ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

ভ্রম - অর্পিতা ভদ্র

 


এই গল্পটি এপ্রিল ২০২০ সংখ্যার প্রকাশিত হয়েছে। 

     "বড়রা এমনই হয়। সবসময় ছোটদের আন্ডারেস্টিমেট করে।" গলা টা যথাসম্ভব ভারী করে বলে দেবমাল্য। একটা আবেগভরা কণ্ঠে বলে ওঠে "মাই ফ্যামিলি হ্যাভ অলসো বিট্রেয়েড উইথ মি।" ওপাশ থেকে একটা উৎসাহ শোনার অপেক্ষায় ছিল দেবমাল্য।কিন্তু হিয়ার নিরুৎসাহে বলা "থাক না এসব" ব্যথিত করল তাকে। তারমানে অভিমান এখন তীব্রতম। এই সুযোগ টাকেই তো কাজে লাগাতে হবে ! " না না কেন থাকবে...?...তোর নিজেকে প্রমান করে দেখতে হবে। মনে আছে সেই গল্পটা? সোনার জিনিস মাটির ডেলা থেকে বেশি দামি মনে হলেও সেটাকেই কিন্তু কুমোররা নির্দিষ্ট আকার দিতে পারে।" হিয়ার গলার কাছে একটা দলা আটকে আছে। দাঁতে দাঁত চাপে হিয়া। তারপর উদাসীন ভাবে তাকিয়ে থাকে দুরে ... শূন্যের দিকে।"মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সব ছেড়ে চলে যাই কোথাও।"অত্যন্ত সন্তর্পণে দেবমাল্য জিজ্ঞেস করে " কোথায় যাবি?" নিরুপায় ভাবে তাকায় হিয়া।"জানিনা" বলে আবার একটা অসহায় আহত দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে। এসময় আর প্রশ্ন করা চলেনা। করাটা তার সাহেবি চালচলন সাপেক্ষে বেমানান অথবা অভদ্রতামি।কিন্তু দেবমাল্যও যে নিরুপায়।তাকে যেন তেন প্রকারেণ জেনে নিতেই হবে হিয়ার দুর্বলতাগুলো। বন্ধুমহল। তাদের সাথে সম্পর্কের তিক্ততা..যা দেবমাল্য জনিত কারনে ঠিক কতদূর গড়িয়েছে সেটা জেনে নিয়েই ধীরে ধীরে এগোতে হবে।


"আমারও ইচ্ছে করে সব ছেড়ে পালাই।তবে পালালেই তো সব সমাধান হয়ে যায় না! " গম্ভীর ভাবে বলে দেবমাল্য।তারপর কিছুক্ষণ থেমে অত্যন্ত উত্সাহ চোখে বলে" মাউন্টেন ট্রেকিং, স্নোফ্রস্ট, লগ ফায়ার, রোস্ট চিকেন, বিয়ার এসবের ইচ্ছে করেনা কখনো ? এই স্বার্থপর দুনিয়াটার বাইরে নিয়ে যাব একদিন তোকে।.. যাবি আমার সঙ্গে?" কথাটায় অভিভাবকসূচক গাম্ভীর্যের রেশ থাকলেও কথার শেষে মুখে একটা লাজুক হাসির রেষ ধরে তাকিয়ে রইল দেবমাল্য। হাসির মধ্যে দিয়েই খুব সন্তপর্নে জরিপ করে নিল হিয়া কে। মিষ্টি হাসি আর কথার ঘায়ে এই কিশোরীকে ম্যানেজ করাটা দেবমাল্যর বা হাতের খেল।


আজ নাকি হিয়ার জন্মদিন। তাই দেখাটা হওয়ায় সুযোগ এসে গেল হাতে। বাড়িতে এতো কড়াকড়ি থাকা সত্তেও যে মেয়ে ম্যানেজ করে, লোকজনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এখানে এসেছে ওর সাথে দেখা করতে, তাতে ওর মনের কথা বুঝতে আর আই আই টি খড়গপুর থেকে এম.এস.সি. পাস করে আসতে হয়না!এ পর্যন্ত দেবমাল্যর ধারনা; হিয়া তীব্র অভিমানী, একটু ডেয়ারিং,কিন্তু সরল এবং সবাইকে বিশ্বাস করে সহজেই। অনিশ্চয়তায় ভোগে,কিছুটা আত্মবিশ্বাসেরও অভাব আছে।


ফলত এই ধরনের মেয়ের ওপর নিজের অধিকার ফলাতে তার কোনো অসুবিধা হবে না।


আলতো করে হিয়ার হাতটা নিজের হাতের ওপর নেয় দেবমাল্য।" নখ গুলো কেটে ফেলেছিস কেন?" হিয়া হাতটা সরিয়ে নেয় দ্রুত। মুখে একটা লালচে আভা দেখা যায় যেন। দেবমাল্য মুখটা আরো কাছাকাছি নিয়ে আসে হিয়ার " তোকে কোনো রূপকথার জগতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু একটা রূপকথার গল্প দিতে পারি।" বলে পকেট থেকে একটা সবুজ মসলিনের রুমাল বার করে মেলে ধরল টেবিলের উপরে। নিমেষে সেটা বদলে গেল রোদঝলমলে একটা সবুজ মাঠে।লাল মাটির রাস্তার দুপাশে লম্বা সুপুরি গাছের সারি। খোলা প্রান্তর। চারিদিকের রং বেরং এর অচেনা সব ফুলের ওপর খেলে বেড়াচ্ছে হাজারো প্রজাপতি।হাল্কা বৃষ্টির পর বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ঝর্নার মতো অজস্র জলবিন্দু। তাতে শেষ বিকালের রোদের আলো ঠিকরে পড়ছে রামধনুর মতো। দুরে দিক চক্রবাল রেখায় অস্তগামি সূর্য;পাখিরা কিচিরমিচির ডাকতে ডাকতে বাসায় ফিরছে।প্রকৃতির আশ্চর্য বাগানে এতো রং এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিলো? চোখ আটকে যায় হিয়ার। ঢলে পড়া লাল আলো এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে হিয়ার চোখ,মুখ,এলো চুল ...।


সম্মহিতার মতো মুখ তুলল হিয়া।তার বিস্মিত নিষ্পাপ চোখদুটি অপলক ভাবে জরিপ করছে সৃষ্টিকর্তাকে। খুব আলতো করে হাতটা ধরল দেবমাল্য। তারপর মুখের কাছে এনে আলতো করে ঠোট ছোয়ালো তাতে। শিলমোহর পড়ে গেল।


পাকা ম্যাজিশিয়ান এর মতনই সব করল দেবমাল্য। পকেট ঝাড়তেই আরো কয়েকটা প্রজাপতি উড়ে গেল ফুড়ফুড় করে। কখন যে পকেটে ঢুকে পড়ে!


বিদায় নেওয়ার সময় পর্যন্ত বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল হিয়া।


 


        লম্বা পায়ে হিয়ার চোখের সামনে থেকে আড়াল হতেই হাটার গতি মন্থর হয়ে আসে দেবমাল্যর।জিন্সটা হয়ে যায় ফাটা,বহু পুরনো,রং চটা। গোড়ালির কাছটা থেকে সুতো ছিড়ে ঝুলছে।নীল চেক শার্টটা হয়ে যায় কোচকানো ময়লা একটা জীর্ণ সুতির জামা।পায়ের স্নিকার্সটাও বদলে যায় চামড়ার চটিতে। চোখে কালো ফ্রেমের পুরু চশমা। বয়স টা আরো দশ বছর বেড়ে যায়। মাথার চুল এলোমেলো ঝোড়ো কাকের মতো।মুখে বাসি দাড়ি।


আর দেবমাল্য নয়।লোকটা ফিরে এসেছে নিজের চরিত্রে। হিরন্য। হিরন্য সেন।হোচট খেতে খেতে এসে দাঁড়ায় একটা উঁচু তিনতলা বাড়ির সামনে।


একটু ডাকাডাকি করতেই বেরিয়ে এলো ট্রাউসারস পরা এক সুদর্শন যুবক। হিরন্যকে দেখে একটা খাম এগিয়ে দেয়।"সব ১০০ টাকার নোট তো! ৫০০ টাকা হলে আবার ভাঙানো মুশকিল হয় পাড়ার দোকানে।" যুবকটি "হ্যাঁ হ্যাঁ সব একশোর"বলে নিশ্চিন্ত করে তাকে। যুবকটি এবার জানতে চায় " কাজ হয়েছে তো!" "যদি বলি 'না' ? আমার টাকা তো আমি পেয়ে গেছি!" বলে ধূর্ত শেয়ালের মত হাসে লোকটা। যুবকের সপ্রতিভ মুখটায় যেন ঝপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো। সেটা দেখেই হয়ত একটু রসিকতার সুরে লোকটি বলল "টোপ গিলেছে মাছে।চিন্তার কোনো কারন নেই।আমি আসি তবে?" দু পা বাড়িয়েও আবার পিছিয়ে এলো লোকটি।"বলছি আর পঞ্চাশটা টাকা হবে নাকি? বাড়ি যাব তো! খামটা খুলতে এখন মন চাইছে না। " ছেলেটা মনিব্যাগ থেকে তাড়াতাড়ি টাকাটা বের করে দিল। "আর হ্যাঁ মেয়েটা একটা কল্পনার জগতে বাস করে।সাদাসিধে,তবে ভাল।পরের বার দেখা করার সময় অবশ্যই এই সবুজ রুমাল টা নিয়ে যেও। আজ থেকে এটা তোমার।"বলে মিলিয়ে গেল লোকটা।


অনেকদূর একটা অস্পষ্ট মানুষের অবয়ব দেখা গেল।কিছুটা ঝুকে হাঁটছে যেন।দেবমাল্য সবুজ রুমাল টা ধরে বিহ্বল ভাবে চেয়ে রইল সেদিকে। সদ্য নামা সন্ধ্যার নীল আলোয় এখনও তাকে দেখা যাচ্ছে।আর ঝুকে নয়,মেরুদণ্ড সোজা করে সামনের অন্ধকার ভেদ করে হেটে চলেছে সে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ