ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

স্মৃতি ফেরানোর পথে - সর্বানী পাল



 বাইরেটা প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে; ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছে সাথে মেঘে মেঘে ঘর্ষণে বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হয়েছে। এমনি দিনেও মিনার সারাটা দিন বাড়িতেই দোতলার ব্যালকনি আর ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে বই পড়ে ও নিত্য মেয়েলি গৃহকর্ম করেই দিন কেটে যায়। আজ মিনাকে একটু বিমর্ষই দেখাচ্ছিল। ব্যালকনি থেকে হাসপাতালের মর্গের বাইরেটা দেখা যায়, আলো-আঁধারিতে কতশত প্লাস্টিক মোড়ানো লাশ তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার উদ্দেশ্যে শববাহী গাড়িতে তোলা হচ্ছে। মিনা একদৃষ্টে সেদিকে চেয়ে থাকে। এমন সময়ে...

"তোর কিছু মনে পড়ে না?"

একটু চুপ করে মিনা উত্তর দেয় "হ্যাঁ পড়ে তো।"

কিছুক্ষন নিরবে থাকে মিনা, তারপর বলে ওঠে, "তবে.. শুধু যে ভালো কথায় মনে পড়বে এমনটা নয়, খারাপ স্মৃতিগুলোও দিব্যি মনে রেখেছি।"

"আমি সবটাই বলছি মিনা"

সুমনের কথায় সে কিছু পুরনো ইঙ্গিত আছে তা বুঝতে মিনার দেরি হয়

না। "হুম..."

কিছুক্ষণ এইভাবে কেটে যায়।

       এবার সুমন নড়েচড়ে বসে বলে সত্যি! একসাথে পড়তে যাওয়া, কখনো তোকে সাইকেলের ক্যারিয়ারে চাপিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা এইসবই খুব মনে পড়ে। মিনা স্থির হয়ে সুমনের দিকে চেয়ে থাকে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু মিনা যেন কিছু বুঝতে চাই, কিছু শুনতে চাই। আসলে সে মনে মনে বুঝতে চাই সুমনকে; যদিও তার মনে হয় সুমন যেন একটা 'হেঁয়ালি'। দু'বছর পেরিয়ে গেছে, মিনার কখনও তার অতীতকে ঘুরে দেখতে মন চাইনি। কারণ অন্ধকার ঘেরাটোপে তার শ্বাস বন্ধের জোগাড় হয়েছিল বলতে হয়। আজকাল ফেসবুক, ইনস্টা-র যুগে কে কোন বন্ধুকে ঠিক কতদিন মনে রেখেছে তা বলা ভারী শক্ত। তার ওপর এসময় করোনা অতিমারি জুটেছে। যা প্রায় মহামারী আকার দিতে চলেছে ধীরে ধীরে। বন্ধুদের সাথে দেখা হওয়া বন্ধ; কলেজ,পড়া সবকিছুই প্রায় অনলাইন। এভাবেই সারাদিন ঘরেই কাটে মিনার।

    সুমন বলে "তারপর কেমন আছিস বল?"

"এই যে আছি, লকডাউনে সব মেরে দিলো।

মিনার উত্তরে সুমন একটু হেসে বলে "মেরে দিল।"

"আচ্ছা সুমন, ফ্লিপকার্ট অ্যাপে বাংলা সাহিত্য বিষয়ক বি. এ তৃতীয় বর্ষের বইগুলো পাওয়া যাচ্ছে?"

"হ্যাঁ, যদিও এখন কিছু বাধ্যবাধকতা আছে, অনেক সময় পাওয়া যায় না, তবুও তুই খুঁজে দেখতে পারিস।"

"ও আচ্ছা বেশ।"

মিনার কথায় সুমন একটু হেসে বলে "তোর আমাকে ডাকার কারণ তাহলে এটাই, ঠিক বুঝেছি আমি!"

মিনা নিচু স্বরে বলে"কী বুঝলি?"

"যে তুই এইসবের ব্যাপারেই জানতে চাইবি।"

সুমন উঠে যেতে চাই, মিনা হাতটা ধরে বলে "আরেকটু বস না!"

"কী হবে বসে? তোর তো কিছু বলার নেই আমাকে!"

"কেন? এইতো দিব্যি কত কথা বলছি তোর সাথে।"

"কিন্তু, অন্য কথা বলিস না মিনা!"

কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো দুজনেই। দূর থেকে মাঝে মাঝেই বজ্রপাতের শব্দ শোনা যাচ্ছে তার সাথে আসছে তীব্র আলোর ঝলকানি। এই একটা আলো-আঁধারি ছোট্ট জায়গায় কত নিস্তব্ধতা।

"একটা ডেয়ারি মিল্ক খাবি মিনা?"

সুমনের কথায় মিনা হাসল, বলেই ফেলল এবারে "মনে আছে সবই তাহলে...।"

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সুমন বললো, "পুরনো কথা মনে পড়ে যায় রে।"

একটু এড়িয়ে মিনা বলে "তাহলে জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার বাড়িতে কি এখন আলাদায় থাকা হয়?

"হ্যাঁ, এরকমই! আমাকে আলাদা করে দিয়েছে।"

"বিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব বুঝিস?"

চুপ করে থাকে মিনা।

"একটা কথা বলি মিনা?"

"হ্যাঁ বল না, কী জানতে চাস?"

"তোর সত্যি কিছু মনে..."

মিনা সুমনকে থামিয়ে দিয়ে হেসে বলে ওঠে, "সবার নেমন্তন্ন থাকতো, শুধু আমি বাদ।"

"আরে ... এ.. সব ছেলেদের মধ্যে তুই একা মেয়ে।"

সুমন মিনার হাতটা শক্ত করে ধরে বলে, "আমি সে কথা বলিনি.."

মিনা সুমনকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলে ওঠে, "আনন্দ মাস্টারের ব্যাচে বৃষ্টির দিনে মুড়ি মাখা আর গল্প, তাও আবার খোশমেজাজে, কারোর বাড়ি যাওয়ার কোনো তাড়া থাকতো না..।"

"কত ঝগড়া করেছি মিনা তোর সাথে" সুমন বিড়বিড় করে বলতে থাকে।

"মনে আছে? শীতের ভোরে কুয়াশার মধ্যে কাঁপা কাঁপা ঠাণ্ডা হাত ধরে সাত কিলোমিটার দূরে পড়তে যাওয়ার কথা, বাসে উঠেই তুই দুটো পাশাপাশি ফাঁকা সিট খুঁজতিস।"

মিনা চাপা গলায় বলে ওঠে, "সবাই একই আছে শুধু তোর-আমার রাস্তাটা বদলে গেছে...

 প্রচন্ড গরমে যেমন পাহাড়ের চূড়ার বরফ গলতে শুরু করে মিনারও তেমন সব কঠিনতা কোথায় এক নিমেষের জন্য হারিয়ে গেল, এবার মিনা চাপা গলায় বলে উঠল, ঝড়-বৃষ্টির‌ রাত এরকমই খানিকটা সময় এক ছাতায় অন্ধকারে তোর ভয়ে ভয়ে হাত ধরা- সবার অলক্ষ্যে তোর পাশে বাহানা দিয়ে বসতে চাওয়া- ডান পায়ে কেরী আঙ্গুল দিয়ে তোর বা পায়ের আঙ্গুল ঠেলা দিয়ে ইশারা করা, তোর দেওয়া আঘাত- "কী দোষ ছিল আমার?" এসব বলতে বলতে তার কন্ঠ ভার হয়ে আসে, চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। এমন সময়, "কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিস মিনা?"

"হ্যাঁ? কিছু বললি সুমন?"

"সুমন? আরে আমি মিলি। কী বকছিস ভুলভাল?"

"না না! তুই সুমনকে কোথায় পেলি? এখনো ভুলিসনি তাইনা?"

"অনেক দিন হয়ে গেল, এবার তো ছাড় এসব, নিজের মতো বাঁচ। বাইরের অবস্থা ভালো নয়; এবার একটু নিজেকে নিয়ে ভাব।"

"যাক্, ছাড়।"

মিনার কথায় আর কিছু মনে হয়না মিলির, কারণ মিলি জানে মিনা প্রায়ই একা একা কথা বলে।

"বইটা দিতে এসেছিলাম।"

"রাখ", কাকিমা বলল তুই ওপরের রুমে, তোকে না পেয়ে এখানে এলাম, এসে দেখলাম একায় বোকে চলেছিস!"

মিনা ফিসফিস করে বলে উঠল "ভ্রম"।

"যাক বৃষ্টি কমে এসেছে, আজ উঠলাম।" মিলি চলে গেল।

মিনা অর্ধনির্মিলিত চোখে মাথাটা দরজায় ঠেসে দিয়ে ভাবল অতীতের বাঁধন সে খুলে দিয়েছে অনেকদিন আগেই। শুধু মনে মনে বলে উঠল, "স্মৃতি বড্ড বেদনাদায়ক।" সাহিত্যের পাতায় পড়লে তা অত্যন্ত বাস্তব।। এই স্মৃতি যে সে মনে রাখতে চাইনা, তা নয়। নিমর্জ্জমানই থাক। ধুলো পড়ে যাওয়া স্মৃতির পাতা মুছে কাজ নেই।

   গলির মধ্যে দিয়ে চৌমাথা রাস্তার দিকে একটা চেনা কণ্ঠস্বর যেন "ভালো থাকিস, আমাকে মনে রাখিস।" বলে মিলিয়ে গেল। মিনাও দু'ফোঁটা চোখের জল ফেলে একটু হাসল, তারপর একদৃষ্টে ভাঙ্গা শববাহী পুরনো গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ