ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

একটি গো-সভার গোপন কথা -সুভাষ কর


কো

ন বড় শহরের কোন মূল রাস্তায় এত গরু একসাথে আমি আগে আর কখনো দেখিনি। আমি রাজধানী দিল্লীর কথা বলছি। কলকাতার কাছে কেষ্টপুরে আমাদের পাড়ায় মেন রোডের ঠিক পাশেই এক বাড়ীর ভেতর অবশ্যি একটা খাটাল রয়েছে; তাতে সযত্নে গোটা দশ বারো গরু এবং গোটা সাত আটেক মোষের লালনপালন হয়। এদের সবাইকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মীটি মাঝে মাঝে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লে সে কি বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটে! একে তো রাস্তা সরু, তা-ও খানা-গর্তে ভরপুর। যানবাহন ও পথচারীদের দুর্দশার শেষ থাকে না। প্রথম যখন ঐ পাড়ায় এসেছিলাম, তখন একপাল ভেড়াও ঐ দলে শামিল ছিল; তবে ওদেরকে আলাদাভাবে নিয়ে বেরুনো হ'ত। নতুন পাড়ার প্রতি জন্মানো প্রথম প্রেম থেকেই কিনা জানিনা, ভেড়ার পালটাকে দেখে তখন মনে হ'ত যেন কাশ্মীরের কোন গ্রামের সান্নিধ্য পাচ্ছি। ক্রমে একটা সময় ওদের শারীরিক রুগ্ন দশা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে দেখে করুণা হ'ত। যাই হোক, ইদানীং এক অজ্ঞাত কারণে ঐ বেচারা ভেড়াদেরকে আর দেখা যায় না। তবে গরু আর মোষের সেই দলটি বহাল তবিয়তে সময়ে সময়ে পাবলিককে দর্শন দিয়ে যাচ্ছে, এবং সমানে মলমূত্র, দুর্গন্ধ ইত্যাদি যা বিলোবার বিলিয়ে যাচ্ছে।

দিল্লীর গো-দর্শনের কথায় ফিরে আসি। সন্ধ্যেবেলায় কাল্কাজী অঞ্চলের 'মন্দাকিনী এনক্লেভ'-স্থ মেয়ের বাড়ী থেকে বেরিয়ে দুই ধারে ফুটপাতওয়ালা চওড়া রাস্তা 'শহীদ সূর্যসেন মার্গ' দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। মাঝখান দিয়ে ফুট চারেক চওড়া ডিভাইডার। ফুটপাত দিয়েই হাঁটাটা নিরাপদ হলেও সেটা অবিচ্ছিন্নভাবে বাধাহীন ছিল না বলে ইচ্ছে করেই ফুটপাত-ঘেঁষা রোডসাইড দিয়ে হাঁটছিলাম। এখান দিয়েও মাঝেমাঝে ফুটপাতের ওপাশটায় গুঁড়ি থাকা গাছগুলোর রাস্তায় নুয়ে পড়া বিস্তৃত ডালপালার বাধা সাবধানে এড়িয়ে যেতে হচ্ছিল। এরই মধ্যে হঠাৎ উল্টোদিক থেকে মহাদেবের বিশেষ কৃপালব্ধ ঐ জীবকুলদের স্রোত ছুটে আসছিল। হ্যাঁ, স্রোতই বলব, কারণ সংখ্যায় এরা গোটা তিরিশের কম হবে না। তাছাড়া সবাই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে একসাথেই আসছিল এবং আমারই সাইড বরাবর। আমি বিপদ এড়াতে সময় থাকতেই ফুটপাতে উঠে গেলাম। ওরা হঠাৎই দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি দল ডিভাইডারে উঠে গেল, আর অন্যদলটা যতটা সম্ভব ফুটপাতের দিকে ঘেঁষে হাঁটতে লাগল। লক্ষ্য করলাম আমার পেছন দিক থেকে আসা একটা বাস রাস্তার বাকী খালি অংশটুকু দিয়ে অনায়াসে বেরিয়ে গেল। শুধু তুলনায় স্পীড একটু কম ছিল, এই যা। আমার মন বলল, বিরাট আকৃতির বাসটাকে রাস্তা করে দিতেই ওরা দুভাগ হয়ে গিয়েছিল। এবার ডিভাইডারে উঠে যাওয়া গরুগুলো এগিয়ে যেতে লাগল বটে, কিন্তু মূল রাস্তায় আমার দিকটায় থাকা গরুর দলের একে একে প্রায় সবাই বড় একটা গাছের ছড়ানো ডালপালার নীচটায় বসে পড়ল। আমার মনুষ্যভাবনায় মনে হ'ল বুঝি এখনি ওরা নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করে নিতে চায়।

আমার যুবক বয়সে একদা বঙ্কিমচন্দ্রের 'আফিংখোর কমলাকান্ত' চরিত্রটির আত্মীকরণের মাধ্যমে আমার মধ্যে একটা বিশেষ ক্ষমতা জন্মেছিল। প্রয়োজনে কমলাকান্তের ধ্যানে মনোনিবেশ করলেই কিছুক্ষণ পর ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বিনা আফিংয়েই আমি বহু মানুষের এমনকি বহু প্রাণীরও মনের অব্যক্ত কথাবার্তা স্পষ্ট শুনতে পেতাম। মাঝখানে অবশ্যি অনেকগুলো বছর চলে গেছে। তবুও খুব ইচ্ছে ও কৌতুহল হ'ল- যদি এই গরুদের আলোচনার অংশবিশেষও শুনতে পাই! ফুটপাতের এক পাশে একটি ইটবাধানো বেদীমতো আসনও পেয়ে গেলাম- আয়াসে ধ্যানস্থ হ'বার এই সুযোগ আর হাতছাড়া করলাম না। সেখানে বসে ধ্যাননিমগ্ন হয়ে অর্ধ নিমীলিত চোখে মিটিংয়ে উপস্থিত গো-সভ্যদের দিকে তাকিয়ে কান পেতে রইলাম। নিমেষেই বুঝলাম- হ্যাঁ, আলোচনা বেশ জমে উঠেছে। একটি মাতব্বর গোছের গরু সবাইকে বলছে- "বন্ধুরা! আজকের মূল বিষয়ে আসার আগে আমাদের আগের সভার অর্ধসমাপ্ত আলোচনাটা সেরে নিতে চাই। কি, সবাই রাজী তো?"

একটি রোগা পাতলা বৃদ্ধ গরু অধৈর্য হয়ে বলল, "আবার সেই 'গোমাতা' প্রসঙ্গ?"


—  হ্যাঁ, 'গোমাতা' প্রসঙ্গই। কারণ আমাদের কেউ কেউ এখনো এ বিষয়ে মোহান্ধ হয়ে আছে। আমাদের বোঝা উচিত গরুরা শুধুই আমাদের সন্তান অর্থাৎ বাছুরদেরই মা। হ্যাঁ, গরুর দেয়া দুধ এবং অন্য আরো কিছু জিনিষ মানুষের উপকারে আসে, তাই ওদের কেউ কেউ কৃতজ্ঞতাবশতঃ গরুদেরকে 'মাতা' বলে আখ্যায়িত করে। কিন্তু শুধু সেই কারণেই কেউ কারো মা হয়ে যায় না। সবচেয়ে বড় কথা, কিছু মানুষ 'গোমাতা' 'গোমাতা' বলে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করে। তাদের অন্তরে আমাদের জন্যে প্রকূত কোন শ্রদ্ধাবোধ নেই, অথচ 'গোমাতা' 'গোমাতা' বলে শোরগোল তুলে ওরা এমনকি খুনখারাবি করতেও পিছপা হয় না। ঐ জাতীয় স্বার্থান্বেষীরা শুধু মানুষ জাতিরই শত্রু নয়, ওরা আমাদেরও নাম খারাপ করার কারণ। আমরা কি কখনো ওদের হাতে এমনভাবে ব্যবহৃত হতে চাইতে পারি?


সভা থেকে সম্মিলিত আওয়াজ উঠল, "কক্ষনো না"।

এক গোবেচারা চেহারার হৃষ্টপুষ্ট গরু বলল, "আমরা তো নিজেরা তেমনটা চাইনি, কিন্তু ওরা 'গোমাতা' বলে ফেললে আমাদের কিই বা করার থাকে?

—  তাই তো সেদিন আমার প্রস্তাব ছিল এই 'গোমাতা' সম্বোধনে আমরা যেন গলে না যাই। ব্যস, ঐটুকুই।

রোগা পাতলা বৃদ্ধ গরু এবার জোর গলায় বলল, "বোঝা গেল। এখন থেকে আমরা মানুষের 'মাতা' সম্বোধনে কেউ বিগলিত হব না, বরং সতর্ক থাকব। কি হে, অন্যেরা সবাই একমত তো?"

আবারও সভা থেকে সম্মিলিত আওয়াজ উঠল, "রাজী, রাজী"।

প্রথম বক্তা বলল, "সবাইকে ধন্যবাদ! এবার তাহলে আজকের মূল আলোচনায় আসছি। আমার যে কথাটা বলার, তা হ'ল- এখানে স্বাধীনভাবে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে, বিশেষ দিনে বিশেষ বিশেষ মন্দিরপার্শ্বে বা নির্দিষ্ট কিছু স্থানে ভক্তদের বিলানো খাবার খেয়ে খেয়ে আমাদের যেন আত্মতুষ্টি চলে না আসে। আমাদের ভাগ্য ভাল যে এতদিন বঙ্গদেশ হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যাবার বিপদ থেকে আমরা জবর বেঁচে গেছি। তোমরা অনেকেই ইতিমধ্যে জেনে গেছ- বঙ্গদেশে বিশেষ যে জেলাটি থেকে এই কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত হ'ত, সেটা এখন বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার শ্যেনদৃষ্টির কবলে। সংশ্লিষ্ট অপরাধী বহু নেতাকর্মী একে একে ধরা পড়ছে; এমনকি সীমান্তে পাহারারত কিছু কালপ্রিটও তাদের তৈরী প্রাথমিক অভিযোগপত্রের বাইরে নেই …"

—  তাহলে আত্মতুষ্টি না আসার মতো কি ঘটল, একটু খুলে বলবে কি?

—  আরে বন্ধু, সেটাই তো বলছি। তোমরা কি জেনেছ, ঐ পাচারকাণ্ডে অভিযুক্ত জাঁদরেল পাণ্ডাদের অনেকেই এখন খোদ এই দিল্লীতেই বিরাজমান? একজন তো একেবারে সপরিবারে, সবন্ধু! না, না, উতলা হয়ো না, ওরা কেউই বর্তমানে আমাদের মতো স্বাধীন অবস্থায় নেই। ওরা এখন তিহার জেলে বন্দী অবস্থায় আছে।

—  তবে তো ল্যাঠা চুকেই গেল; ওরা কোনদিনই আর আমাদের নাগাল পাবে না। মিছিমিছি এত ভয় পাব কেন?

—  সেটাই তো মুস্কিল। ওদেরকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে চারদিকে কম চেষ্টা হচ্ছে না। ক্ষমতাবান নেতামন্ত্রী, দেশের স্বনামধন্য উকিল সাহেবরা অনেকেই সেই চেষ্টায় শামিল। আর সব চাইতে দুর্ভাবনার কারণটা হ'ল মনস্তাত্ত্বিক। দিল্লীর উপরই তাদের রাগ সর্বাধিক, কারণ তাদের ধারণা সেই গোয়েন্দারা দিল্লীর কথায়ই চলে। আর জেলের বাইরে কোথায় কি হচ্ছে, কে কি বলছে সব খবর কিভাবে যেন দ্রুত তাদের কাছে পৌঁছেও যায়- অন্ততঃ বঙ্গদেশে এর প্রমাণ পাওয়া গেছল।

—  তো?

—  তো একবার যদি ওরা আমাদের গতিবিধির খবর ঠিক ঠিক পেয়ে যায় তাহলে আমরাই কিন্তু ওদের পরবর্তী টার্গেট হব। তখন ইউ পি, বিহার ভুলে দিল্লীর থেকে বেশী বেশী করে ট্রাকগুলো বাংলার দিকে যেতে থাকবে, আর কোন্ ট্রাকে যে কখন আমাদের কাকে উঠিয়ে নেবে তা কিন্তু কেউ বলতে পারবে না। এতে যদি ওদের আর্থিক খরচ বেশীও হয়, তাও ওরা মেনে নেবে- স্রেফ দিল্লীর প্রতি আক্রোশ বশতঃ। সর্বোপরি, সব খরচই তো ওরা শেষ অব্দি পুষিয়েই নেয়।

—  হু, এবার বুঝলাম বন্ধু- সমস্যা বেশ গভীরে! তা এখন আমাদের কি করতে বল?

—  ঐ, আমাদের একটু সাবধানে চলাফেরা করতে হবে আর কি! আর বরাবর জুটে যাওয়া খাবারের বাইরে কোন অতিরিক্ত লোভনীয় খাবারের ফাঁদে যেন আমরা কেউ না মজি। জান তো, মানুষেরা বলে- "অতি লোভে তাঁতি নষ্ট!"

—  বুঝলাম বন্ধু। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। আমরা এখন থেকে অনেকটাই সতর্ক থাকব। আর তুমি যেমনটা বলেছ- অতিরিক্ত কোন লোভও করব না।

—  এবার চল উঠা যাক। আমাদের বাকী বন্ধুরা ডিভাইডার ধরে অনেক দূরে চলে গেল। ওদেরকেও সাবধান করে দিতে হবে।

—  হ্যাঁ, চল সবাই, চল।


গরুরা সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে পড়ে, এবং তাড়াতাড়ি আমার গতিমুখের বিপরীত দিকে প্রায় দৌড়াতে থাকে। আমি আবার একা হয়ে গিয়ে কমলাকান্তের ধ্যানে ইতি টেনে আমার নিজস্ব জগতে ফিরে এসে ধাতস্থ হলাম। মনে মনে ভাবি- সবার আড়ালে একান্তে এই উপলব্ধির মূল্যও নেহাৎ কম নয়।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ