ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

উচ্চতা -সুমনা সাহা


পা পার্কে তিন চক্কর জগিং-এর পরে রোজকার অভ্যাস মত অমরদ্যুতি বাবু মোড়ের চায়ের দোকানের দিকে এগোলেন। ঘনশ্যামের চা এক ভাঁড় চুমুক দিয়ে, খবরের কাগজটা নাড়াচাড়া করে, দু’চারটে রাজা উজির মেরে অমরদ্যুতি বাবু যাবেন বাজারের দিকে। তারপর ঘরে ফেরা। সকালবেলার এই ঘণ্টাখানেকের অক্সিজেন তাঁর সারাদিনের রসদ। ঘনশ্যামের চায়ের দোকান হল তাঁর বিশ্বদর্পণ, এনসাইক্লোপিডিয়া, তাঁর বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন, মোটকথা ওয়র্ল্ড পলিটিক্স থেকে শুরু করে বাঁকুড়া ভাগ, করোনার হাল-হকিকত, পূজোর রেলভাড়া বৃদ্ধি, ইলিশের দর— কী নেই সেই আড্ডায়! ঘনশ্যাম তার ছেলেবেলার প্রাইমারি স্কুল সহপাঠী। মাধ্যমিকের গণ্ডী পেরোতে না পারা ঘনশ্যাম বাপের চা-দোকানে হেল্পারি করতে করতে একদিন বাপের জায়গায় বসতে আরম্ভ করল, আর অমরদ্যুতি ভাল রেজাল্ট করে স্কলারশিপ পেয়ে অঙ্কে মাস্টার ডিগ্রি করলেন। কেন্দ্রিয় সরকারের জরীপ বিভাগের চাকরি নিয়ে বিহার চলে গিয়েছিলেন। সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্কুলের চাকরি নিয়ে ফের পশ্চিমবঙ্গে ফিরলেন। সেও ছেড়ে দিয়ে এখন সাহিত্য চর্চা নিয়ে মেতে রয়েছেন। প্রকাশনা ব্যবসাও আরম্ভ করেছেন জমানো পুঁজি সম্বল করে। 

আজ সকালের আড্ডায় নতুন মেম্বার রামহরি। রিটায়ার করে এ পাড়ায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। এটা ওঁদের মামাবাড়ির পাড়া। তাই জানাশোনা অনেকদিনের। তিনি অমরদ্যুতিকে দেখেই বলে উঠলেন, “তোর চেহারাটা কেমন ঝরে গিয়েছে দেখছি। সুগার টুগার হয়েছে নাকি? চেক করিয়েছিস?” রামহরি না জেনেই বোলতার চাকে হাত দিয়ে ফেলেছে। এই বয়সেও নাদুশনুদুশ ভুঁড়ি হওয়াটাকে ঠেকিয়ে রাখবার জন্য অমরদ্যুতির প্রাণান্ত পরিশ্রম, রোজ সকালে পার্কে তিন চক্কর দৌড়, মিষ্টির প্রতি লোভ ত্যাগ, বিনা দুধে চা—এতসব না জেনেই বেমক্কা কথাটা বলে ফেলে রামহরি বেজায় বিপদে পড়ে গেলেন। অমরদ্যুতি তাঁকে বাক্যবাণে একেবারে বিদ্ধ করে ফেললেন। তাঁর পিঠে থাবরা মেরে মেরুদণ্ড সোজা করে বসার উপদেশের সঙ্গে সঙ্গে টিপিকাল বাঙালিরা কী ভাবে নিজেদের শরীর স্বাস্থ্যের অবহেলা করে অল্পবয়সেই সুগার-প্রেশার বাঁধিয়ে বসে, ইত্যাদির উপর একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন এবং রামহরিকে রোজ পার্কে দৌড়তে হবে, তবেই সে এই চায়ের আড্ডায় প্রবেশাধিকার পাবে বলেও ঘোষণা করলেন। বেচারা রামহরি মুখ চুন করে রইলেন। অমরদ্যুতি বাজারের দিকে এগোলে ঘনশ্যাম বলল, “কার কাছে খাপ খুলতে গেছেন? ওনার চোপা জানেন না বুঝি? কেউ ওঁকে ঘাঁটাতে যায় না, ওঁর সাথে কথায় কেউ এঁটে উঠতে পারে না কিনা!” রামহরি মিনমিন করে বললেন, “খাপ টাপ খুলিনি তো। শুধু চেহারাটা খারাপ মনে হল দেখে, তাই বলেছি...।” 

বাজারে ঢোকার মুখে প্রাইমারি স্কুলের অঙ্কের মাস্টার যদুনাথের সঙ্গে দেখা। অমরদ্যুতি পা ছোঁয়ার জন্য নিচু হতে যেতেই যদুনাথ বাধা দিলেন, “আরে রাস্তাঘাটে ওসব কী দরকার? কোমরে লেগে টেগে যাবে।” 
“তা মাস্টারমশাই অনেকদিন পরে বাজারে এলেন?” 
“হ্যাঁ, আজকাল চোখে ভাল দেখি না। তাই ছেলেই আসে। তা তোমাকে এমন ছোটখাট দেখাচ্ছে কেন বলোতো? মনে হচ্ছে যেন তুমি খানিকটা বেঁটে হয়ে গেছ!” 
অমরদ্যুতি হাসি চাপতে পারলেন না। বললেন, “আপনি ছানি কাটান। এই বয়সে আর হাইট কমবে কেমন করে?”
“তা ঠিক। তবে, তোমায় যে চোখ বুজেও দেখতে পাই!” চিন্তিত মুখে যদুনাথ বললেন। 

এর কয়েকদিন পরের কথা। আরও কয়েকজনের মুখে ‘বেঁটে বেঁটে লাগছে’ শুনে অমরদ্যুতির মনে একটা সন্দেহ জেগে উঠল। ঘরে ছেলের হাইট কাম ওয়েট মাপার একটা মেশিন রয়েছে। একান্তে তাতে দাঁড়িয়ে দেখলেন, লোকজন মিথ্যে বলছে না। হাইট তাঁর পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি ছিল বলেই জানতেন। মেশিন সেকথা বলছে না। তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, দু-তিন বার মেপে দেখলেন, ছয় ইঞ্চি কম। কাউকে কিছু বললেন না। কিন্তু সারাদিন খুব মনমরা হয়ে রইলেন। সেদিন ঘনশ্যামের দোকানে আড্ডা জমানোর জন্য খোরাক পেয়ে গেলেন এক তরুণ লেখককে। সে একটা বই বের করবার ব্যাপারে তাঁদের প্রকাশনার শর্ত সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিল। বর্তমান প্রজন্মের লেখার নিকৃষ্ট মান নিয়ে এবং বইয়ের বাজারের খারাপ অবস্থা সম্বন্ধে ছেলেটাকে যাচ্ছেতাই বলে তার মনোবল বেশ খানিকটা ভেঙে দিয়ে অপরিসীম আত্মতৃপ্তি নিয়ে বাজারের দিকে এগোলেন অমরদ্যুতি। 
আজ মাছওয়ালা ছেলেটি গম্ভীর মুখে বলল, “কাকু, একটা কথা কদিন ধরে বলব বলব ভাবছি।” 
“বলে ফ্যাল্।”
“আপনার হাইটটা কেমন যেন কম কম মনে হচ্ছে।”
“কেন? হঠাৎ তোর একথা মনে হল কেন?”
“এই যে খাম্বাটার সামনে আপনি দাঁড়ান রোজ, দেখুন এর গায়ের এই বড় পেরেকের ঠিক নিচে পর্যন্ত আপনার মাথা ঠেকত। মানে, আপনি এসে দাঁড়ালেই আমি যখনই তাকাতাম, অপোজিটে শ্যামলের দোকানের মাকালীর ছবিটার শুধু মাথা দেখতে পেতাম। এখন পুরো ছবিটাই আপনার মাথার পেছন থেকে দেখতে পাই। তাই ভাবলাম...।”
অমরদ্যুতির ঠোঁটের কোণা বেঁকে গেল। একটা তেতো হাসি বেরিয়ে আসতে গিয়েও থমকে গেল। বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল। 

সেদিন সন্ধ্যাবেলা অমরদ্যুতি গেলেন পাড়ার ডাক্তারের চেম্বারে। ছোকরা ডাক্তার বলল, “আপনি বরং কোন হরমোন স্পেশালিস্টের কাছে যান। এ ধরনের সমস্যা হরমোনাল ডিসব্যালেন্স থেকে হতে পারে। আমি ডাক্তার বোসকে রেফার করে দিচ্ছি। নীলরতনের প্রোফেসর ডাক্তার। আমার মাস্টারমশাই। ওনার বাড়িতে চেম্বারেও দেখেন। বালিগঞ্জে বসেন। ইতিমধ্যে আপনি ভালভাবে রেস্ট করুন। টেনশন করবেন না। আমি ভিটামিন আর কয়েকটা স্ট্রেস রিলিজ ওষুধ লিখে দিচ্ছি। আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওনার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিন।” 
এরপর অমরদ্যুতি ডাক্তার বোসের কাছে বেশ কয়েকবার গেছেন। গোছা গোছা টেস্ট লিখে দিয়েছেন উনি। রক্তেরই হাজার রকম টেস্ট। আরো কত টেস্ট। বিদঘুটে সব নাম। গুচ্ছের টাকা খরচ হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গত ছয় মাসে হাইট কমেছে আরও এক ফুট। এখন আর সন্দেহের অবকাশ নেই। সবাই স্পষ্ট বুঝতে পারছে, অমরদ্যুতি বাবু দিনকে দিন বেঁটে হয়ে যাচ্ছেন। 

অঙ্কের তুখোর ছাত্র, চিরকাল কুসংস্কারকে বিদ্রূপের শাণিত তীরে জর্জরিত করা অমরদ্যুতি অবশেষে ঘনশ্যামের গোপন পরামর্শে এক ‘বাবা’র কাছে হাজির হলেন। অতি বদখৎ দেখতে সেই ‘বাবা’ থাকেন লোকালয় থেকে একটু দূরে রেল কলোনি পেরিয়ে একটা পুরনো মসজিদের কাছে। গলির মুখে শুয়োর ঘোঁত ঘোঁত করে বেড়াচ্ছে। মাটির উঠোনে চার পাঁচটা বাচ্চা চ্যাঁ ভ্যাঁ করছে। ঘোমটা মাথায় লোকটার বৌ ঘরের ভিতর পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে কী একটা রাঁধছে, তার ঝাঁঝে বাতাস ভারি হয়ে আছে। কী নরকের ঠিকানাই দিল ঘনশ্যাম! হাতি কাদায় পড়লে শালা ব্যাঙেও লাথি মারে। এখন প্রায় চার ফুট হাইটের অমরদ্যুতি বাবু আর আগের মত বাজার টাজার করতে পারেন না। ছেলেই করছে সেসব। স্ত্রী কান্নাকাটি, ঠাকুরের কাছে মানত কিছুই করতে বাকি রাখেনি। ‘বাবা’ খালি গায়ে একটা বেতের কঞ্চি দিয়ে পিঠের ঘামাচি চুলকাচ্ছিল। অমরদ্যুতিকে দেখে বলল, “য্যায়সি করনি, ওঅ্যায়সি ভরনি।” অসহায় শিশুর মত অমরদ্যুতি বললেন, “মানে? বাবা, আমি কি আমার হাইট ফিরে পাব না?”

বাবা খ্যা খ্যা করে হাসল। হাসতে হাসতে কাশল। তারপর বলল, “দাওয়াই তেরে হাথো মে। তুনে লোগোকো ছোটা কিয়া। তু ভি ছোটা বন গয়া। আভি ইসসে ছোটা মৎ হো যানা। ফির তো গায়েব হি হো যায়েগা!” এই বলে হাসতে লাগল। সে এমন হাসি, আর থামেই না। রাগে অমরদ্যুতির মনে হচ্ছিল লোকটাকে ধরে আচ্ছা করে পেটান। কিন্তু কিছুই করার শক্তি নেই তাঁর। চুপ করে মরা মাছের মত বসে রইলেন। বাবা আবার বলল, “যাঃ, দাওয়াই তেরে হাথো মে হি হ্যায়!”

ঐ বস্তি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অমরদ্যুতি চলে এলেন চিরকালের ভালবাসার পার্কটিতে। কতদিন জগিং-এ আসা হয়নি। লোকের সামনে বের হতে লজ্জা করে। অন্ধকারে একটা বেঞ্চে অনেকক্ষণ বসে ভাবলেন, “লোকটা কী বলছিল? দাওয়াই আমার হাতেই আছে?” বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছেন, পাশ থেকে রামহরি এসে বলল, “অমর, আমি সঙ্গে যাই, তোকে খুব দুর্বল দেখাচ্ছে। চল্, তোর বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।” আধো অন্ধকারে রামহরির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন অমরদ্যুতি, সেখানে বিদ্রুপের ছায়াও নেই। আছে সত্যিকারের দরদ। কৃতজ্ঞতায় তাঁর মনটা ভরে গেল। এই রামহরিকেই একদিন কী যাচ্ছেতাই অপমান করেছিলেন তিনি। সেকথা মনে পড়তে খুব খারাপ লাগল। মুখে কিছু বললেন না। কিন্তু রামহরি নিজেই বলল, “জানিস, তুই সেদিন বলেছিলিস বলেই আমি আগের থেকে এখন অনেক ভাল আছি। সকালে ঘুম ভাঙে না, বেলা হয়ে যায় উঠতে। কিন্তু সন্ধ্যার পর পার্ক ফাঁকা হলে এসে কয়েক চক্কর হাঁটি। আগে রাত্রে খিদে হত না। এখন চনমনে খিদে হয়, ঘুমও ভাল হয়। তুই কিন্তু সেদিন আমার বড় উপকার করেছিস!”

অমরদ্যুতির নিজের যাবতীয় কটু বাক্য স্মরণে আসে। বাড়ি ফিরে তিনি আরেকবার উচ্চতা মাপার যন্ত্রে দাঁড়ালেন। কী আশ্চর্য! নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মেপে গিয়েছিলেন, চার ফুট দুই ইঞ্চি, আর এখন স্পষ্ট চার ফুট ছয় ইঞ্চি। বাবার কাছ থেকে ফিরে চার ইঞ্চি বাড়ল কিভাবে? বাবা বলেছিলেন, দাওয়াই আমার নিজের হাতে। তবে কি নিজের কৃতকর্মের অনুশোচনার ফল? এবার বাবার কথাগুলো স্পষ্ট স্মরণ হয়, “তুনে লোগোকো ছোটা কিয়া। তু ভি ছোটা বন গয়া।” অমরদ্যুতি অন্ধকারে আলো দেখতে পান। জীবনের বাকি দিনগুলো প্রাণপণ চেষ্টায় নিজের দৃষ্টিভঙ্গির ছাঁচ বদলাতে হবে। তবে যদি শেষপর্যন্ত ফিরে পাওয়া যায় হারানো উচ্চতা!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. খুব সুন্দর একটি গল্প। গল্পের বার্তাটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং শাশ্বত।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। মতামত পেয়ে মনে জোর পেলাম।

      মুছুন
  2. খুব, সুন্দর গল্প। বিষয় বস্তু দারুন লেগেছে।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আপনার মতামত পেয়ে খুব ভালো লাগছে।

      মুছুন