ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

সর্বংসহা - কুহেলী দাশগুপ্ত

 

ভরা বর্ষার জলে স্নাত শরীর মুছে সেজে ওঠে মেয়ে।  সবুজ জমিনের শাড়ি জড়িয়ে তেরঙা আঁচল উড়িয়ে দেয় সে। সাদা মেঘে ঢাকা আকাশের মতো প্রশস্ত কপালে অরুণ রাঙা টিপখানি জ্বলজ্বল করে।
চির যুবতী সে। হাওয়ার দাপটে আঁচল তার উড়তে  থাকে পতপত করে। চারদিকে কত  সাজো সাজো রব! গান, কবিতা, গল্পের  ভীড়ে  চাপা পড়ে থাকে তার কষ্ট গুলো। রূপ, লাবণ্যে চিরকাল সে অপরকে মোহিত করেছে, আকৃষ্ট করেছে।  তার অপরূপ শোভা কি বার বার ক্ষত বিক্ষত হওয়ার কারণ হয়েছে! অনেক গুলো বছর পেছনে ফেলে এসে ও তার সৌন্দর্যে  ভাটা পড়েনি। লোভী লোলুপ কামনার শৃঙ্খলে সে বার বার বন্দি হয়েছে। সম্পদে, প্রাচুর্যে স্বয়ংসম্পূর্ণা ছিল বলেই কি বন্ধু বেশে এসে শত্রুর মতো লুঠতরাজ চালিয়েছে সুযোগসন্ধানীরা ! অসীম ধৈর্য্য আর সহ্য শক্তির অধিকারী  সে। এতো অন্যায়অপমানকে নীরবে সয়েছে, ক্ষমা করে দিয়েছে। এ পূর্ণ যুবতী আসলে রত্নগর্ভা।  মনি মাণিক্যের চেয়ে তার গুনী সন্তানদের সে আগলে রাখতে চেয়েছে চিরকাল।  এরাই যে তার গর্ব। গুনী সন্তানদের গর্বে তার মাতৃত্ব মহিমান্বিত হয়। বহিরাগত শত্রুর আক্রমণে একে একে বীর সন্তান হারানোর যন্ত্রনা সয়ে চলেছে সে। হারানোর ক্ষত সামলে আবার জেগে উঠেছে বীরত্বের গরিমা। শুধু ভাগের মা হওয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। জাতপাতধর্ম নির্বিশেষে সকল সন্তানদের জঠরে লালন করার পর কোন মা কি ভেদাভেদ মানতে পারে! দেশভাগ, বঙ্গভঙ্গ তার হৃদয় চিরে এফোড় ওফোড় করে দিয়েছে। হ্যাঁ, সে যে ভারতমাতা।  এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারিনী ছিল। ব্রিটিশ শাসন শুধু তাকে লুটে নেয়নি, ভেদাভেদের বীজ বপন করে পিছু হটেছে।  দেশমাতা সে। সয়ে নিয়েছে সবটা।   জ্ঞানী, গুনীদের সাথে চাষী, শ্রমিকমজুর এরাও যে তার সন্তান।  অভাগাদের জন্য মায়ের মন কেঁদে ওঠে। কেন এরাই বারংবার নিপীড়নের শিকার হয়!পেটে ক্ষিদে নিয়ে জমিতে কষ্টের ফলানো ফসলে ভাগ জোটেনা।
স্বাধীনতার  এতো বছর পর ভালো আছে কি তার কৃষক সন্তানেরা!
সন্তানদের মাঝে অনৈক্যবিভেদ কোন মা সইতে পারে! ভিন্ন  ভিন্ন ভাষাভাষী সন্তানদের বুকে লালন করে চলেছে সে। জাত, ধর্মের রীতিনীতিতে বিভেদ  থাকবে। তবুও,
"বিভেদের মাঝে দেখো মিলন মহান"-এমন শিক্ষাই তো হওয়া উচিত। বীর সন্তানদের আত্ম বলিদানে অর্জিত স্বাধীনতা।  ৭৫বছর পার করল! অবাক হয় সে। হৃদয়ের ক্ষত আজও দগদগে হয়ে আছে। অন্তর্কলহের বলিতে তার অঙ্গহানি হয়েছে। সীমান্তে জেগে পাহারা দেয় বীর সেনানীরা। দেশ রক্ষার বলি হয়ে ফেরা সন্তানদের মা তেরঙা আঁচল জড়িয়ে হৃদয়ে লালন করেন।   নিরব কান্না তাকে গিলে নিতে হয়। মা কে যে ভেঙে পড়তে নেই , সয়ে নিতে হয় সকলের মঙ্গল কামনায়। নির্যাতনের শিকার শিশু, নারীদের রক্ষা করতে না পেরে অসহায় বোধ হয় তার। চেয়ে দ্যাখে সর্বাঙ্গে তার ক্ষত। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায় তার মন। এই অনাচার সহ্য করা!এতো মাতৃত্বের চরম অপমান!  পাহাড়ের গায়ে ঝর্ণা হয়ে বিগলিত হয় তার জমানো কষ্ট। নদীর মতো বয়ে নিয়ে চলে কর্দমাক্ত পিছল পথের ক্লেদ।  কখনো সমুদ্রের গর্জনে ফুঁসে ওঠে। আর কেন? মায়ের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে কি অনুশোচনা আসে না সন্তানের!
সহ্য গুনের আর কত পরীক্ষা দিয়ে যাবে সে? চিৎকার করে বলতে চায় সে,
--স্বাধীনতার বিশেষ কোন দিন হয় না। শুধু দেশ ভাবনার  প্রকাশ, পতাকা  উত্তোলন আর উৎসব পালনেই কি স্বাধীনতার মানে! তার ছেলেরা মুটে,মজুর, ঝাড়ুদার,মেথর হয়ে মায়ের সেবা করছে। চাষিরা সারাটি বছর ধরে সকলের অন্ন, আহারের যোগানে পরিশ্রম করছে। এতো সেবা দিয়ে ও সকলে কি পেটে ভাতে রয়েছে! অনাহারে ,কষ্টে থাকা সন্তানদের দেখে মায়ের মুখে গ্রাস ওঠেনা। কে ভাবছে রক্তাক্ত মাতৃভূমির কথা!বীরেশ্বরকে আজ বড় বেশি প্রয়োজন।  যুব শক্তিকে জাগিয়ে তোলার উদ্যম নিয়ে সে এগিয়েছিল। নারী শিক্ষার বার্তা দিয়েছিল।  ভ্রাতা ভগিনী সম্বোধনে বিশ্ববাসীর চোখে মাতৃভূমির জন্য সম্মান জাগিয়েছিল। এমন আন্তরিক কেবল ভারতবাসীই হতে পারে।
পূর্ব, পশ্চিমউত্তর, দক্ষিণ যেদিকে চোখ যায় এই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য।  এই সৌন্দর্যের টানেই বিশ্ববাসী ফিরে ফিরে আসে পর্যটনের হাত ধরে। এতো রূপ নিয়েও কন্যের ব্যথা ভরা মন।
  এইতো সেদিন সীমান্ত রক্ষাকারী এক শহীদের বাড়ির পাশে যেতে গিয়ে দেখেছে পলেস্তারা খসে পড়া বাড়িতে একাকী মা। এখনও চোখের  জলে ভাসেন।  কন্যাসমা সদ্য  বিধবা বধূমাতাটিকে নতুন সংসার পেতে দিয়েছেন।  ছেলে হারানোর ব্যথা ভোলার নয়। তাই বলে আরেকটি জীবন তিনি অকালে বয়ে যেতে দেননি। ছানি পড়া চোখে ছেলের ছবিতে হাত  বুলিয়ে চোখ মোছেন। স্বপাক আহারে দিন কেটে যায়।

    অশ্রুসজল চোখে বাস্তুহারাদের কাছে যান। উদয়অস্ত দিনাতিপাত করে ও ঠাঁই হীন যাপনের কাল তাদের। সরকারী অনুদানে কোনভাবে ক্ষুধা নিবৃত্ত হয় পরিবার  পিছু আট দশটি উদরে।
      দৃঢ় চিত্তে কঠোর হওয়ার কথা ভাবে কন্যে। একাধারে মা ও যে সে।
কোন অজানা গাঁয়ে বেড়ে উঠেছিল মেধাবী ছেলেটি। আধপেটা খেয়ে ও চোখে স্বপ্ন।  সরকারী চাকরি পেয়ে পরিবারের পাশে থাকা। দিনরাত সেই  উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে চলা। বছর ভর নানা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও পিছিয়ে থাকে সে। স্বজন পোষণে শূণ্য পদ ভরে যায়।কখনো বা অর্থের বিনিময়ে। পরাজিত সৈনিকের মতো ফিরে যায় সে। বিবাহযোগ্যা বোনের বিয়ে, ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা সব যে থমকে যায়! অক্ষর পরিচয় হীন মা বাবা কে বোঝানোর  ভাষা নেই  তার। কেবল জিজ্ঞাসার মুখে দাঁড়িয়ে সে। এ জীবনে বেঁচে থাকার অবলম্বন হারিয়ে যায় যেন!
বিধ্বস্ত মনে রেলপথ ধরে হাঁটতে থাকে। শ্যামল বর্ণা ব্যথিত হৃদয়ে বাধা দিতে চায়।
--ও ছেলে, এখনই জীবনে ইতি টেনো না। অপেক্ষার মূল্য ঠিক পাবে।
পরিজনদের বড় প্রয়োজন তোমায়।
একটা দমকা হাওয়া বয়ে যায় হঠাৎ। অসহায় মা , বাবা, ভাই বোনের কথা মনে আসে। সজল চোখে বাড়ির পথ ধরে সে।

চারদিকে যা কিছু হয়ে চলেছেএরই নাম কি স্বাধীনতা! সন্তর্পনে এগিয়ে যায় কন্যে লাঞ্ছিত মেয়েটির খোঁজে। ক্ষমতার ছত্রছায়ায় অপরাধ আড়াল হয়ে যায়। অর্থের অভাব, সামাজিক প্রেক্ষাপট, ক্ষমতাসীনের চোখ রাঙানি লাঞ্ছিতার পরিবারকে সুবিচারের পথে যেতে দেয় না। মৃতপ্রায় মনে শরীর কেবল খেয়ে পরে বাঁচে, শ্বাস নেয়।
    দুঃখিত মনে দেশমাতা ফিরে যান। ভাবেন, কি ভুল তার! দিনের পর দিন এই অনাচার  সয়ে চলেছেনএটাই কি তার ভুল! সমাজের অব ক্ষয় ঘা, পাঁচড়ার মতো শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। বীর সন্তানটিকে মনে পড়ে মায়ের। কতকাল সুভাষের কোন খোঁজ নেই! একাধারে নির্ভীক ও সুযোগ্য। উদ্যমী  নায়কের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা ছিল। দেশনায়কের আসনে এমন দেশপ্রেমীকেই মানায়। হঠাৎ তার হারিয়ে যাওয়া যেন মাটির বাঁধনকে আলগা করে দিয়েছে! ও যে নিঃস্বার্থ মনে দেশ ও দশের কল্যাণ ভেবেছিল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কন্যে এগিয়ে চলে।

পাহাড়ের পথে চলতে চলতে প্রত্যন্ত কোন গাঁয়ে মন পড়ে থাকে তার।যেখানে পানীয় জলের সংস্থান নেইবিদ্যুতের ব্যবহার কি তা জানতে পারেনা। খানা খন্দে ভরা রাস্তা।পিচ ঢালা পথ কেমন হয় তারা জানেনা।
কেউ কি তাদের কথা ভাবে না! শহুরে আরামপ্রিয় শরীর  ভাবতে ও পারবে না, অস্থিচর্মসার এই মানুষগুলোর জীবন কতটা দুর্বিসহ। পাক দন্ডী বেয়ে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়ায় কন্যে। সজোরে গলা ছেড়ে দেয়।
--তোমরা শুনছ! সকল দেশবাসী সন্তানেরা।  আমি দেশমাতা বলছি। এতোকাল ধরে অনেক সয়েছি। তোমরা এগিয়ে এসো, মাটির টানে,দেশের প্রয়োজনে। নিঃস্বার্থ হওয়ার ব্রত নিয়ে চলো। প্রতিটি সন্তানদের স্থান আমার  হৃদয়ে। সকলের সম্প্রীতিতে দেশ এগিয়ে যেতে পারবে। জাত,ধর্মধনী, গরীব ভেদাভেদের উর্ধে গিয়ে মানবিকতার বিকাশ ঘটানো প্রয়োজন। এগিয়ে এসো যুব সমাজ । আজ তোমাদের বড় প্রয়োজন।  সকলে খেয়ে পড়ে বাঁচবে, শিক্ষার আলোতে পথ চলবে-এই ব্রত নিয়ে এগিয়ে এসো। প্রতিটি  নারী আমার অংশ। লাঞ্ছনা, অবমাননা বন্ধ হোক । সংকীর্ণ মানসিকতার করাল গ্রাস হতে নিজেদের মুক্ত করে বেড়িয়ে এসো।
পাহাড়ের দিকে দিকে মায়ের আকুতি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। কোথাও কেউ  নেই।  মায়ের আর্তি, বেদনা মিলে মিশে বাতাস ভারী হয়। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ