ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

শুকের কথায় সুখের খোঁজ – শুকসপ্ততি -পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়


  • বই – শুকসপ্ততি 
  • লেখক – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি 
  • প্রকাশনী – আনন্দ পাবলিশার্স
  • প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারী ২০০১
  • প্রচ্ছদ – কৃষ্ণেন্দু চাকী
  • পৃষ্ঠা – ২৫৪
  • মুদ্রিত মূল্য –  ২০০

ছো টবেলায় জাতকের কথা, ঈশপের গল্প, বত্রিশ সিংহাসন, পঞ্চতন্ত্র প্রভৃতি নীতিশিক্ষার গল্পকথা শোনেনি বা পড়েনি এমন বাঙালি শিশু প্রায় বিরল। অন্তত আমাদের প্রজন্মের প্রায় প্রতিটি শিক্ষিত পরিবারের শিশুদের শৈশবের গল্প শোনার সূত্রপাত এই সমস্ত গল্পকথার মাধ্যমেই ঘটে থাকত। শিশুকাল থেকেই একজন শিশুকে গল্পছলে নীতিশিক্ষার প্রাথমিক পাঠ সাধারণত তার পরিবারের প্রবীণ প্রবীণারাই শেখানোর চেষ্টা করতেন। যা পরবর্তীতে বাবা – মা – দাদা – দিদিদের মাধ্যমে শিশুটির মধ্যে সঞ্চারিত হত। এই ভাবেই একটি শিশু যাতে ভবিষ্যতে একজন আদর্শ নীতিনিষ্ঠ আদর্শবান মানুষ হয়ে ওঠে তার প্রচেষ্টাই তার সংস্পর্শে আসা প্রতিটি মানুষই করে থাকতেন। শুষ্ক নীতিকথার প্রভাব যে নেহাতই ভস্মে ঘি ঢালার সমান হয়, সেই বোধ থেকেই প্রাচীনকাল থেকেই সহজ সরল ভাষায় ছোট ছোট গল্প তৈরি করে তা শিশু থেকে বয়স্ক সকলকেই শোনানো ও জানানো হত। এর উদ্দেশ্য শুধুই একজন সুস্থ মানুষ তৈরি করাই ছিল না, বৃহত্তর স্বার্থে একটি আদর্শ সমাজ গঠন ও সামাজিক অবক্ষয়কে রোধ করাও ছিল। 

এই ধারারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই দ্বাদশ – ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ব্রাহ্মণ চিন্তামনি ভট্ট দ্বারা রচিত সংস্কৃত সাহিত্য ‘শুকসপ্ততি’ গ্রন্থে। যদিও এই গ্রন্থটির ধ্রুপদি গুরুত্ব প্রায় নেই, কিন্তু এর সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাষার আখ্যানগুলি আজও সমানভাবে লোকপ্রিয়। 
 
যুগ যুগ ধরে প্রচলিত লোককথাকে  লেখক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি প্রাঞ্জল ভাষায় গল্পের আকারে সংকলিত করেছেন। একটি মূল গল্পের ভিতরে আরও ছোট ছোট অনেকগুলি গল্প এই বইয়ের উপাদান। প্রাচীন গ্রন্থটিকে টিকাসহ নতুনভাবে সচ্ছন্দ ও সাবলীল ভাষায় গ্রন্থবদ্ধ করেছেন যা পাঠকের মনোরঞ্জন করে। এই আখ্যান এক অতীব আশ্চর্য আখ্যান। বইয়ের বিষয়ে কিছু বলার আগে এর মূল কাহিনীটি একটু বলে নিই - 
চন্দ্রপুর নামক নগরে মদনবিনোদ নামের এক বণিক বাণিজ্যের জন্য দেশান্তরী হল। তার স্ত্রী প্রভাবতী বাড়িতে একা থাকতে-থাকতে মনমরা হয়ে পড়েছিল। তার ক'জন বন্ধু তাকে অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গ উপভোগ করে একাকিত্বের গ্লানি দূর করার পরামর্শ দিল। প্রস্তাবটা প্রভাবতী'র বিলক্ষণ পছন্দ হল। প্রতি সন্ধ্যায় সে বেরোনোর উদ্যোগ নিত। তখন বাড়ির শুকপাখিটি তাকে রীতিমতো উৎসাহ দিয়ে বলত, "পরপুরুষের সঙ্গসুখ অবশ্যই উপভোগ করা যায়। তবে তার জন্য অমুকের মতো বুদ্ধি থাকা দরকার। না হলে...!" কিংবা বলত - “সঙ্গসুখ অবশ্যই ভোগ করতে যাও তবে অমুক ধরা পড়ে গিয়ে বিপদ থেকে কিভাবে রক্ষা পেয়েছিল সেটা যদি জানা থাকে তবেই যাও, নাহলে …!”

 এই 'অমুক'-টি কে এবং সে কী ধরনের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিল অথবা কি ঘটনা ঘটেছিল — সেই নিয়ে গল্প হত সারা রাত। বাধ্য হয়ে প্রভাবতী আর সেই রাতে রতিসুখসারে যেতে পারত না। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হত পরের রাতেও। এই প্রক্রিয়া ততদিন চলেছিল যতদিন না মদনবণিক বাড়ি ফেরে।

সমগ্র বইয়ে রাতের পর রাত বলে চলা শুক পাখির গল্পগুলিকে গাঁথা হয়েছে। তবে বইয়ের শুরুতে লেখক ৭০ পৃষ্ঠা জুড়ে এই আখ্যানের ইতিহাস ব্যক্ত করেছেন যা এক কথায় অনবদ্য। শুকসপ্ততি সত্তরটি আখ্যানের সংকলন। চিন্তামনি ভট্ট এই গ্রন্থের সংস্কৃত ও বিস্তৃত সংস্করণ প্রকাশ করেন। তবে গল্পগুলি প্রকৃতপক্ষে তাঁর রচিত নয়। তিনি সম্ভবত তাঁর পূর্ববর্তী জৈন লেখক পূর্ণভদ্রের লেখাকে সংস্কৃত ভাষায় রূপ দেন। অর্থাৎ লোককথাগুলি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখকের হাত ধরে বিভিন্ন ভাষায় নবরূপ প্রাপ্ত হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। যুগ যুগ ধরে এই ভাবে ভিন্ন ভিন্ন লেখকের মাধ্যমে লেখা হওয়ায় অনেক সময়েই পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু ঘটনার হেরফের ঘটলেও মূল বিষয়বস্তুর পরিবর্তন ঘটেনি।  

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি লিখিত গ্রন্থটির মৌলিকতা ও আকর্ষণের বিষয় হল এই আখ্যানমালার অনুবাদের যথাসম্ভব ঐতিহাসিক বিবর্তন তিনি পাঠককে জানিয়েছেন। সাথে আছে যথাযোগ্য টিকা সম্ভার।  এছাড়া বইয়ের প্রতিটি গল্পের শুরুতে সংস্কৃত ভাষায় গল্পটি বলা আছে, যাতে সংস্কৃত ভাষার অনুরাগী পাঠক এর রসাস্বাদন করতে পারেন। তিনি একইসাথে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে বিশ্লেষণ করে সমকালীন সমাজ, অর্থনীতি, জীবনচর্যা, এমনকি ধর্মীয় বিশ্বাস ও নানারকম ভয়ের কথাও উল্লেখ করেছেন।

আখ্যানমালার মাধ্যমে আপাতভাবে যদিও নীতিকথা এবং নানা প্রকার উপদেশ দেওয়ার মাধ্যমে একজন নারীরও যে সমান যৌন সুখের অধিকার আছে তা বলা হয়েছে। যা পড়ে বিস্ময় জাগে। কয়েক শত বছর আগেও যে কেউ নারীর যৌন অধিকার, যৌন সুখ নিয়ে দ্বিধাহীন হওয়ার কথা ভেবেছিলেন এবং তা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই ধরণের আখ্যানমালা রচনা করেছিলেন, তা প্রশংসার দাবী রাখে।  গল্পগুলির মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে তৎকালীন সামাজিক রীতিনীতি, অর্থনৈতিক অবস্থা, জীবন যাপন, সামাজিক বিভিন্ন কুসংস্কার ও ধর্মীয় বিশ্বাসসহ ভয়জনিত লোকাচারসমূহ। গল্পগুলির সবই রতি বিষয়ক বা যৌন উত্তেজক পরকীয়া সম্পর্কিত নয়। লোভ, হিংসা, বুদ্ধি প্রভৃতি মানব প্রবৃত্তিরও উল্লেখ পাওয়া যায়। পুরাকালে নারীর অধিকার সম্পর্কে সমাজ যে নিশ্চুপ ছিল না তা বোঝা যায়। 

এই আখ্যানমালার সাথে বত্রিশ সিংহাসন ও পঞ্চতন্ত্রের গল্পের তুলনা করা চলে। প্রায় একই ধাঁচে সমগ্র গ্রন্থ রচনা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বইয়ের প্রতিটি গল্পই কিছু না কিছু শিক্ষা দিয়ে যায়। যদিও পরকীয়া ও যৌনতা কেন্দ্রীয় বিষয় হওয়ায় এর অবদান সামাজিকভাবে প্রবল নয়। কিন্তু বর্তমান যুগের প্রাপ্তবয়স্ক সমাজে এর অবদান অনস্বীকার্য।  


   

এটিই মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’-এর সর্বশেষ সংস্করণ। (বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ