ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

বিচিত্র অভিজ্ঞতার সমাহার – রেলমানুষের তদন্তকথা ( দ্বিতীয় খণ্ড) -পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

 


  • লেখকঃ তুষার সরদার
  • প্রকাশনাঃ অভিযান পাবলিশার্স
  • প্রচ্ছদ – পার্থপ্রতিম দাস
  • প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারী ২০২২
  • পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৮৩ (প্রচ্ছদ সহ)
  • মুদ্রিত মূল্য – ৩০০/-

ত মাসে তুষার সরদার রচিত ‘রেলমানুষের তদন্তকথা’ বইয়ের প্রথম খণ্ডের বিষয়ে লিখেছিলাম। জানিয়েছিলাম তদন্তমূলক সত্য ঘটনা সম্বলিত আখ্যান পড়ার মুগ্ধকর অনুভূতি। আজ ‘রেলমানুষের তদন্তকথা’ বইয়েরই দ্বিতীয় খণ্ড পড়ার পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখব। 

‘রেলমানুষের তদন্তকথা’ বইয়ের প্রথম খণ্ডেই লেখকের অসাধারণ বিবরণ দক্ষতার পরিচয় পাই। তদন্তমূলক লেখার ক্ষেত্রেও লেখক ঘটনার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির অসাধারণ বর্ণনা করেছিলেন। দ্বিতীয় খণ্ড তার ব্যতিক্রম নয়। এই বইয়ে এগারোটি গল্প আছে। এগারোটি গল্পে বর্ণিত মূল চরিত্ররা প্রত্যেকেই একজন অন্যজনের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক মানসিকতার মানুষ। জটিলতম ও সরলতম চরিত্রের মানুষদের ব্যবহারও সেই অনুরূপেই প্রকাশ পেয়েছে। কখনও লেখকের প্রাণ সংশয় হতে হতে রক্ষা পেয়েছে, কখনও লেখক মানুষের কুটিলতম মানসিক প্রবৃত্তির পরিচয় পেয়ে মনঃকষ্টে ভুগেছেন, আবার কখনও লেখক মানবিকতা স্নেহ মমতা ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়ে তৃপ্ত হয়েছেন। সাথে সাথে পাঠকও বিভিন্ন অনুভূতিতে বয়ে গেছেন।  বইয়ের এগারোটি গল্প হল -     
১. ছিন্ন তন্ত্রী 
২. বৈশাখে, এক কৃষ্ণচুড়া 
৩. বিচারের বাণী নিভৃতে নীরবে
৪. মৃত্যুর গন্ধ অঘ্রেয়
৫. থির বিজুরি 
৬. ঈশ্বরের দেখা
৭. বিশ্বাস খুনের কাহিনী
৮. মৃত্যু ও নারী
৯. সে আমার ছোট বোন
১০. হে মহাজীবন
১১. মানুষের কাছে 

গল্পের বিষয়বস্তু নিয়ে বিস্তারিত বলার উচিত হবে না। পাঠকের বই পড়ে রসস্বাদন করার আগ্রহ নষ্ট করা প্রতিক্রিয়া লেখার উদ্দেশ্য নয়। এই বইয়ে এসেছেন শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে উপরমহলের অধিকারিককে বরখাস্ত করা মহিলা কর্মচারী, যার অভিযোগের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় নিজেই গৃহবন্দী সমাজচ্যুত। অসুস্থ ও অক্ষম পিতার চাকরি প্রত্যাশী মেয়ে যে ভুয়ো সার্টিফিকেট দিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিতে গিয়েও লেখকের উপদেশ শিরোধার্য করে নিজেকে যোগ্য মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে দ্বিধা বোধ করে না। আছে এক অত্যন্ত নিম্ন মানসিকতার অধিকারিক যিনি বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও জাতিবাদকে প্রাধান্য দিয়ে বর্ণ বিদ্বেষমূলক আচরণ করেন এবং নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে অপরাধের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যান। কর্মরত অবস্থায় মৃত কর্মচারীর জন্য তৈরি হওয়া গণ বিক্ষোভকে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও উপস্থিত বুদ্ধির সাহায্যে লেখক সামাল দেন, তা তারিফের দাবী রাখে। একজন বিত্তশালী বিখ্যাত দাদার বিলাসবহুল প্রাসাদোপম বাড়িতে ঠাঁই হয়না তার একমাত্র অসহায় অসুস্থ বোনের, আবর্জনাময় দুর্গন্ধযুক্ত ভাঙ্গা ঘরে তাঁকে থাকতে বাধ্য করা হলেও মৃত পিতার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সরকারী টাকা বোনের থেকে কেড়ে নিতে এতটুকুও লজ্জিত হন না প্রতিপত্তিশালী দাদা ও বৌদি। অন্যদিকে দেখা মেলে এক দরিদ্র বস্তিবাসী দাদা- বৌদির। যারা নিজের অসুস্থ বোনের চিকিৎসার জন্য নিজেদের সর্বস্ব নিবেদন করে দিতেও পিছপা হন না। লেখক এই সমস্ত ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে প্রবেশ করেছেন মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে। যেমন পেয়েছেন প্রাণ নাশের হুমকি তেমনিই সঞ্চয় করেছেন মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। এই সমস্ত তদন্ত রেলকর্মচারীদের মূলত অপরাধ – মিথ্যাচার প্রভৃতি নির্ণয়ের জন্য করা হলেও তা অনেকসময়ই শুধু তদন্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত না। করতে হত বিভিন্ন জটিল সমস্যার সমাধানও। এবং এই সমস্ত ক্ষেত্রে শুধুমাত্র জীবিত বা মৃত রেলকর্মচারীরাই নয় তদন্তের আওতায় চলে এসেছেন তাঁদের পরিবার পরিজনরা। অনেক সময়েই উন্মোচিত হয়ে গেছে তাঁদের গোপন ঘনিষ্ঠ জীবনও। এইরকমই বহু চরিত্র ও তাঁদের বিচিত্র বর্ণময় জীবনের অনুভুতি - চিন্তাভাবনার গোলকধাঁধা – অসহায়তা – সম্পর্কের জটিলতা সম্বলিত বিভিন্ন গল্পকথা নিয়েই রচিত হয়েছে রেলমানুষের তদন্তকথার দ্বিতীয় খণ্ড।    

এই বইয়েও পূর্বের খণ্ডের মতই লেখক অসাধারণ গদ্য রচনা করেছেন। কখনও মনে হয়না আমরা সত্য ঘটনার তদন্ত কাহিনী পড়ছি। কিছু কিছু পরিস্থিতি এবং অনুভুতির বর্ণনা বিভূতিভূষণ যুগের ছোঁয়া দিয়ে যায়। তাঁর বর্ণনার মাধ্যমে পাঠক অনুভব করতে পারেন তাঁর অনুভূতিও। যেমন তিনি এক বিশেষ ক্ষেত্রে নিজের অতিরিক্ত সজাগ থাকা বোঝাতে বলেন – 

এ বাড়ির বাইরের দরজায় টোকা দেবার আগে এক উদবিগ্ন সতর্ক সজারুর মতো পিঠের কাঁটাগুলো পুরো উঁচিয়ে নিয়েছিলাম। এরমধ্যে সেই কাঁটাগুলো কখন যেন আস্তে আস্তে পিঠের উপর খানিকটা শুয়ে পড়ছিল। ছেলেটির উত্তরটি শোনামাত্রই আমার পিঠের সেই অদৃশ্য কাঁটাগুলো আবার ঝাঁ ঝাঁ করে পুরো উঁচিয়ে উঠল – 


একটি বর্ণনাসমৃদ্ধ তুলনা না বলতেই হয় – 
ভঙ্গিতে দাঁড়ানো যে তার গুরুভার শ্রোণিরেখা অতি স্পষ্ট দুই চোখের সচল তারা আর শ্বাসপ্রশ্বাসে ভারী বুকের ওঠা-নামা ছাড়া সম্পূর্ণ দেহ কোনো অপরাপ ভাস্কর্যের মতো স্থির... ।


কোনো যুবতি নারীর না-সাজার সাজ যে কী ভয়ংকর এক সাজ হয়ে উঠতে পারে তাকে দেখে এই প্রথম বুঝলাম, মর্মে মর্মে বুঝলাম। আরও একটা ব্যাপার বুঝতে খুব বেশি অসুবিধা হল না, এইরকম উপচানো সাজে সে এখন ঘরের খোলা দরজায় এমন এক রুদ্ধ প্রবল স্রোতের মতো ওইভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন।


একটু আগে দেখা একগাছ যুবতি কৃষ্ণচূড়া ফুল এখন অন্যতর রূপে তার তীব্র মদিরতা নিয়ে চলে এসেছে সামনে, শতহস্তে বেষ্টন করে নিচ্ছে আমায়। রূপের এমন আগ্রাসী বহ্নি আগে কখনও এমন একান্তে এবং এমন লভ্যতায় আমার মুখোমুখি আসেনি।


আমার গলা বুকের মাঝে আস্ত তীব্র বৈশাখে ঢুকে পড়েছে কখন। সর্বত্রই মরুর শুষ্কতা। ক্রমাগত ঢোক গেলার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছি। পা দুটো কী ভীষণ ভারী হয়ে উঠছে এক অবদ্য আচ্ছন্নতায়! কান মাথা সব গরম আগুনখেকো হল্কায় ভরে যাচ্ছে।


 এই রকম অফুরন্ত মণিমুক্তো ছড়িয়ে আছে এই বইয়ের আনাচে কানাচে, যা তদন্ত কাহিনীগুলিকে সাহিত্যরসে ভরে তুলেছে। প্রথম পাতা থেকে শুরু করে শেষ পাতা অবধি না পড়া অবধি পাঠক এক মুহূর্তও অবসর নিতে পারেন না। বাংলা সাহিত্যের সত্য ঘটনা সম্বলিত তদন্তকাহিনীর ঘরানায় এই বই সদা উজ্জ্বলভাবে অবস্থান করবে। তিনটি খণ্ডই সংগ্রহে রাখার মত। রেলমানুষের তদন্তকথা বইয়ের তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে, তার বিষয়ে পরে একদিন আলোচনা করব। 


Document

পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

মধ্যবিত্ত পরিবারের অতি সাধারণ গৃহবধূ। কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিবেশের ছোঁয়ায় শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে আগ্রহ ও ভালোবাসা। বর্তমানে স্বদেশ থেকে বহুদূরে বিদেশে এসে সেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অভাববোধ থেকে তৈরি হওয়া শূন্যতা পূরণের অবলম্বনরূপে লেখার শুরু। পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরও লেখা পড়তে ক্লিক করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ