কফি হাউস থেকে বেরিয়ে আয়ুষ নন্দিনীকে বাসে তুলে, সেও তার বাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আজ আয়ুষ ও নন্দিনীর সম্পর্কের সাত বছর পূরণ হল তাই প্রত্যেক বছরের মত এবছরও ওরা নিজেদের মত করে সময় কাটাতে আসে কফি হাউসে।
***
ওদের প্রেমটা শুরু হয়েছিল কলেজ জীবনে। নন্দিনী আয়ুষের চেয়ে একবছরের ছোট। আয়ুষ তখন কলেজে 2nd year। নন্দিনীর প্রথম দিন কলেজ আসা থেকেই আয়ুষের ভালো লাগা শুরু হয়। নানা অজুহাতে নন্দিনীকে দেখার চেষ্টা। সুযোগ পেলেই নানা ভাবে কথা বলার বাহানা। নন্দিনীকে না দেখলে চোখে হারানো। নন্দিনী কলেজে না এলে আয়ুষ ব্যাকুল হয়ে উঠত। এভাবেই আয়ুষের ভালোলাগাটা ক্রমেই একতরফা ভালোবাসায় পরিণত হয়। নন্দিনীরও আয়ুষের সাথে কথা বলতে ভালো লাগত। আয়ুষ কবিতা লিখত অন্যদিকে নন্দিনীও ভীষন ভাবে কবিতাপ্রেমী। তখন আয়ুষেরও কবিতা জুড়ে শুধুই নন্দিনী।
নন্দিনীও আয়ুষের সাথে মিশতে ভালো বাসে- কথা বলে খুব শান্তি পায়। নন্দিনী নানা সমস্যামূলক পরিস্থিতি উল্লেখ করে আয়ুষের থেকে তার সমাধান শুনতে চায়। আয়ুষের উত্তরগুলো জেনে নন্দিনী ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়। ক্রমে কখন যে দুজন দুজনকে ছাড়া অসম্পূর্ণ তা দুজনেই উপলব্ধি করে। আস্তে আস্তে সকলেই জানতে থাকে আয়ুষ আর নন্দিনীর প্রেমের কথা। কিন্তু কেউই মেনে নিতে পারছে না। চোখে দেখেও মেলাতে পারছে না ওদের একের সাথে অপরের সম্পর্ক। রূপে গুনে এতো সুন্দরী মেয়ে কী করে এমন এক ক্যাবলাকান্ত ছেলের প্রেমে পড়তে পারে!
আয়ুষ এক মধ্যবিত্ত পরিবারের খুব সাধারণ দর্শনধারী ছেলে। গায়ের রং চাপা, স্টাইল নেই বর্তমান সমাজের ছেলেদের মতো একেবারেই; বরং সম্পূর্ণ আলাদা। অন্যদিকে নন্দিনী রূপে সুন্দরী, ওর গানের গলায় মুগ্ধ সকলে, ধনী পরিবারের মেয়ে,পড়াশোনায়ও খুব ভালো। কিন্তু এই নন্দিনীর সমস্ত মন জুড়ে শুধুই আয়ুষ। কলেজে আসার প্রথম দিন থেকেই অনেক প্রোপোজেল পায় নন্দিনী- দামী বাইক চড়ে আসা, পকেটে IPhone, গলায় Dslr, রূপেরও বেশ ঝলক ওয়ালা ধনী পরিবারের ছেলেদের থেকে। প্রত্যেককেই প্রত্যাখ্যান করে নন্দিনী। নন্দিনী রূপের বা টাকার মায়ায় কোনোদিনই ভোলেনি। ক্যাবলাকান্তটাই যথেষ্ট। কিন্তু যথেষ্ট ছিল না সেই ছেলেগুলির কাছে যারা কিনা নন্দিনীকে প্রোপোজ করেছিল। তাদের চোখের বিষ হয়ে ওঠে আয়ুষ। নানারকম হুমকি। ফোন করে ধমক। এসব শেষ করতে পারেনি ওদের প্রেম, ওরা ঠিক বাধা কাটিয়ে ওঠে প্রত্যেকবারই। ওদের বিশ্বাসের ভিত কঠিন, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসার বন্ধনে আজও ওদের চারহাত এক। দুজনেই দুজনের প্রতিষ্ঠিত হবার সাক্ষী। বতর্মানে আয়ুষ এক প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। নন্দিনী একজন নামকরা উকিল।
***
আয়ুষ অনেকক্ষণ থেকেই অপেক্ষা করছে কিন্তু কিছুই পাচ্ছেনা। একটা হলুদ ট্যাক্সি এসে থামে আয়ুষের সামনে। হঠাৎ করে পিছন থেকে নাকে রুমাল চেপে কারা যেন তাকে গাড়িতে তুলে নেয়। আয়ুষের যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখে সে এক ঘরের মধ্যে অন্যরকম অবস্থায়- পাশে এক মহিলার পোশাক। সমস্ত কিছু বুঝে ওঠবার আগেই পুলিশ এসে গ্রেপ্তার করে শ্লীলতাহানির অভিযোগে। নন্দিনী বিশ্বাস করেনি। সে তদন্ত শুরু করে। কফি হাউসের পাশে চায়ের দোকানের কাকুর সাহায্যে, পাশের দোকানের cc ক্যামেরার ফুটেজ এসব দেখে ট্যাক্সিটিকে খুঁজে বের করা তারপর সেই মেয়েটির কাছ পযর্ন্ত পোঁছে দেওয়া, যে মেয়ে বিধবা মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা পাবার উদ্দেশ্যে এসব কাজ করেছিল সেইসব শত্রুদের ইঙ্গিতে। সমস্ত প্রমাণ আদালতে পেশ করে নন্দিনী। পুলিশ একজন দোষীকে গ্রেপ্তার করে। আদালত আয়ুষকে নির্দোষ প্রমাণ করে মুক্ত করে দেন। আয়ুষ নন্দিনীকে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আয়ুষ যে একেবারেই ভেঙে পড়েছে। নন্দিনী আয়ুষের হাতটা শক্ত করে ধরে। গঙ্গার ধারে বসে বিশ্রামের জন্যে। একসময় হাত ধরাধরি করে হাঁটতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ ... তীব্র বেগে একটা গাড়ির চাকায় পিষে যায় আয়ুষ। পুলিশ যে একজন অভিযুক্তকেই গ্রেপ্তার করেছিল। আরও দুজন কিন্তু এখন গ্রেপ্তার হয়নি। তবে কি ওরাই ... ? নন্দিনী ছিটকে আছড়ে পড়ে সামনের ইলেকট্রিক পোষ্টের উপর।গাড়িটা ব্রেকফেল হয়ে গঙ্গায় পড়ে।
***
(ঘটনাটির পাঁচ বছর গড়িয়েছে; আজও ঐ রাস্তার সামনের শ্মশানটিতে চিতার ছাই বুকে মাখা এক পাগলী 'আয়ুষ আয়ুষ' ডেকে চিৎকার করে।)
0 মন্তব্যসমূহ