বছর বাইশ আগে 'পারমিতার একদিন'
নামে
একটি ছবি দেখেছিলাম। ওই সিনেমার এক শাশুড়ি এবং বউমা জোড়ের চরিত্র-চিত্রণ এমনভাবে
করা হয়েছিল যেন দুই বন্ধু। এমন বন্ধু যে, চানের ঘরে বৌমা শাশুড়ির পিঠ ঘষে
দিচ্ছে। ওই ছবি দেখে আমার মনে হয়েছিল এ 'কষ্টকল্পিত'। এদিকে ছবি
বক্স অফিসে দারুন হিট্। আর আমার উপরোক্ত অভিমত শুনে আমাকে পরিচিতজনরা 'রে
রে' করে তেড়ে এলেন। সে যাত্রা কোন রকমভাবে বেঁচেছিলাম। চাইছিলাম- সত্যিই
যদি আমার অনুধাবন ভুল হ'ত!
এদিকে হালের 'বেলাশুরু' নামক একটি বাংলা
সিনেমায় অ্যালঝাইমার্স বলে একটি বিশেষ রোগের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা
হয়েছে দেখছি। এই রোগটি কিন্তু নতুন কিছু নয়। রোগটি ছিল, আছে এবং থাকবে।
১৯০১ সালে একজন
জার্মান সাইকিয়াট্রিস্ট অ্যালয় অ্যালঝাইমার (Alois Alzheimer) প্রথম
একটি ডিমেনসিয়া পেশেন্টকে সনাক্ত করেন এবং তার নাম অনুসারে এই রোগটির নামকরণ হয়।
সেই থেকে আজ অবধি অ্যালঝাইমার্স ডিসিস নিয়ে অনেক গবেষণামূলক কাজ হয়েছে এবং রোগটি
সম্বন্ধে বিস্তর তথ্য আবিস্কৃত হয়েছে। প্রথমত এটি একটি ক্রনিক নিউরো ডিজেনেরেটিভ
ডিসিস অর্থাৎ ধীরে ধীরে ব্রেন শুকিয়ে যাবার রোগ- যার জন্য মূলত ডিমেনসিয়া বা
স্মৃতিভ্রংশ এবং অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়। স্মৃতিভ্রংশের রোগের মধ্যে এটি অন্যতম
প্রধান রোগ এবং বর্তমানে অসংখ্য মানুষের মধ্যে এই রোগটি বিদ্যমান।
শুনেছি ষাট বছরের ঊর্ধ্বের মানুষের মস্তিষ্কের কোন বিশেষ অংশের কোষগুলো যখন
বয়সের সাথে সাথে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে তখন এক আশ্চর্য রকম স্মৃতিবিভ্রম ঘটে। তার
ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির কোন বিশেষ পর্যায়ের স্মৃতি একেবারে লোপ পায়।
আমার
এক জ্যেঠাইমা নিজের ছোটবেলার ঘটনা মনে করতে পারতেন, কিন্তু নিজের
বিবাহোত্তর কোনো ঘটনাই মনে করতে পারতেন না। হেঁটে চলে বেড়াতেন, কিন্তু
মাঝে মাঝেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথ হারিয়ে ফেলতেন। ছোট জায়গায় অনেকের জানাশোনা
থাকায় লোকেরা জ্যেঠাইমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যেত।
আমার
শাশুড়ি মার বয়স এখন সাতাশি। উনার বাড়ি ছিল অবিভক্ত বাংলার নোয়াখালী জেলার
শ্রীরামপুরে।আজ বার্ধক্যজনিত অ্যালঝাইমার্স রোগে উনার অদ্ভুত এক স্মৃতিভ্রংশ
হয়েছে। উনি বলেন ওর দশ বারো বছর বয়েসে অর্থাৎ দেশভাগের হয়ত কিছু আগে ওরা
নোয়াখালীর বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন এই বাংলার নবদ্বীপে। নোয়াখালীতে উনি পড়তেন বঙ্গ
বালিকা বিদ্যালয়ে। উনারা ছিলেন নোয়াখালীর কোন জমিদার বংশ, 'নাগ
রায় পরিবার'।
আরো
আশ্চর্য হল আমার শাশুড়িমা-রা নবদ্বীপে চলে আসার পরের ঘটনা, নিজের বিবাহ,
স্বামী,
স্বামীগৃহের
কথা, কন্যাজন্ম ইত্যাদি ঘটনা তেমন আর উনার স্মৃতিতে আসে না। উনি নিজের
মেয়েকেই চিনতে পারেন না। যদিও বা শুনে চিনতে পেরেছেন এমন সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন,
কিন্তু
পরক্ষণেই বিস্মৃতিতে ডুবে যান। কিন্তু সেই বাংলার নোয়াখালীর শ্রীরামপুর, বঙ্গ
বালিকা বিদ্যালয়ের কথা আজও তিনি বলে চলেন। তাই আমার শুধু মনে জাগে সেই বিখ্যাত
গানের কলি,---
'সব ভুলে যাই, তাও ভুলি না
বাঙলা মায়ের কোল।'
কিন্তু উপরোক্ত ঐ ছবিতে যেভাবে নানা ধরনের ঘটনার ঘনঘটায় অ্যালঝাইমার্স
রুগীর স্মৃতি ফেরানোর উপায়ের সন্ধান করা হয়েছে, তা আমরা যারা
রোজকার ভুক্তভোগী তাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে কি? মেলে না। এই সব
ছবিগুলো বক্স অফিসে রমরমা হয়ে চলছে দেখে বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ভেবে পুলকিত
হই। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথেই শেষের সে দিনের সম্ভাব্য পরিণতির আশঙ্কায় মনটা
বিষাদে ভরে ওঠে।
আমাদের পাড়ায় এক পরিবার ভাড়া এসেছিলেন কিছুদিনের জন্য। পাশের পাড়ায়
ওদের বাড়ি ভেঙ্গে ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছিল, তাই প্রোমোটার ওদের ভাড়া বাড়ির
ব্যবস্থা করেছিল। ওবাড়ির বৃদ্ধ ভদ্রলোককে দেখতাম সর্বক্ষণ বিমর্ষ হয়ে থাকতেন।
বাড়ির লোকজন বলত উনি নাকি অ্যালঝাইমার্সে আক্রান্ত। কোন কোন সময় উদ্ভ্রান্তের
মতন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। একদিন আমি উনার অমন অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস
করলাম,--- 'মেসোমশাই, কি খুঁজছেন?
কোথাও
যাবেন?'
উনি খুব চিন্তিত হয়ে উত্তর
করলেন--"আসলে আমার একটা বাড়ি ছিল
জানো? কোঠাবাড়ি -- নিজের বানানো,-- কিন্তু ওই
বাড়িটা না আর খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি একটু খুঁজে দিতে পারো?"
সেই
বাড়িটিই তো আজ আর নেই, তাই তার খোঁজ দেওয়াই বা যাবে কিভাবে? তবে
এইটুকু বুঝলাম যে উনার সমস্যা অ্যালঝাইমার্সের থেকে বেশি কিছু।
আমার নিজের একটি উপলব্ধি হল এইসব বৃদ্ধবৃদ্ধাদের শুধু প্রয়োজন সংবেদনশীল
মনের একটু সহানুভূতিশীল সাহচর্য। একাকীত্ব তাঁদের কষ্ট বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। আর
এধরণের সিনেমাগুলো কিন্তু কোথাও দর্শকদেরকে তাঁদের অব্যক্ত বেদনার সাথে একাত্ম হতে
সাহায্য করে। তাই বলি, এরকম সিনেমাগুলো কষ্টকল্পিত হলেও মানুষের
সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশেই সাকারাত্মক।
0 মন্তব্যসমূহ