ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

বৈচিত্রময় মানব চরিত্রের সমাহারঃ "রেলমানুষের তদন্তকথা" - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

  • বই– রেলমানুষের তদন্তকথা
  • লেখক– তুষার সরদার
  • প্রকাশক– অভিযান পাবলিশার্স
  • প্রথম প্রকাশ– জানুয়ারী ২০২০
  • প্রচ্ছদ– পার্থপ্রতিম দাস
  • পৃষ্ঠা– ১৯১
  • মূল্য–  ২৫০/-

ভারতীয় রেল। পৃথিবীর বৃহত্তম রেলওয়ে নেটওয়ার্ক। দেশ জুড়ে জাল বিস্তার করে সমগ্র দেশকে এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে জুড়ে রেখেছে। এই বৃহৎ মন্ত্রকে অকালমৃত, নিরুদিষ্ট বা কোনও আকস্মিক কারণ বশত সময়ের আগেই অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক, কর্মচারী ও অধিকারিকদের পরিবারের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও সাহায্যের জন্য ভারতীয় রেলে সম্পূর্ণ পৃথক একটি দপ্তর আছে। এই দপ্তর কর্মরতদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্যও কাজ করে থাকে। এই সব কাজ ছাড়াও এই দপ্তর সমগ্র রেল পরিবারের অন্তর্বর্তী বিভিন্ন জটিল ঘটনার তদন্ত করে সমাধান করে। লেখক তুষার সরদার এই দপ্তরে একজন চিফ পার্সোনাল ইন্সপেক্টরের পদে দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর সসম্মানে চাকরি করেছেন। চাকরি সূত্রে লেখককে বিভিন্ন মন মানসিকতার ও বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানের মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়েছে। এক একজন মানুষের এক এক রকমের সমস্যা ও জীবনের গতি প্রকৃতির ঘূর্ণিপাক। বহু মানুষের বহু ধরণের সমস্যার সমাধানে লেখককে ঘুরতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। মৃত কর্মচারীর পরিবারের অনুসন্ধানে পার হয়েছেন দুর্গম রাস্তা। অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে সঞ্চিত হয়েছে মণিমাণিক্য। সেই সমস্ত অভিজ্ঞতার ডালি তিনি সাজিয়ে দিয়েছেন “রেলমানুষের তদন্তকথা” বইয়ে। এই বইয়ে মোট এগারোটি গল্প আছে। যদিও রহস্য অক্ষত রাখার তাগিদে গল্পের বর্ণনায় আমি যাবনা। গল্পগুলো হল - 
 
১. নিরুদ্দেশের গহনে।
২. পাখী মেয়ের অপরূপকথা। 
৩. নারী বড় বিচিত্ররূপিণী।
৪. মৃতদেহ অথবা লাভের কড়ি।
৫. ভ্রষ্ট জায়া – জননী।
৬.অপরাধী ও “অপরাধ”।
৭.মা-হারার সন্ধানে। 
৮. গৌরী দে র বৃত্তান্ত ।
৯. নারী দক্ষ যাদুকরী।
১০. প্রতারণার বেড়াজাল।
১১. পাহাড়ের মতো মানুষ। 

কর্মরত অবস্থায় অকালমৃত্যুর শিকার, রোগ বা বিকলাঙ্গ হওয়ার কারণে অবসরপ্রাপ্ত কিংবা  নিরুদ্দেশের গহনে হারানো কর্মরত কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যদের সুবিধার জন্য  পেনশনের ভাতা থেকে শুরু করে উত্তরাধিকার সূত্রে পরিবারের একজন সদস্যকে চাকরি দেওয়া পর্যন্ত তাদেরকে প্রাপ্য কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দেয় ভারতীয় রেল। তবে সঠিক ও সুযোগ্য দাবীদারের কাছে তাঁদের অধিকারের বস্তু ঠিকভাবে পৌঁছালো কিনা সেটা নিশ্চিত করতে হয় সবার আগে। দাবিদার মাত্রই যে প্রকৃত উত্তরাধিকারী তা নয়। কম্পেনসেশন-পেনশনের টাকার প্রতি লোভ, সরকারি চাকরির প্রতি লোভ ছেলে – মেয়ে – স্বামী – স্ত্রী এমনকি পিতা – মাতাকে দিয়েও করিয়ে নেয় বহুবিধ অমানবিক অপরাধীমূলক কাজ। অনেক সময় এই সমস্ত অপরাধের হদিশ পুলিশ প্রশাসনেরও দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায়। এর উপর থাকে উপর মহলের ও রাজনৈতিকমহলের বিভিন্ন নেতা মন্ত্রীদের বিভিন্ন চাপ। এই সমস্ত বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করেও সমস্যা সমাধানের জন্য দরকার হয় তদন্ত। নিখুঁতভাবে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন হয় দাবীদারের পক্ষ থেকে পেশ করা প্রাপ্ত তথ্যের। সুদীর্ঘ ছাব্বিশ বছরের তদন্তমূলক কর্মজীবনে লেখককে তদন্তের খাতিরে বহু মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে প্রবেশ করতে হয়েছে। আর তার থেকেই মানব মনের জটিল গোলকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে মানুষ চেনার, মানুষের ব্যবহার দেখে তাঁর সম্পর্কে ধারণা করার এক বিরল ক্ষমতা অর্জন করেছেন তিনি। 

‘রেলমানুষ’ লেখক কাজের সূত্রে পরিচিত হয়েছেন এমন সমস্ত মানুষদের সাথে যারা জীবনের ভিন্ন ভিন্ন জটিল সমস্যায় জর্জরিত। কারো জীবনে প্রিয়জন হারানোর শোক এসেছে হঠাৎ করে, কেউ প্রিয়জনকে হারিয়েছেন দীর্ঘ রোগভোগের পর আবার কেউ নিজেই লোভের বশবর্তী হয়ে কেড়ে নিয়েছেন প্রাণ। কেউ আকস্মিক কোনও পরিস্থিতির শিকার হয়ে চাকরি থেকে অবসর নিতে বাধ্য হয়েছেন অথচ তাঁর পেনশনভাতার দরখাস্ত থেকে উঠে আসে এক অনন্য কাহিনী। আবার কারো নিরুদ্দেশের সন্ধানে তাঁর পরিবারের খোঁজ করতে গিয়ে ‘রেলমানুষ’ অর্জন করেছেন গায়ে কাঁটা দেওয়া এক অভিজ্ঞতা। এক একটি গল্প এক একজন মানুষের বিচিত্র মানসিক দিক উন্মোচন করে। মায়া- মমতা – ভালোবাসায় মোড়া মন থেকে শুরু করে হিংসা-লোভ- কুটিলতা – ব্যাভিচারের মত জটিলতায় আবদ্ধ মন উন্মোচন করে বাকরহিত হয়ে গেছেন 'রেলমানুষ'। 

তদন্তমূলক সত্যিঘটনা পড়ার আগ্রহ থেকে এর আগে সুপ্রতীম সরকারের "গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার", চিত্রদীপ চক্রবর্তীর “আড়ালে আততায়ী” বা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের “দারোগার দপ্তরে” বইগুলো পড়েছিলাম। তাই এই বইয়ের বিষয়বস্তু সত্য ঘটনা সম্বলিত তা জানার পর খুব স্বাভাবিকভাবেই এই বই পড়ার জন্য আগ্রহী হই। এই বইয়ের ঘটনাগুলো হয়ত অন্যান্য তদন্তমূলক বইয়ের ঘটনার ন্যায় রোমহর্ষক নয়; কিন্তু এই বই অন্যান্য অনেক বইয়ের ভিড়েও স্বতন্ত্রতা দাবী করে বেশ কয়েকটি কারণে।
 
এক - বইয়ের ভাষা অত্যন্ত সাবলীল ও সহজবোধ্য। মাটির কাছাকাছি থেকে সাধারণ পাঠকের জন্যই যেন লেখা। বইয়ের কোনও একটি অংশও এমন নেই যা বুঝতে কারো অসুবিধা হবে। অযথা দুর্বোধ্য এবং বিপুল পরিমাণ তথ্য দিয়ে পাঠককে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা নেই। সহজবোধ্য ও সাবলীল কথ্য ভাষার ব্যবহার লেখা মনোগ্রাহী করে তুলেছে।  
   
দুই – প্রাপ্তবয়স্ক বিষয়ও অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে শালীনতা বজায় রেখে যে যথাযথভাবে পেশ করা যায় তার উৎকৃষ্ট নমুনা এই বই। প্রাপ্তবয়স্ক বিষয়কে সঠিক স্থানে, সঠিক মাত্রায় এবং অবশ্যই প্রয়োজনে তা প্রকাশ করা হয়েছে। অযথা শুধুমাত্র বইয়ের বিক্রি বাড়ানোর অভিপ্রায়ে জোর করে তা আরোপ করা হয়নি।  

তিন – অকারণে শুধুমাত্র পৃষ্ঠা সংখ্যা বাড়ানোর জন্য কোনও বিষয়েরই অকারণ বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বই পাঠের গতি রোধ করা হয়নি।  

চার – সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল অন্যান্য তদন্তমূলক বইয়ের মত এটি কাঠখোট্টা রসহীন নয়। যে কোনও একটি ঘটনার বিবরণে পরিবেশ ও পরিস্থিতির ভূমিকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় স্থান দখল করে। লেখক নিপুণভাবে, একজন দক্ষ চিত্রকরের ন্যায় ঘটনার পরিবেশ ও পরিস্থিতির আনুষঙ্গিক বর্ণনা করেছেন। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল যেন কোনও কবি গল্প রচনা করেছেন। প্রায় প্রতিটি গল্পেই ছোট ছোট অথচ নিখুঁত সেই সমস্ত বর্ণনা আমাদের মুগ্ধ করে দেয়। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ দিতে চাই।

জরাগ্রস্ত প্লাস্টার খসা নোনা ঘেয়ো দেয়াল। বারান্দায় একসময় ইটের খোয়া দিয়ে ঢালাই ফেলা হয়েছিল। এখন খোয়াগুলো এখানে-ওখানে উঠে গেছে। ফলে খুব এবড়োখেবড়ো হয়ে গেছে বারান্দাটা। ওপরে পুরোনো টালির অসমতল ছাউনি। একটু জোরালো বৃষ্টি হলেই চুইয়ে জল পড়ে বারান্দায়। ভিজে ভিজে হয়ে আছে এখানে-ওখানে। পরের ভেতরেও তাহলে জল পড়ে মনে হয়৷

বারান্দায় সামনে নীচে একচিলতে উঠোন। একটা কোণে এক শীর্ণ ফুল- ফলহীন পেঁপে গাছ খুব কুণ্ঠিত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। উঠোনের বাকি অংশ লম্বা লম্বা ঘন ঘাস আর নানান আগাছায় ভরতি হয়ে আছে। তার ভেতর থেকে সম্ভবত পোকামাকড় খুঁজতে থাকা একটা মাঝারি আকারের হেলে সাপ আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে একটু থমকে গিয়ে আবার ভেতরে ঢুকে গেল।

বারান্দার একধারে একটা রং-চটা টিনের চেয়ারে বসে আছি। ঘামছি।

আবহাওয়ার অবস্থা বোঝাতে লেখক বলেছেন– 

বর্ষার পড়ন্ত দুপুর। আকাশে মেঘের আনাগোনা নেই আজ। আছে বিচ্ছিরি গুমোট গরম আর স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া। এই দেখা যাচ্ছে রোদ ঢেকে দিয়ে মোটা মোটা মেঘ ঝুলে পড়ছে • আবার একটু পরেই পাতলা মেঘের চাদর ঢাকা রুগ্‌ণ ঘোলাটে রোদ্দুর। ঘোলাটে রোদ্দুর দেখলে কেন জানি না আমার বড়ো মন খারাপ হয়।

বিবিধ মানব চরিত্রের সংস্পর্শে এসে তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়ের খোঁজ নিতে গিয়ে মানুষকে চেনার যে বিরল ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন সেই প্রসঙ্গ ব্যক্ত করেছেন – 

কখনো-কখনো কাউকে,কোনো মানুষকে দেখবার পরই আমার এক রকম অদ্ভুত অনুভূতি হয়। এর পেছনে আমার কোনো সচেতন বা সক্রিয় ভূমিকা থাকে না। সকলের ক্ষেত্রে সবসময়ই যে এমনটা হয় তাও না। কাউকে কাউকে দেখবার পর মনে হয়েছে,- এ পেটসর্বস্ব, - কেউ বা দেহ সর্বস্ব, কেউ হয়তো জ্ঞান-নম্র,-কেউ বা বেয়াড়া রাগী,-কেউ বা খুব স্পর্শকাতর, কারো মাঝে ভারী বিনয়,সৌজন্যবোধে অনন্য,- কারো চোখেমুখে স্পষ্ট খুনীর করাল ছায়া।

অবশ্য শুধু পুরুষ নয়, নারীও আমার মনে বিচিত্র ভঙ্গে প্রতিফলিত হয়। কেউ ভীমক্রোধা,- কেউ বা বাগেশ্রীর অবরোহণের কোমল গান্ধার। কারও হাবভাব শ্রাবণের মেঘের মতো কোমল সিক্ত,কেউ হয়তো মরুভূমির কণ্টকপূর্ণ ক্যাকটাস। এইমাত্র কাঁচাঘুম-ভাঙা চেহারায় যে নারী এসে দাঁড়িয়েছে, তার সারা শরীরে লেপ্টে আছে নিবিড় অপার বাৎসল্যের মেদুরতা। 

এই সমস্ত কারণকেও ছাপিয়ে যায় এক একটি ঘটনার জটিল সমাধানে তাঁর উপস্থিত বুদ্ধির চমক, অসম্ভব কঠিন পরিস্থিতিতেও যা তাঁকে নিজের কর্তব্যে অবিচল থাকতে সাহায্য করে। শত প্রলোভন, শত নিষিদ্ধ হাতছানিও তাঁকে নিজের কাজের থেকে গাফিলতি করতে বা চারিত্রিক পদস্খলনে ব্যর্থ হয়। আমরাও খোঁজ পাই এক অজানা অচেনা ‘রেলমানুষ'-এর এবং তাঁকে ঘিরে তৈরি হওয়া একগুচ্ছ জটিল–কুটিল–মানবিক–শান্ত–অশান্ত–বিবেকবান–বিবেকহীন মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা এক রহস্যময় জগতেরও। 


Document

পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

মধ্যবিত্ত পরিবারের অতি সাধারণ গৃহবধূ। কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিবেশের ছোঁয়ায় শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে আগ্রহ ও ভালোবাসা। বর্তমানে স্বদেশ থেকে বহুদূরে বিদেশে এসে সেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অভাববোধ থেকে তৈরি হওয়া শূন্যতা পূরণের অবলম্বনরূপে লেখার শুরু। পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরও লেখা পড়তে ক্লিক করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ