উত্তরবঙ্গের মফঃস্বল শহরে বাবলু ঘোষদের তিন রুমের বাড়ীর একটি রুম তলাপাত্রদের ছোট পরিবারকে ভাড়া দেয়া। বাকী অংশে বাবলুর বিধবা মা, আর উনার একমাত্র ছেলে বাবলু। দু'দিন বাদেই বাবলুর বিয়ে। পূর্ববঙ্গীয় প্রথা মেনে মেয়ের বাড়ীতে আশীর্বাদও হয়ে গেছে। আজ বিকেলে বর-কনে দু'পক্ষেরই 'পানোখিলি' অনুষ্ঠান। মেঝেতে ছোট করে রঙিন আলপনা দেয়া বাবলুর ঘরে বিকেলে কয়েকজন সধবা মাসী-পিসী-দিদি-বৌদি জড়ো হয়েছে। তারা প্রত্যেকে কাঠি দিয়ে গেঁথে নিখুঁত পান বানিয়ে হবুদম্পতির জীবনে তদ্রূপ শক্ত বাঁধন কামনা করবেন। হিন্দুদের এধরণের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে বিধবাদের উপস্থিত থাকা নিষেধ বলে বাবলুর মা গোটা দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন প্রতিবেশী তথা তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া, প্রৌঢ়া সারদাদিদির উপর। স্থানীয় কাউন্সিলরের বৌ এই সারদা সরকারকে সবাই সমীহ করে- বিশেষতঃ পূর্ববঙ্গীয় যাবতীয় উৎসবাদিতে পালনীয় খুঁটিনাটি লোকাচারের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে।
লোকাচার মেনে অনুষ্ঠান থেকে মায়ের দূরে থাকাটা বাবলু মেনে নিয়েছে বটে- কিন্তু ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। ছেলেটা সম্প্রতি কেমন বেপরোয়া-টাইপ হয়ে গেছে! দেবদ্বিজে ভক্তি, গুরুজনদের প্রতি মান্যতা, উৎসবাদিতে বিধিনিষেধ মানা- সেসবের কোন বালাই নেই। শুধুমাত্র মাকেই তবু যা একটু মান্যিগণ্যি করে।
বাবলু কেন্দ্রীয় সরকারের একজন কেরাণী। চাকরীটা পেয়েছে এসএসসি পরীক্ষায় বসে- কোন নেতাফেতাকে না ধরেই। প্রথমদিকটায় কলকাতায় কাটিয়ে এখন নিজের শহরেই বদলি হয়েছে। মায়ের ভয় ছিল, পাছে ছেলে প্রেম করে অন্যজাতের বৌ এনে ঘরে তুলে; কেননা বরাবরই জাতপাত মানার বিরুদ্ধে খিস্তি করাই ছেলের দস্তুর! যাই হোক, শেষ অব্দি সামাজিকভাবেই মায়ের পছন্দে স্বজাতেই এই বিয়ে হচ্ছে; যদিও আলাপের পর পারস্পরিক পরিচয় ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই সবুজ সঙ্কেত দেয়া হয়েছিল।
২
পাশেই মায়ের ঘরটিতে মা-ছেলেতে নিভৃতে কথা হচ্ছিল। বাবলু মাকে রাগাবার ফন্দিতে বলে, "দেখো মা, পানোখিলি উপলক্ষে ঐ ঘরে যত লোক জড়ো করেছ, ছেলে-বৌ এর জন্যে পানের খিলিতে দেয়া অত শক্ত গিঁট ভবিষ্যতে আবার তোমাকেই না ছেলের থেকে আলগা করে দেয়"।
--- এক থাপ্পড় খাবি বদমাস; বলিনি বিয়ের ক'টা দিন কোন উল্টোপাল্টা কথা নয়?
--- আরে অত ভাবছ কেন? বিয়ের ব্যাপারে এ অব্দি তোমার কোন্ কথাটা না শুনেছি? আশীর্বাদের দিন মেয়ের বাড়ীতে নিজে গেলে না, খুড়তুতো মামা-মামীকে পাঠিয়ে কাজ সারলে। আজও তো "মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে বিধবাদের থাকতে নেই" বলে তোমার দূরে সরে থাকাটা মানতে আমাকে বাধ্য করলে। যাকগে, দূরে থাকো কিংবা কাছে, আমার মায়ের আশীর্বাদের চাইতে মঙ্গলদায়ী আমার জীবনে আর কিছুই নয়।
বাবলু মাকে আশ্বস্ত করে জড়িয়ে ধরে। মায়ের দু'চোখে যেন স্বপ্ন সফল হবার তৃপ্তি! এক সময় বাবলুর মনে হ'ল- ঐ ঘরে সবাই এতক্ষণ হ'ল এসে বসে আছেন; কিন্তু 'পানোখিলি'-র কাজটা তো শুরু হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না! বিষয়টা মায়ের কাছে বুঝতে চাইল সে। মা বোঝালেন- সারদাদিদি একটু আগে বলে গেছে যেহেতু কোন ব্রাক্ষণ-পরিবারের বৌকে প্রথম খিলিটা গাঁথতে হয়, তাই প্রতিবেশী অজিত ভট্টাচায্যির স্ত্রী মহুয়া ভট্টাচায্যির জন্যে অপেক্ষা করা হচ্ছে। বিকেল চারটেয় আসবেন বললেও এখন পাঁচটা অব্দিও তিনি আসেননি- কোন খবরও দেননি।
অজিত ভট্টাচায্যির নাম শুনেই বাবলুর সর্বসত্তায় তাৎক্ষণিক 'ইরিটেশন' শুরু হ'ল। "লোকটা তো কর্পোরেশনের অফিসার, শয়তানের ধাড়ী! ঘুষ খেয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তারই বৌকে… আমার বিয়েতে… কে ডাকল বলতো? ও, বুঝেছি, নিশ্চয় তোমার ওই সারদাদিদি"। বাবলুর মনে হ'ল- ঐ বাজে লোকটার স্ত্রীর জন্যে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে ঠিক সময়ে উপস্থিত হওয়া অন্যসব মা-মাসী-দিদি-বৌদিদের অপমান করা হচ্ছে। সে মাকে শুনিয়ে গর্জাতে লাগল- "ঐ বামনীর সময়জ্ঞান নেই বলে এদিকে সব্বাই ভুগবে নাকি?"
--- আঃ বাবলু! এসব মেয়েলি ব্যাপারে তুই কথা বলবি না তো- ওদেরটা ওদেরকেই বুঝতে দে।
--- শোন মা, আর পাঁচটা মিনিট দেখে নাও। তখনো ঐ বামনী না এলে উপস্থিতদের মধ্যে সবচাইতে বয়স্কা যে মহিলা, তাকে দিয়েই কাজটা শুরু করিয়ে দেবে বলছি। ওসব ব্রাক্ষ্মণ-ফ্রাক্ষ্মণ ফেলে রাখ। অন্যেরা সকলেও কিন্তু খুব ব্যস্ততা নিয়েই এখানে এসেছেন- অনেককেই তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরতে হবে। যেমনটি বললাম- পাঁচ মিনিটের মধ্যেই শুরু করিয়ে দেবে কিন্তু, নইলে... (বাবলু অতি কষ্টে রাগ দমায়)।
--- আচ্ছা, হবে 'খন। তুই নিজের বিয়েতে নিজেই মাথাটা গরম করছিস কেন বল্ তো? লোকে কি বলবে? একটু শান্ত হ বাবা।
৩
মা বাবলুকে চুপ করিয়ে দিল বটে; কিন্তু উনি ঠিক জানেন এই পাঁচ মিনিটে মহুয়া ভট্টাচায্যি এসে না পৌঁছলে ছেলের চোটপাটে একটা অনর্থ ঘটে যাবে। মা ঘরের দোর থেকে সারদামাসীকে ডেকে কি ইশারা করে বাইরে বারান্দায় এসে একা গেটের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরেই এ বাড়ীর ভাড়াটিয়া মমতা তলাপাত্র স্কুলের কাজ শেষে বাড়ীতে ফিরছিল। গেটে মুখোমুখি হতেই মা বলে উঠেন, "কিগো মমতা, স্কুল ছুটি হতে আজ দেরী হ'ল বুঝি?"
--- না মাসীমা! স্কুল তো রোজের মতোই একঘন্টা আগেই ছুটি হয়েছে। এই একটু বাবার বাড়ী হয়ে এলাম আর কি। (হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে) আচ্ছা, আজ আপনাদের পানোখিলি ছিল না? মঙ্গলমতে হয়ে গেছে নিশ্চয়?
--- নাগো, এই এখনই হবে। ওরা সবাই ও ঘরেই আছে। তুমিও হাতমুখটা ধুয়ে চলে যাও।
--- আমি? ... (ইতস্ততঃ ভঙ্গীতে) না, আমি আর যাই না মাসীমা। নিয়মের পাঁচজন সধবা তো নিশ্চয় এসেই গেছেন।
--- কিগো? তোমার কথাগুলি যেন একটু কেমন কেমন লাগছে? (মায়ের চোখেমুখে উদ্বেগ) সত্যিটা বল তো, সারদাদিদি তোমাকে পানোখিলিতে থাকতে বলেনি?
এই মমতা তলাপাত্র আসলে কাছেই একটা সরকারী স্কুলের গ্রুপ-ডি স্টাফ; স্বামী বিএসএফ এর এক জওয়ান- আসামে পোষ্টেড। মাঝেমধ্যে এখানে আসেন। বছরখানেক হ'ল মমতা একমাত্র ছেলে গুন্টুকে নিয়ে বাবলুদের বাড়ীতে ভাড়া থাকছে। বাচ্চাটা প্রায়ই এপাড়ায় মামার বাড়ীতেই কাটায়। মায়ের প্রশ্ন শুনে মমতা বলে উঠে, "ওসব নিয়ে আপনি কোন চিন্তা করবেন না মাসীমা, আমি ত বাড়ীরই একজন; আমাকে আবার আলাদা করে না বললেই কি?"
মা ঠিক বুঝে গেলেন। জিভ কেটে বললেন, "ছি, নিশ্চয় সারদাদিদি তোমাকে বলতে ভুলে গেছে। তুমি কিচ্ছু মনে কর না মা, আমার অবস্থা ত বোঝই, পরে পরে কারবার। আমি বলছি, তুমি হাতমুখ ধুয়ে এখনই ওই ঘরে চলে যাও। বাবলুর মমতাদি না থাকলে কিন্তু ছেলের এই অনুষ্ঠান পুরো হবে না বলে দিলাম"।
৪
ঠিক এমন সময় হঠাৎ একটা জোরালো কণ্ঠস্বর শুনে দু'জনেই পেছন দিকে ফিরে তাকায়। পূর্ববঙ্গীয় ডায়লেক্টে মাকে লক্ষ্য করে সারদাদেবীর বক্তব্য শোনা যায়:
--- আর কুনু চিন্তা নাইগো বইন, অইত্ত খাঁটি বাউন সামনেই দাঁড়ানো আছে। (তারপরই মমতার দিকে তাকিয়ে) এখন হুট্ কইরা আইসা পড় ত দেখি মমতা, প্রথম খিলিটা কিন্তু তুমিই দিবা ... ।
সুচতুর সারদাদেবী কখন যে মা-বাবলু-মমতার সব সংলাপ হৃদয়ঙ্গম করে এত দ্রুত নতুন এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, তা কেউ বুঝতেই পারল না! তার বাঙাল কথার ফোয়ারা যেন ঝরতেই থাকে: -
--- আরে, বাড়ীতেই যে বাউন ছিল সে ত আমার মাথায়ই আসে নাই। কিগো মমতা, তোমরা ত বাউনই। ক্যান যে মিছামিছি মহুয়ার লাইগ্যা এতক্ষণ বইসা থাকলাম! (হঠাৎই আবার বাবলুর মায়ের দিকে তাকিয়ে) বইন তুমি অ যে কি, একবার মনে অ করাইলা না?
মা অপরাধীর মতো আমতা আমতা করে বলল, "আ-আমি তো তোমাকে সব দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছিলাম দিদি …"। এমন সময় মমতাদি সারদাদেবীকে লক্ষ্য করে কিছুটা ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলে উঠে:
--- আর বা-উ-উন! ব্রাক্ষ্মণত্বের এখন কিছু বাকী আছে নাকি মাসী? গুন্টুর বাবা ত প্রায়ই বলে, পৈতেটা ফেলে দিয়ে বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট আর গুলির মালা পড়লে বর্ডারে ডিউটির সময় কাজে লাগত।
আপাত-নিরীহ মমতাদির তীক্ষ্ণ খোঁচাটা জায়গামতো গিয়ে কাজ করে। সারদাদেবীকে বলতে শোনা যায়:
--- হ, হ, বোঝা গেল (সারদামাসী কষ্টকল্পিত হাসি হাসে)। অখন আর গোসায় সময় নষ্ট না কইরা তাড়াতাড়ি চল ত দেখি মমতা। এম্নিতেই অনেক দেরী হইয়া গেল।
বাবলু আর চুপ থাকতে পারে না। হুট করে বলে বসে, "যদি ব্রাক্ষ্মণেরই দরকার পড়েছিল, তাইলে ঘরে মমতাদিকে কারোর চোখেই পড়ল না কেন?" এরপর করুণ হেসে মমতাদিকে বলল, "প্লীজ দিদি, এখন রাগ না করে আমার দুঃখিনী মায়ের দিকে তাকিয়ে দয়া করে শান্ত, লক্ষ্মী ব্রাক্ষ্মণ-বৌয়ের মতো এযাত্রা তাকে উদ্ধার কর তো দেখি"।
৫
মমতা মুচকি হাসে। এই অল্প ক'দিনেই মমতাদি আর গুন্টুর সাথে বাবলুর একটা সহজ সরল সম্বন্ধ গড়ে উঠেছে- যেখানে মালিক-ভাড়াটিয়ার সম্পর্কের ছায়া খুঁজে পাওয়া কঠিন। আরো কি যেন বলতে যাচ্ছিল বাবলু, কিন্তু ইতিমধ্যেই সারদামাসী মমতাদিকে প্রায় জোর করে টেনে নিয়ে ঘরটায় ঢুকে যেতেই মায়ের ইশারায় থমকে গিয়ে গলাটা নামায় বাবলু। কিন্তু গজগজ করে স্বগতোক্তি করতেই থাকে- "এটা তো দেখছি জাতের ভেতরেও আরো গভীর বজ্জাতি! ছাপোষা খেটে খাওয়া সৎ ব্রাক্ষ্মণ-পরিবার খুব কাছে থাকলেও কারো নজরে পড়ে না- আর দূরের ঘুষখোর বড়লোক ব্রাক্ষ্মণের গয়নায় মোড়া বৌকে সুযোগ বুঝে তেল মারতে সবাই ওস্তাদ"।
ভাগ্যিস মা ছাড়া আর কারো কান অব্দি কথাটা পৌঁছল না। নইলে কি হ'ত ভেবে মা আঁতকে উঠেন। হঠাৎই বাড়ির ভেতর উলুধ্বনি আর শঙ্খধ্বনি শোনা যায়। মা চোখ বুজে হাতজোড় করে মনে মনে প্রার্থনা জানান- "সবার মঙ্গল কর দয়াময়, আর তুমি তো ভাল করেই জানো ঠাকুর- আসলে আমার বাবলুটা কিন্তু কারো খারাপ চায় না। ছেলেটা যেমন চায়, সেভাবেই দুনিয়াটাকে সুন্দর করে বানিয়ে দাও না, প্রভু! আর হ্যাঁ, ততদিন ছেলেটাকে একটু মানিয়ে চলার ক্ষমতাটাও দিয়ে রেখো শুধু"।
0 মন্তব্যসমূহ