ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

৯০-র দশকের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের দলিল- ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ -পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

 ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ by Sunil Gangopadhyay

 

  • বই – ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ
  • লেখক – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
  • প্রকাশক – আনন্দ পাবলিশার্স
  • প্রকাশকাল – এপ্রিল, ১৯৯১
  • পৃষ্ঠা – ১১৭
 
 
বর্তমানে চরম অশান্ত পৃথিবী। নীল গ্রহের মানুষ প্রায় দ’বছর অতিমারির মৃত্যুমিছিলের ভয়াবহতা কোনোমতে কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছিল। তার মধ্যেই শুরু হয়ে গেল এক রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধ। যুদ্ধ - তা যে কারণেই হোক না কেন - সমর্থনযোগ্য নয় কখনোই। দুই দেশের সর্বময় নেতৃত্বের মাঝের বিবাদের পরিণতিতে প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ নিরীহ মানুষের। যুদ্ধের এটাই তো নিয়ম। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। বিদ্বজনেরা আরও একটি বিশ্বযুদ্ধের আবছা মেঘ দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠছেন। কোল্ড ওয়ারের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে পরপর ধাক্কা সামলে স্বাভাবিক জীবন ধারণে। এই পরিস্থিতিতে আজ একটা বইয়ের কথা বড় বেশী মনে পড়ছে। 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা “ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ”। বিগত শতাব্দীর আরেকটি কোল্ড ওয়ার পরবর্তী সময়ের জীবন্ত দলিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার প্রিয়তম লেখক। তাঁর রচিত অন্যান্য সমস্ত অসাধারণ সামাজিক উপন্যাসের মত ভ্রমণ কাহিনী লেখাতেও তিনি সমান মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন এই বইতে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো সম্পর্কে খুব অল্প কথায় জানতে অতুলনীয় একটি বই। লেখক জার্মানী থেকে শুরু করে, পোলান্ড, হান্গেরি, রুমানিয়া, রাশিয়া অনেক দেশই ঘুরেছেন। মিশেছেন তাদের মানুষের সাথে, কথা বলেছেন, বুঝতে চেয়েছেন তাদের অন্তরের ব্যথা, মানসিক পরিবর্তনের ধাপগুলো। বইয়ের শুরুতে লেখক লিখেছেন – 

দেওয়াল দিয়ে ভাগ করা হল দুই জার্মানিকে। একদিকে সমাজতন্ত্র, অন্যদিকে ধনতন্ত্র। সমাজতন্ত্রী নেতাদের কাছে ধনতন্ত্র অতি কুৎসিত, দুর্গন্ধময়। নিছক ভোগ্যপণ্যের আড়ম্বর দেখিয়ে চোখ ধাঁধানো। ইতিহাসের ভবিষ্যৎ গতি সমাজতন্ত্রের দিকে, মানুষের সুখ, স্বপ্ন, শান্তি সেই ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত। বেশ তো, মানুষকে তা বোঝালে মানুষ নিজের ভালো নিশ্চয়ই বুঝবে। কিন্তু কেউ যদি না বুঝতে চায়, তা হলে কি তার ঘাড় ধরে, হাত-পায়ে শিকল বেঁধে কিংবা বুকের সামনে বন্দুক উঁচিয়ে বোঝাতে হবে? কেউ যদি পূর্ব ছেড়ে পশ্চিমে যেতে চায়, তাকে গুলি মেরে ঝাঁঝরা করে দিতে হবে? নিজের বাসস্থান নির্বাচনের স্বাধীনতাও মানুষের থাকবে না।“  

১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর ঐতিহাসিক বার্লিন প্রাচীর ভাঙ্গার ঐতিহাসিক মূহুর্তে, দুই জার্মানী একীভূত হবার সেই আবেগের স্রোতকে প্রত্যক্ষ করার জন্য লেখক স্ববান্ধবে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যক্ষ করেছেন সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তকে, সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে সেই স্থানের সাধারণ জনজীবনে ঘটনার প্রভাবকে। সেখান থেকে যাত্রা করে হান্গেরি পৌছে এয়ারপোর্টের তিক্ত অভিজ্ঞতা, তারপর ঐতিহাসিক ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে হান্গেরি থেকে রুমানিয়া ভ্রমণ, রুমানিয়ার আর্থিক দৈন্যদশা, যুদ্ধ বিদ্ধস্ত পোলান্ডের ঘুরে দাঁড়ানো, সাধারণ মানুষের ঐক্য, সোভিয়েত ইউনিয়নের টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া, রাশিয়ায় বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব সবই এক অসাধারণ বর্ণনায় লেখক পাঠককে মুগ্ধ করেছেন। পড়তে পড়তে মনে হয় যেন সেই সময় আমিও ওইখানেই উপস্থিত ছিলাম, এতই প্রাঞ্জল সেই বিবরণ, এতই সুন্দর সেই অভিজ্ঞতার দৃশ্যায়ন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে ক্ষমতার পালাবদলে পূর্ব ইওরোপের দেশগুলোর সাধারণ মানুষের মাঝে যে পরিবর্তন ও প্রতিক্রিয়া ঘটেছিলো, তা অনবদ্যভাবে লিখেছেন লেখক। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আড়ালে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত আশা আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা, স্বপ্ন সব কিভাবে ভঙ্গে চুরমার হয়ে যায় তাও লেখক বর্ণনা করেছেন এই বইতে। কিন্তু এই যুদ্ধ বা রাজনৈতিক উত্থান পতন বা দেশের বড় বড় কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষ তথা শিশুদের মনেও যে প্রভাব বিস্তার করত তার উদাহরণ দিয়েছেন ছোট ছোট গল্পের মাধ্যমে। যেমন একটি বলি -  

"কলা নিয়ে পশ্চিম বার্লিনে একটা মজার গল্প চালু আছে। এটাকে গল্প হিসেবেই গণ্য করা উচিত।
পাঁচিল তোলার পর পূর্ব ও পশ্চিমের দুটো বাড়ি একেবারে মুখোমুখি। দুটি বাড়িতেই একটি করে বাচ্চা মেয়ে থাকে, তারা জানলা দিনে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে। একদিন পশ্চিমের মেয়েটি একটি ইলেকট্রনিক খেলনা দেখিয়ে বলল, এই, তোদের এটা আছে? পূর্বের মেয়েটি একটা সুন্দর পুতুল তুলে ধরে বলল, ওটা না থাকলে কী হয়, আমাদের এত সুন্দর পুতুল আছে। পশ্চিমের মেয়েটি এক জোড়া নতুন জুতো দেখিয়ে বলল, তোর আছে? পূর্বের মেয়েটি একটা কারুকার্য করা লেসের স্কার্ফ দেখিয়ে বলল, তোর এটা আছে? এইভাবে দুটি মেয়েই নানারকম জিনিস তুলে তুলে দেখাতে লাগল। এক সময় পশ্চিমের মেয়েটি একটা পাকা কলা তুলে দেখিয়ে বলল, তোর কলা আছে? পূর্বের মেয়েটি কখনও কলা চোখেই দেখিনি। কলার বদলে অন্য কোনও ফলও দেখাবার মতন তাদের বাড়িতে নেই। সে তখন কাঁদো-কাঁদো হয়ে মাকে জিগ্যেস করল, মা, আমাদের কলা নেই কেন? মা বললেন, আমাদের কলা নেই তাতে কী হয়েছে, আমাদের কমিউজিনম আছে। পূর্বের মেয়েটি সে কথা জানাতেই পশ্চিমি মেয়েটি একটু দমে গেল। কমিউনিজম কী তা সে জানে না, বাড়িতে তার মা-বাবা কেউ নেই তখন, জিগ্যেসও করতে পারছে না। কিন্তু সে পশ্চিমি কনজিউমার সোসাইটির মেয়ে তো, সে জানে, পয়সা থাকলে সব কিছুই কেনা যায়। তাই সে বলল, ঠিক আছে, আমার বাবাকে বলব, আমার জন্যও কমিউনিজম কিনে দেবে? তখন পূর্বের মেয়েটির মা মেয়েকে বলল, তুই ওকে বলে দে, ও যদি কমিউনিজম কেনে, তা হলে কিন্তু আর কলা পাবে না!"


সমগ্র বই জুড়ে আছে এই রকম ছোট বড় গল্প ও অভিজ্ঞতা। সমাজতন্ত্র নামে একটি অপার্থিব স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। সেই স্বপ্নে ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির একটি স্থির চিত্র আঁকা ছিল- ছিল এক মহান আদর্শ যা শেষ অবধি কোথাও সফল হতে পারেনি। সমাজতন্ত্রের দেখানো সেই স্বপ্নই ভঙ্গ হয়ে গেছিল রাজনৈতিক কূটনীতিক মতোবিরোধে। সেই স্বপ্নভঙ্গের মাধ্যে থেকেই আবার তৈরি হচ্ছিল নতুন স্বপ্ন দেখার- যার প্রতিচ্ছবি লেখক দেখেছিলেন সেদিন, যা দেখানোর চেষ্টা করেছেন পাঠককুলকে। এক বিখ্যাত ঐতিহাসিক মুহূর্তের জীবন্ত দলিল এই বই, যা বাংলা সাহিত্যের ভ্রমণ কথা তথা রাজনৈতিক ভ্রমণ কাহিনীর ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।  





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ