ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

অচিন পাখি -সব্যসাচী হালদার

 


নতুন জামা পড়ে বছর সাতেকের বাচ্চাটা মাকে তার বন্ধুদের নতুন জামা দেখাতে যাচ্ছে বলে ছুটে বেড়িয়ে যায় বাড়ি থেকে। এতোদিন বাচ্চাটার মন খারাপ ছিল খুব। তার সব বন্ধুদের নতুন জামা হয়েছে। রোহানের তো আবার তিনটে জামা হয়েছে এই বছর। তবে সে জানে, রোহানরা বড়ো লোক, মা বলেছে। তাই সে তিনটে জামা চায় না। একটা জামা কিনে দিলেই হবে। মা কে বলেছিল একদিন। কিন্তু মা বলেছে —"আমরা গরিব মানুষ, কোথায় পাবো বাবা নতুন জামা কেনার টাকা। এই পয়লা বৈশাখটা যাক, আসছে দুর্গাপুজোয় নতুন জামা কিনে দেবো"। শুনে তো খুব খুশি হয়েছিল বাচ্চাটা। তবুও একটু একটু মন খারাপ তো করে তার। সব বন্ধুরা গতকাল তাদের বাবার সাথে চড়কের  মেলা দেখতে গিয়েছিল। সে যেতে পারেনি। কারণ তার বাবা তো বাড়িতেই থাকে না। বন্ধুরা তাকে বলেছে তার বাবা নাকি সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেছে। আর কোনো দিন আসবে না। বিশ্বাস করেনি বাচ্চাটা।

মাকে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল সে। মা বলেছে ওদের কথা না শুনতে। বাবা খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে। আর আসার সময় তার জন্য অনেক খেলনা, বড়ো বড়ো গাড়ি, কাঠের বর-বউ সব কিছু নিয়ে আসবে। পল্টুর মতো একটা বড়ো বাস কেনার খুব ইচ্ছা তার। পল্টু ওটা নিয়ে কোনো দিন খেলতে দেয় না তাকে। তাই সে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে, বাবা তার জন্য গাড়ি নিয়ে এলে পল্টুকেও দেখিয়ে দেখিয়ে খেলবে- একদম হাত দিতে দেবে না। যদিও বাবাকে সে কোন্ ছোটো বেলায় দেখেছে। ঠিক করে মনে করতে পারে না বাবার মুখটা। এখন সে অনেক বড়ো হয়ে গেছে। সাত বছর বয়স তার। সে ভেবেই রেখেছে এবার বাবা বাড়ি এলে বুল্টু কাকার দোকানে গিয়ে বাবার কোলে করে একটা ছবি তুলে রাখবে রোহানদের মতো। তাহলে বাবা যখন আবার কাজে চলে যাবে, সে বাবার মুখটা ভুলে গেলেও ছবি দেখে আবার ঠিক মনে করে নিতে পারবে।

 

তবে আজ পয়লা বৈশাখের দিনে বাচ্চাটার সব মনখারাপ ভালো হয়ে গেছে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখে দরজার সামনে তার জন্য নতুন জামা, মায়ের জন্য একটা সুতির ছাপা শাড়ি, এক প্যাকেট মিষ্টি কে যেন রেখে গেছে। নিজের নতুন জামা পেয়ে খুব খুশি হয়েছে বাচ্চাটা। সকাল সকাল স্নান করে, নতুন জামা পড়ে, মাকে মিষ্টি খাইয়ে প্রণাম করে নিজে চারটি রসগোল্লা খেয়ে বেরিয়ে পড়েছে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে। মা তাকে শিখিয়েছে পয়লা বৈশাখের দিন গুরুজনদের প্রণাম করতে হয়। তাই সে সেটাই করেছে। গুরুজন বলতে তার কাছে মা একাই। মা বলেছিল জ্যেঠি, জ্যাঠাকেও প্রণাম করে আসতে। কিন্তু সে যায়নি, কারণ জ্যেঠি শুধু মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে। তাই সে মাকে নতুন শাড়িটা পড়তে বলে খেলতে চলে গেছে। মিশে গেছে নতুনের রঙ লাগা দুপুরের রোদে খেলতে থাকা বাচ্চাদের মধ্যে।

 

বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মা তাকে হাঁকিয়ে বলেছে — "বেশি রোদে রোদে ঘুরবি না কিন্তু। তাড়াতাড়ি বাড়ি আসবি। আমাকে যেন খুঁজতে যেতে না হয়"।

ছেলের চিন্তার পাশাপাশি, বছর চব্বিশের শ্যামলা রঙা বউটার মনের মধ্যে আর একটা চিন্তা বার বার দোলা দিয়ে যাচ্ছে। ভগবান যেন নিজের হাতে করে গড়ে তুলেছে এই নারীকে। মাথায় পদ্মার জলের মতো কুচ কুচে কালো গোছা ভরা চুল। স্নিগ্ধ মুখশ্রী আর শেষ তুলির টানে ফুটে ওঠা টানা টানা চোখ। এত কিছুর পড়েও সৃষ্টিকর্তা হয়তো একটু দুধে-আলতা রঙে নিজের সৃষ্টিকে সাজাতে ভুলে গেছেন। যদি সেই রঙ পড়ত, তাহলে হয়তো সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হতো।

 

কিন্তু ওই অপার সুন্দর মুখশ্রীতে কপালের মাঝে বার বার ভাঁজ পড়ছে। ভাঁজগুলো অধীর আগ্রহে জিজ্ঞাসা করছে, কে দিয়ে গেল ওই নতুন জামা কাপড়গুলো?

তবে কি সে? নাকি অন্য কেউ, কোনো খারাপ মনোভাব নিয়ে এগুলো দিয়ে গেছে? নাকি কেউ রাতের অন্ধকারে দয়া করে গেছে তাদের। না না, দয়া হয়তো কেউ করেনি। কেই বা করবে দয়া ! স্বয়ং ভগবান যখন তাদের ওপর দয়া করেনি। তাহলে কোনো মানুষ কি ভাবে দয়া করতে পারে তাকে?

তাহলে হয়তো সেই মানুষটাই। যাকে সেদিন দুপুরের রোদে ছেলেকে ওপাড়ায় খুঁজতে গিয়ে দেখেছিল। একজন গেরুয়া পোশাক পড়া, মাথায় লম্বা চুল আর গাল ভরতি দাড়িওয়ালা সুপুরুষ সন্ন্যাসী। চোখাচোখি হয়েছিল তার সাথে। খুব চেনা মনে হয়েছিল চোখদুটো। যেন জন্ম জন্মান্তর এই চোখের মায়ায় সে আবদ্ধ। ভারী চেনা এই শারীরিক গঠন। বউটা কিছু কথা জিজ্ঞাসা করবে ভেবেছিল সন্ন্যাসীকে। কিন্তু সন্ন্যাসী তাকে দেখে এক মূহুর্ত দাঁড়ায়নি সেখানে। যেন এড়িয়ে চলে গেছিলো তাকে। তারপরও অনেক বার দেখেছে সে ওই সন্ন্যাসীকে। লক্ষ্য করেছে সন্ন্যাসী যেন দূর থেকে লক্ষ্য করে তাকে। বউটার মনের মধ্যে বিশ্বাস জাগে- উনিই হয়তো তার পতিদেব। সংসারের মায়া ছাড়তে পারলেও হয়তো সন্তানের মায়া সে ছাড়তে পারেনি। তাই যে কর্মে সে লিপ্ত হয়েছে, সেই কর্মকে সাথে নিয়েই ফিরে এসেছে সকলের অগোচরে পিতৃত্বের দায় পালন করতে।

কিন্তু তার দায় কে নেবে? মেয়েরা তো স্বামীর ভরসাতেই শ্বশুর বাড়ি আসে। কিভাবে পারলো সে, বিয়ের সাতপাকের বন্ধন ছিন্ন করে নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে ফেলে রেখে বৈরাগী হতে? এতো কি টান আছে বৈরাগ্যের পথে? আর আজ সে এসেছে চোরের মতো লুকিয়ে বউ ছেলের দায়িত্ব নিতে! বিয়ে মানে কি তাহলে শুধুই দায়িত্ব নেওয়া?

অথচ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তো বলেছেন- সংসারে থেকেও ভগবানের সাধনা করা যায়; লাভ করা যায় তার সঙ্গ। শুধু সাধার মতো সাধতে হয় ভগবানকে।

তাহলে কেন তাকে বিরাগী  হতে হলো?

আর সংসারের মায়া যখন ত্যাগ করতে পারেনি, সে-ই বা কেমন বিরাগী? মায়ায় পড়ে আছে যখন, কেন সে ফিরে আসছে না বৈরাগ্যভাব ত্যাগ করে? নাকি ইচ্ছা থাকলেও পারছে না! শুধু সমাজের চোখে সে আজ গেরুয়া পোশাক পড়া সন্ন্যাসী বলে? নিজের অজান্তেই অভিমানে চোখের কোণায় জল জমে আসে বউটার।

এসব ওসব ভাবতে ভাবতে সে যায় রান্না বসাতে। আজ পয়লা বৈশাখ। অনেক ভালোমন্দ রান্না করতে হয়। কিন্তু সে সামর্থ্য তার নেই। সে একটু পুটি মাছ কিনে এনেছে। সেটাই রান্না করবে আলু দিয়ে। রান্না শেষ হবে হবে, এমন সময় ছেলেটা খেলা শেষ করে চলে আসে মায়ের কাছে। বলে—"ও মা ভাত দাও, খিদে পেয়েছে"।

 

চোখের জল মুঝে রান্না শেষ করে, ছেলেকে নিজের কোলে বসিয়ে, নিজের হাতে খাইয়ে দেয় সে। মনের মধ্যে আজ একটা নিশ্চিন্ত ভাব খেলা করে বেড়াচ্ছে এটা ভেবে যে, ছেলেটা তাহলে আর পিতৃহীন নয়। দায়িত্ব নেওয়ার জন্য সমাজের অলক্ষ্যে হলেও তার বাবা আশেপাশেই আছে।

হঠাৎ ছেলেটা জিজ্ঞাসা করে, একি মা তুমি নতুন কাপড়টা পড়নি কেন?

পড়বো সোনা। কাল অবশ্যই পড়বো। কিন্তু ওই জামা-কাপড়গুলো কে দিয়ে গেছে বল্ তো? তোর বাবা দিয়ে গেছে সোনা।

সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটার মুখ দিয়ে একটা প্রশ্ন বেরিয়ে আসে—"বাবা দিয়ে গেছে যখন, আমাদের সাথে দেখা না করে চলে গেল কেন? "

 কোনো উত্তর দেয় না বউটা। চুপচাপ ছেলেকে কোলে বসিয়ে খাইয়ে যাচ্ছে সে।

খাওয়া শেষ হলে, ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে নিজে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। নতুন কাপড়টাকে শরীরে জড়িয়ে নিজেকে দেখতে থাকে সে। স্বামীর সোহাগমাখা শাড়িতে তার রূপ যেন অন্য মাত্রা পায়। বারবারই আয়নায় দেখতে থাকে নিজেকে।

তখনই যেন দূর থেকে ভেসে আসে কোন একজন বাউল  গাইতে গাইতে চলে যাচ্ছে —

  "খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়। তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি দিতাম পাখির পা-য়....."

মনের অজান্তেই চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে বউটার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ