড়িঘর নেই, পুরো খাঁ খাঁ। এমনিতে অন্যদিন দিনের বেলাতেও জঙ্গলের কাছে এলে নানারকম আওয়াজ শোনা যায়। আজ একেবারে নিঝুম। সূর্যনাথের কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। এত রাতে জঙ্গলে গিয়ে আর কাজ নেই, এবার বাড়ি ফেরাই ভালো – এই ভেবে যেই না সূর্যনাথ পেছনে ঘুরতে যাবে, অমনি জঙ্গলের মধ্যে একটা হাল্কা নীল রঙের আলো দেখতে পেল সে।

জঙ্গলের মধ্যে বেশ কিছুটা দূরে ওটা কিসের আলো দেখা যাচ্ছে? আলেয়া কি? কিন্তু জঙ্গলের ভেতর তো তেমন কোনো জলাভূমি নেই। তাহলে? কিসের যেন আকর্ষণে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল সূর্যনাথ। ওই মায়াবী হাল্কা নীল আলো যেন শক্তিশালী চুম্বক আর সূর্যনাথ এক টুকরো তুচ্ছ লোহা। ঘোরের মধ্যে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে পৌঁছে গেল সেই জায়গাটায়। গিয়ে দেখল এক আশ্চর্য দৃশ্য। জটাজুটধারী, খালি গা, নিম্নাঙ্গে লাল রঙের কৌপীন পরিহিত সাধুবাবা একটা সেগুন গাছের তলায় ধ্যানমগ্ন।  আর সেই গাছের বড় বড় পাতা থেকেই ওই মায়াবী আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে।

সূর্যনাথ সাধুবাবার সামনে বসে পড়ল। ঘোর তার এখনো কাটেনি। কতক্ষণ এভাবে বসে ছিল, তা আর সঠিকভাবে মনে নেই। সাধুবাবা এক সময় চোখ খুললেন। সূর্যনাথের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বললেন, “বাপকে আর কত দুষবি ব্যাটা? তোর বাপ লোকটা কিন্তু খারাপ নয়। হ্যাঁ, একটু গোঁয়ার বটে! তবে কেউ বিপদে পড়লে ছুটে যাবার আগে কখনো দুবার ভাবেনি।”

সূর্যনাথ ফোঁস করে উঠল, “আর ঘরের মানুষটা যে বাবার জেদের জন্য চলে গেল সাধুবাবা, তার বেলা?”

“হ্যাঁ, সে তো তোর বাপ ভুল করেইছে। তবে কিনা সংসারটা তো এবার তোকে দেখতে হবে রে ব্যাটা। তোর মায়ের চলে যাওয়ার ধাক্কা তোর বাপ কোনোদিনই কাটিয়ে উঠতে পারবে না। কিন্তু সে এই জন্মে অনেক পুণ্য করেছে। আর তারই ফলস্বরূপ আমি তোকে কিছু দিয়ে যেতে চাই। যাতে করে তুই লোকের উপকারও করবি আর নিজের জীবনটাও মোটামুটি কাটিয়ে দিতে পারবি। আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর পর এই মাসেই যে পূর্ণিমা পড়বে, সেইদিন রাত দুটোয় প্রথমবার এই সেগুন গাছের নীচে একটা ছোট্ট গাছ জেগে উঠবে। সেই গাছের শিকড়ের নির্যাস হবে পেটের ব্যারামের মহৌষধী। লোকের হজম হবে ভালো, খিদেও বাড়বে হু হু করে। কিন্তু সেটা খেতে হবে ভরা পেটে। খালি পেটে খেলে তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক। রাত দুটোর পর থেকে ঠিক পনেরো মিনিট থাকবে সেই গাছ। আবার নিজে থেকেই মিলিয়ে যাবে। আর তারপর থেকে প্রতি তিনমাস অন্তর পূর্ণিমায় ওই একই সময়ে তুই দেখা পাবি সেই গাছের। গাছের শিকড় কেটে বানিয়ে ফেলবি ওষুধ। এই ওষুধ বেশ সুস্বাদু হবে, তাই খেতেও লোকের ভালোই লাগবে। ওষুধ বিক্রি করে মোটামুটি ঠিকঠাকভাবেই কেটে যাবে তোর। মনে রাখিস, যদি বেশি লোভ করিস অথবা তুই ছাড়া গাছের কথা যদি অন্য কেউ জানতে পারে, তাহলে ও গাছ আর কোনোদিনও তৈরী হবে না।”

সূর্যনাথ হাঁ করে শুনছিল সাধুবাবার কথা। এবার বলল, “পাঁচ বছর পর থেকে কেন বাবা?”

সাধুবাবা স্মিতমুখে বললেন, “কারণ ততদিনে তুই দুনিয়াদারি শিখে যাবি।”

 

 

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সূর্যনাথের একবার মনে হয়েছিল, সে বুঝি স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু ঘটনাটার এত স্পষ্ট আর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল যে, কিছুতেই সেটাকে সে স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিতে পারছিল না। পাঁচ বছর পর পূর্ণিমার রাতে সে সত্যি সত্যিই সন্ধান পায় সেই আশ্চর্য গাছের।
তারপর থেকে এই ক’বছর মোটামুটি খেয়ে পরে বেশ ভালোভাবেই ছিল তারা। সমস্যা হল বছর দেড়েক আগে যখন করোনা ভাইরাসের মহামারী শুরু হল; আর তার জেরে লোকাল ট্রেন চলা বন্ধ হয়ে গেল। সূর্যনাথের তো মাথায় হাত। গ্রামের লোকেরা এমনিতেই বেশি খেতে পায় না। তার ওপর সারাদিন খেতে-খামারে কাজ করে তাদের হজম শক্তিও চমৎকার। কে কিনবে তার ওষুধ এই গন্ডগ্রামে?

ট্রেন বন্ধ হয়ে গেলেও তিনমাস ছাড়া ছাড়া সূর্যনাথ পূর্ণিমার রাতে জঙ্গলে যায়। শেকড় নিয়ে এসে ওষুধ তৈরী করে শিশিতে ভরে লেবেল সাঁটায়। আর সেইসব ওষুধের শিশি বস্তাবন্দী হয়ে পড়ে থাকে তার ঘরের এক কোণে। উপায়ান্তর না দেখে শেষে সে ব্যাঙ্কে আগের জমানো টাকা দিয়ে তিন চাকাওয়ালা ভ্যানরিকশা কিনেছে। এখন সবজি বেচে কোনোমতে তিনটে পেট চালায়।

করোনার প্রকোপে গ্রামের যারা বাইরে কাজ করত, তাদেরও কাজ চলে যাওয়ায় গ্রামে ফিরে এসেছে। লোকের হাতে পয়সা নেই। আশেপাশের সব গ্রামেই বেশিরভাগ লোকেরই জমি আছে। তারা নিজেদের জমির ফসলই খাচ্ছে। পয়সা দিয়ে খামোখা কিনবে কেন? তাই সূর্যনাথের রোজগার প্রায় নেই বললেই চলে। সঞ্চয়ও তলানিতে। সে নিজেও জানে না, এভাবে আর কদিন চালাতে পারবে?

 

 

পূর্ণিমার সন্ধে। ক্যালেন্ডার না দেখলে জানতেই পারত না সূর্যনাথ। সবসময় মেঘের ঘনঘটা আর বৃষ্টি। সেদিন টালির ছাদ ফুটো হয়ে গেলে পরে কোনোমতে ফুটোর ওপর ত্রিপল চাপিয়েছে। আজ সাতদিন হল ক্রমাগত বৃষ্টি পড়ছে। এবার মনে হচ্ছে ত্রিপলও না ছিঁড়ে যায়! কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে নদীবাঁধ ভেঙ্গে যেতে পারে। আর একবার যদি বাঁধ ভেঙ্গে যায়, তাহলে গ্রামের পর গ্রাম ভেসে যাবে পুরো।

সূর্যনাথ সেদিন থেকে ব্যবসা করতে যেতে পারেনি। আর গিয়েই বা কী করত? খদ্দের কোথায়? আগে যখন ওদের জমি ছিল, ভাতের অভাব হয়নি কখনো। আজ দুদিন হল ঘরে চাল শেষ। কোনোদিন পুকুরের ধারের শাক তুলে এনে সেদ্ধ করে খেয়েছে। আবার লোকের পুকুরে চুপিচুপি নেমে গুগলি তুলে এনে কাজ চালিয়েছে একদিন। টুপুর ‘ভাত খাব, ভাত খাব’ করে পাগল করে দিচ্ছে। কোথায় পাবে সূর্যনাথ ভাত?

কয়েকদিন বৃষ্টিতে ভিজে আজ সূর্যনাথের ধুম জ্বর। সকালে সে বেরোতে পারেনি। দুপুরে বর-বউ দুজনেই উপোস করেছে। টুপুরকে দিয়েছে গতকালের বেঁচে থাকা দু-চারটে গুগলি। এবার রাতে কিছু তো খেতেই হবে। আর কোনও উপায় না দেখে বিকেলে শ্যামলী ছাতা মাথায় দিয়ে বেরিয়েছে খাবারের সন্ধানে। কিন্তু এখনো তো ফিরল না সে। এবার সূর্যনাথের একটু একটু চিন্তা হচ্ছে। এই দুর্যোগের সময়ে এত দেরি করছে কেন? যদিও মনে মনে সে জানে, খাবার পাওয়া অত সহজ নয়। তবুও চিন্তা তো হয়ই।

এদিকে টুপুর মাঝে মাঝেই ‘বাবা, খিদে পাচ্ছে’ বলে বায়না করছে। সূর্যনাথ যথাসম্ভব এটা-সেটা গল্প বলে তাকে ভুলিয়ে রেখেছে। কিন্তু গল্প ছাপিয়ে মাঝে মাঝেই চাগাড় দিয়ে উঠছে খিদে। সন্ধে ক্রমশ রাত হচ্ছে, তবু শ্যামলীর দেখা নেই। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে সূর্যনাথের। এত জ্বর যে মাঝে মাঝেই প্রলাপ বকছে। এই অবস্থায় বৃষ্টির মধ্যে ওইটুকু বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় যাবে সে?

এদিকে টুপুর আর খিদে সহ্য করতে পারছে না। পেট চেপে মাটিতে শুয়ে পড়ল। মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে চীৎকার করতে লাগল, “বাবা কিছু খেতে দাও, আর যে থাকতে পারছি না।” সত্যিই তো, এতটুকু মেয়ে আর কত খিদে সহ্য করবে?

ওই ঘোরলাগা অবস্থাতেও সূর্যনাথের দুচোখ ছাপিয়ে কান্না নেমে এলো। ঘরে তার হজম করার, খিদে বাড়ানোর বস্তাভর্তি শিশির পর শিশি ওষুধ। কিন্তু খিদে কমানোর একটা ফোঁটা ওষুধ নেই। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সূর্যনাথের কেবলই মনে হতে লাগল, সাধুবাবা যদি খিদে মেটানোর একটা গাছের সন্ধান দিয়ে যেতেন!

ঘোরের মধ্যে সে বলতে লাগল, “সাধুবাবা… গাছ… ওষুধ…”

শেষের ‘ওষুধ’ কথাটুকু ঠিক শুনে নিয়েছে টুপুর। কান্না থেমে গেল তার। টুপুরের মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা। বাবার বানানো ওষুধ সে আগে খেয়ে দেখেছে, বেশ খেতে। ওই তো ঘরের কোণে বস্তাবন্দী শিশির পর শিশি ওষুধ। সূর্যনাথের কাছে এসে টুপুর জিজ্ঞাসা করল, “খুব খিদে পাচ্ছে বাবা। একটু ওষুধ খাব?”

সূর্যনাথ তখনও প্রলাপ বকছে, “সাধুবাবা… গাছ… ওষুধ…”

টুপুর খিদের জ্বালায় মনকে বোঝাল, ওই তো বাবা নিজেই ওষুধের কথা বলছে। তাহলে এখন একটু খাওয়াই যায়! সূর্যনাথ এখন সেই অবস্থাতেও নেই যে টুপুরকে বারণ করবে খালি পেটে ওই ওষুধ খেতে। শিশিভর্তি বস্তাটাও যেন ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বলছে, “টুপুর, খাবি না? দ্যাখ, শিশি ভরা রাশি রাশি খাবার! শুধু তোর জন্যেই অপেক্ষা করছে! আয় মা, কাছে আয়।” পেটভর্তি হাঙরের খিদে নিয়ে ওই হাতছানি আর উপেক্ষা করতে পারল না সে। ধীরে ধীরে পা বাড়াল ওষুধের বস্তার দিকে।

 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ