.jpg)
‘গ
ণপতিদা! গণপতিদা –!’
ডাকতে ডাকতে হাঁপাতে হাঁপাতে পেটো কার্তিক ঢুকে পড়ে এলাকার জবরদস্ত মহান
নেতা গণপতি দত্তের বাসভবনে। বাসভবনের বাইরের দিকটা একেবারে ধবধবে সাদা রঙের।
দোতলায় আর তিনতলায় এখানে ওখানে মন্দিরের মত আর্চ করা হয়েছে।
দেবালয় স্টাইলের সাদারঙের বিশাল বাড়িটা দেখলেই মনে সম্ভ্রম আর ভরসা জাগে।
এমন ধারণা জন্মায় এবাড়ির সর্বত্রই আধ্যাত্মিকতার পরশ ছড়িয়ে আছে। মনে হয়
এবাড়িতে কিছুক্ষণ কাটাতে পারলে মনে শান্তির ভাব আসবে।
অবশ্য এবাড়িতে যখন তখন ইচ্ছা করলেই ঢোকা যায় না। বরং এখানে ঢোকা বেশ শক্ত।
তবে পেটো কার্তিকের কথা আলাদা। গেটের দুজন তাগড়াই রক্ষী তাকে এক ঝলক খুঁটিয়ে
দেখে গেট থেকে সরে দাঁড়াল। বাড়ির ভেতরে ঢুকে পেটো কার্তিক বসার ঘরে
গণপতিবাবুকে দেখতে পেয়ে একেবারে ককিয়ে ওঠে -
‘দাদা গো! আজ ভোরে মহা সব্বোনেশে কেস ঘটে গেছে দু-নম্বর ওয়ার্ডে! এবার উপায়
কী –’
সকাল পৌনে সাতটা। গণপতিবাবু অনেক আগেই শয্যাত্যাগ করেছেন। লেট নাইট – লেট
রাইজ, এসব হচ্ছে উঠতি নেতাদের দস্তুর। গণপতিবাবু সেসব স্টেজ অনেক আগেই পেরিয়ে
এসেছেন। পেটো কার্তিক যখন তাঁর কাছে হাজির হল তখন তিনি প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে,
ধ্যান এবং প্রাণায়ামাদি সমাপন করে একতলার বসার ঘরে এসে সবে
বসেছেন।
তাঁর সৌম্য চোখে মুখে তখনও সুগভীর প্রশান্তির রেশ লেগে রয়েছে। পেটো
কার্তিকের গভীর উদ্বেগ আর সভয় চাঞ্চল্য সেই প্রশান্তির আবরণ ভেদ করে তাঁকে
স্পর্শ করতেই পারল না। খুব শান্ত স্বরে তিনি বললেন -
‘বোস কাত্তিক। আগে একগ্লাস জল খা। তারপর যদি চাস তো বাইরে গিয়ে খানিক বিড়ি
টেনে আয়। মাথাটা ঠান্ডা করে আয়। তার পরে সব শুনছি।’
‘দাদা! ভীষণ কান্ড হয়ে গেছে! তোমার নিজের এলাকাতেই বিচ্ছিরি রকমের রেপ কেস
হয়ে গেছে, আজ ভোরেই। তাও আবার নাবালিকা! ভোরের দিকে মনে হয় হাগা সারতে একা
একা মাঠের দিকে গিয়েছিল। সেই সময় এক ছোকরা ...’
ভেতরের দিক থেকে একজন এসে তাম্রনির্মিত গ্লাসে পানীয় নিয়ে এল। গণপতিবাবু
প্রত্যহ প্রাতঃকালে তুলসীপত্র, বিল্বপত্র এবং নিম্বপত্র ভেজানো জল পান করেন।
এতে মানবদেহের সমগ্র ব্যাধির মূলস্থ কারণ শরীরস্থ বায়ু, পিত্ত, ও কফ এই
ত্রিবিধ দোষ নিবারিত হয়। সেই সাত্ত্বিক পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন
-
‘নাবালিকা? ধুস্...!’
পানীয়ের খালি গ্লাসটা সামনের নীচু টেবিলে ধীরে সুস্থে নামিয়ে রেখে সাদা নরম
তোয়ালে দিয়ে হালকা ছোঁয়ায় নিজের ঠোঁট মুছে নিয়ে শান্ত গলায় বললেন
–
‘তার মানে সে তো এখন কোনোরকম ভোটারই নয়। তার ব্যাপার নিয়ে তুই এত মাথা গরম
কচ্ছিস!’
‘কিন্তু মেয়েটার বাবা তো থানায় কেস করতে যাবে বলেছে। আর নাবালিকার কিছু করলে
‘ফসকো’ নামে কী যেন একটা আইন–’
‘ওসব আইন-ফাইন, থানা-ফানার ফালতু কথা ছাড় তো। আগে বল, সবশুদ্ধ ক’টা ভোটার
আছে ওই ফ্যামিলিতে?’
‘আট – না না, মেয়েটা তো ক্লাস নাইনে পড়ে। তার ভোটার কার্ড হয়নি এখনও, তাহলে
সাতটা – সাতটা ভোটার আছে।’
‘আর যে মালটি রেপ করেছে সে কি এখন ভোটার?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সে ব্যাটা তো এই গত ইলেকশনের আগেই ভোটার হয়েছে।’
‘তাদের ফ্যামিলিতে মোট ভোটার ক’টা?’
‘ওদের সব মিলিয়ে চারটে ভোটার হচ্ছে।’
‘হুঁ –’
সামনের দেওয়ালে কালীমাতাসমেত রামকৃষ্ণদেবের প্রমাণ-সাইজ বাঁধানো ছবি টাঙানো
আছে। সেদিকে খানিকক্ষণ উপাসকসুলভ চোখে তাকিয়ে রইলেন গণপতিবাবু। তারপর মৃদু
গলায় বললেন -
‘কাদের?’
‘অ্যাঁ! কাদের? … মানে দাদা – ওহ্! বুঝিছি এবার। ওরা? ওরা তো আমাদের -
আমাদের। সবগুলোই আমাদের ভোটার।’
‘ষাঁড়ের বাচ্চাটাকে তুলে আন কাত্তিক। ঠেসে ক্যালানি দে।’
তারপর রামকৃষ্ণদেবের ছবি থেকে সরে গিয়ে একটু ওপাশে টাঙানো স্বামী
বিবেকানন্দের ছবির উপর নজর দাঁড় করিয়ে রেখে তিনি শক্ত গলায় বলে উঠলেন
-
‘ভালোমতে ক্যালানোর পর আমি নিজে মালটাকে থানায় নিয়ে যাব। আর সরকারী
হাসপাতালে সেই মেয়েটার মেডিক্যাল টেস্ট করানো হবে। যাতে পকসো আইনে এই কেসের
বিচার করা হয় সেটা আমি নিজে দেখব। আইন চলবে আইনের নিজের পথে।’
‘এখানে কিন্তু একটা কথা বলার আছে দাদা –’
‘চোপ!! এর ওপর আর কোনো কথা-ফতা নেই।’- খুব কর্কশভাবে ন্যায়কঠোর গলাতে
চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি - ‘গণতন্ত্রে আইনের ঊর্ধ্বে কেউই নয়। আইন অনুযায়ী যেটা
হওয়া উচিত ঠিক সেটাই হবে, সেটাই করতে হবে।’
‘আচ্ছা দাদা, আচ্ছা। তুমি যা বলবে তাই হবে। তবে কী, রেপ করা পার্টিরা হল
আমাদের অনেক পুরনো ভোটার, মানে এরা একদম পকেট ভোটার। তার ওপর সবসময় বেশ
ভালোরকম চাঁদাপত্তর এমনিতে তো দেয়-ই, ওমনিতেও বেশ ভালোই দেয়।’
‘হুঁ -’
বিবেকানন্দ পেরিয়ে এতক্ষণে শান্তিনিকেতনী ফ্রেমে বাঁধানো রবীন্দ্রনাথের ছবির
ওপর গণপতিবাবুর চোখ চলে এসেছিল। এবার সেখান থেকে সরে যাব যাব করছে তাঁর চোখ
-
‘আর এরা - রেপ খাওয়া পার্টিরা? এদের পজিশানটা কী রকম শুনি?’
‘এরা গত ইলেকশান থেকে আমাদের ভোটার হয়েছে। ওদের এমনি অবস্থা মোটেই ভালো নয়।
চাঁদাপত্তর তেমন দিতে পারে না। খুব টানাটানির সংসার।’
‘তাহলে এই সেকেন্ড পার্টি –’ এবার চোখটা রবীন্দ্রনাথের দিক থেকে একেবারে
নীচে নামিয়ে পেটো কার্তিকের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন - ‘এরা তো এইসব কোর্ট কেসের
খরচ-টরচ এমনিতেই টানতে পারবে না। তবু এখন এদের থানায় যাবার এত বাই চাগলো কেন?
এর মধ্যে কোনো অপোনেন্ট মাল ঢুকে পড়েছে কিনা সেটা খেয়াল করেছিস?’
‘না না, ওদের কেউ এখনও পিকচারে ঢোকেনি। একদম জানাজানিও হয়নি। আমি সব
ঠেকিয়ে-ঠুকিয়ে রেখে এসিছি। কিন্তু এদিকে তাহলে এখন কী করা হবে দাদা সেটা
বলো?’
‘দ্যাখ কাত্তিক, এখানে কয়েকটা পয়েন্ট পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে – তা থেকে কয়েকটা
ভাইটাল কোশ্চেনও উঠে আসছে’ –
ডানহাতের মধ্যমায় পরা সোনার তৈরি ‘ওঁ’ সেট করা বড়ো আংটিটা খুব মন দিয়ে দেখতে
দেখতে গণপতিবাবু বললেন –
‘নাম্বার ওয়ান, মেয়েটা অত ভোরের দিকে উইদাউট প্রপার গার্জেন প্রোটেকশন, একা
একা মাঠের দিকে কেন গেল? প্রকৃতির ডাকেই যদি যায় তাহলে তার মা অন্তত সঙ্গে
থাকতে পারত। প্রকৃতির ডাক ছাড়া অন্য কোনো কিছুর বা কারোর ডাকে সেদিকে গিয়েছিল
কিনা সে প্রশ্নটাও উঠবেই উঠবে। নাম্বার টু, ওই ছেলেটা আর মেয়েটা একই পাড়ায়
থাকে। সেক্ষেত্রে ওই ছেলেটার সঙ্গে মেয়েটার প্রিভিয়াস কোনো ইমোশন্যাল
কানেকশান আছে বা ছিল এমন সম্ভাবনা কিন্তু একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
নাম্বার থ্রি, মেয়েটা ওই সময়ে অর্থাৎ রেপের আগে বা রেপের সময়ে বা রেপের পরে
খুব জোরে চিৎকার-টিৎকার করল না কেন? সে চিৎকার কেউ তাহলে শুনতে পেল না কেন?
তবে কি সেইসময় সে একেবারে চুপচাপই ছিল?’
‘দারুণ কথা বলেছ তো দাদা। এই ভেরি ভেরি আজ্জেন্ট সাইডগুলো ভেবে দেখার কথা
আমার মাথাতেই আসেনি।’
‘তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার, মেয়েটা ঠিক কীভাবে কতটা রেপড্ হয়েছে তা আমাকে
ঠিকমতো জানতেই হবে। আর সেটা জানার জন্য মেয়েটাকে আমার এখানে আলাদাভাবে ডেকে
একটা ডিটেল্ড স্টেটমেন্ট নিতে হবে আমাকে। অন্যদের সামনে নয়, তার একার সঙ্গে
আলাদা ঘরে কথা বলে আমি নিজে পুরো ঘটনাটা শুনব। তারপর ফাইনাল ডিসিশনে আসতে
হবে।’
‘ঠিক আছে। সেসব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু এখন ঠিক কী করা হবে সেইটা বলো।
এখনকার মতো এব্যাপারে একটা চটজলদি সমাধানে তো আসতে হবে।’
‘সার্টেন্লি। এইরকম একটা গুরুতর সমস্যা তো আর এমনি ঝুলিয়ে রাখা কোনোমতেই
সম্ভব নয়। একটা সবদিক বাঁচানো সমাধানের পথ খুঁজতেই হবে। দ্যাখ কাত্তিক,
ভেবেচিন্তে আমার যতদূর মনে হয়, ওই ছেলেটা নেহাৎ একটা ছেলেমানুষি ঝোঁকেই
তখনকার মতো এই ভুল কাজটা করে ফেলেছে। আর কখনও একাজ সে করবে বলে আমার তো মনে
হয় না। কিন্তু মেয়েটার দিকটাও তো দেখতে হবে। মেয়েটার ব্যাপারে কিন্তু কোনোরকম
অবিচার বা অবহেলা করা চলবে না। এখন তার চিকিৎসার সব খরচ ওদেরই দিতে হবে।
তাছাড়া তাকে ভালোমতন ক্ষতিপূরণও আমার হাত দিয়েই দিতে হবে। যেহেতু দল এব্যপারে
সমাধান করার চেষ্টা করছে, দল ইনভল্ভড হচ্ছে সেহেতু আমার কাছে পার্টির ফান্ডেও
কিছু ডোনেট করতে হবে। মোটকথা একটা ফেয়ার অ্যান্ড ক্লিন অ্যান্ড
স্যাটিস্ফ্যাকটরি সমাধানে অবশ্যই আসতে হবে। এক কাজ কর কাত্তিক, তুই দুটো
ফ্যামিলিকেই এখুনি ডেকে আন আমার কাছে। ওসব থানা-ফানার ফালতু বখেড়া করে কোনো
সমাধান হবে না। সকলের সুবিধার্থে উপযুক্ত শান্তিপূর্ণ সমাধান যা করার আমিই
করে দেব।’
'উৎস'তে প্রকাশিত লেখক তুষার সরদারের অন্যান্য লেখা (পড়তে লাল অক্ষরে ক্লিক করুন) -
ছোটগল্প
- বোধনদের বৃত্তান্ত (প্রকাশকাল- সেপ্টেম্বর ২০২৩)
- বেচার জিনিস (প্রকাশকাল- অক্টোবর ২০২৩)
প্রবন্ধ
- সত্য-মিথ্যার আলোছায়া (প্রকাশকাল- আগস্ট ২০২৩)
0 মন্তব্যসমূহ