মনের প্রশান্তি এবং মস্তিষ্কের খাদ্যের যোগান দাতা বই। পৃথিবীতে সবচেয়ে দামি পূঁজি হচ্ছে জ্ঞান আর এই জ্ঞান তৈরি করা কিংবা অর্জনের কাঁচামাল হচ্ছ বই। মনীষীদের কথায়-"বই হচ্ছে শ্রেষ্ট বন্ধু" উক্তিটির সাথে একমত হয়ে একটু বাড়িয়ে বলতে চাই -"পৃথিবীর সমস্ত সম্পর্কের উর্ধ্বে বইয়ের সাথে সম্পর্ক "। একাকিত্বের জীবনে সবাই চলে গেলেও একটা বই নিজেকে পথ দেখায়। কখনো স্থির হয়ে যাওয়া জীবনের ইঞ্জিন স্বরূপ কাজ করে একটি ভাল বই। বই একটি অসুস্থ মস্তিস্ককে পরিপূর্ণ সুস্থ করে তুলে। নম্রতার প্রশিক্ষণ মেলে বইয়ের পাতায়। বিনয়ী হওয়ার মহাষৌধ একমাত্র বইয়ের বাক্যে পাওয়া যায়! বই বাহ্যিকভাবে মৃত আত্মায় প্রাণের সঞ্চার করে। বইয়ের জগতে ঘুরতে গিয়ে কখনো ক্লান্ত হতে হয়না একজন বই প্রেমীকে। বইয়ের পাতায় ফুটে উঠে সুখ, ফুটে উঠে দুঃখ-বেদনার করুন রস। বইয়ের পাতায় বিক্রি হয় হাসি-কান্নার মত আবেগীয় জিনিস। একই বইয়ের প্রথম বাক্যমালা যেমন হাসায় তেমন শেষের দিকে চোখের জল বয়ে আনে। আলো যেমন জাগতিক নিয়মে অন্ধকার দূর করে সব কিছু মূর্ত করে , তেমনি বই মানুষের মনের ভেতরে জ্ঞানের আলো এনে যাবতীয় অন্ধকারকে দূর করে চেতনার আলোতে সবকিছুকে উদ্ভাসিত করে দেখায়। আলো শুধু ভৌগোলিক ভাবে ছড়িয়ে যেতে পারে। আর বই অতীত থেকে ভবিষ্যৎ , নিকট থেকে দূরে , প্রান্ত থেকে অন্তে এমনকি যুগ থেকে যুগান্তরে জ্ঞানের আলোকে পৌঁছে দিতে পারে । তাই দেশ কালের সীমানা অতিক্রম করে জ্ঞানের আলোকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে একমাত্র বই । পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষা হল আত্মশিখন । আর বই সেই আত্মশিখনের শ্রেষ্ঠ সহায়ক । বিনোদন থেকে শিক্ষা , অবসর যাপন থেকে নিঃসঙ্গতা দূরীকরণ,অজানার অভ্যন্তরে প্রবেশ কিংবা জীবনে সংগ্রামে ঠিকে থাকার মূলমন্ত্রও বইয়ে পাওয়া যায়। সবকিছুতেই বই শ্রেষ্ঠ অবলম্বন হতে পারে।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বলেছিলেন ”বইয়ের মত এত বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই"। বইকে বন্ধু মনে করে জীবনে চালানোটা সহজ। তথাকথিত নামে মাত্র বন্ধুর থেকে সহস্রগুণ ভাল একটি মানসম্মত বই। বই সবার বন্ধু হয়ে উঠোক।
মার্ক টোয়েনের ভাষায়-
"ভাল বন্ধু, ভাল বই এবং একটি শান্ত বিবেক: একটি আদর্শ জীবন।“ আদর্শ জীবন গঠনে মার্ক টোয়েনের মতের বিরোধিতা করা নেহাতই বোকামি। জীবন গড়তে হলে বই বন্ধুর পাশাপাশি একটি শান্ত বিবেকও প্রয়োজন। আদর্শ জীবন গঠনে মার্ক টোয়েনের উক্তিটিতে- একটি বই পাথেয় হিসেবে কাজ করবে।
টনি মরিসন শুধু বই পড়তেই বলেননি লিখতেও বলেছেন, উনার ভাষায়
"যদি এমন কোনও বই থাকে যা আপনি পড়তে চান তবে এটি এখনও লেখা হয়নি তবে আপনাকে অবশ্যই এটি লিখতে হবে।” বই লিখতে হলে- জানতে হবে,বোঝতে হবে কোন বিষয়টা এখনো বইয়ে ফুটে উঠেনি। এর জন্য প্রচুর বই পড়া উচিৎ।
দেকার্তের অনুধাবন-"বই মৃত লোকের সাথে কথা বলার শক্তি যোগায় যা উনারা আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন" তিনি আরও বলেন,
”ভালো বই পড়া মানে গত শতাব্দীর মহৎ লোকের সাথে আলাপ করা।“-অর্থাৎ একজন লেখক যখন একটি বই লিখেন তখন সমসাময়িক বিষয়গুলো তুলে ধরেন তাঁর বইয়ের পাতায়। মৃত্যু পরিবর্তী সময়েও তিনি ঐ বিষয়গুলো জীবন্ত মনে হয়।
মার্কাস টুলিয়াস সিসারোর উপমাটা যথার্থই উপলব্ধ জ্ঞান তিনি তার বইয়ে লিখেছেন-
”বই ছাড়া একটি কক্ষ আত্মা ছাড়া দেহের মত।” মানুষ তার ভবিষ্যদ্বানী করতে পারে বই পড়ার মাধ্যমে। ভবিষ্যতের নিঘোর অন্ধকার কাটিয়ে আলোর পথে যাত্রার ধ্বনি বাজায় বই। তাইতো অস্কার উয়াইল্ড বলেছেন- "একজন মানুষ ভবিষ্যতে কী হবেন সেটি অন্য কিছু দিয়ে বোঝা না গেলেও তার পড়া বইয়ের ধরন দেখে তা অনেকাংশেই বোঝা যায়।" শুধু কয়েকটা বই পড়ে জীবন রস বুঝা কঠিন। অতিরিক্ত বই পড়া হোক মনের বাসনা। নেশার মত ঘিরে ধরুক বই পড়া। নেপোলিয়ানকে তো সবাই চিনেন? বই নিয়ে উনার বিখ্যাত একটি উক্তি হল-
”অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল।” আমরা বই কেনার সময় টাকার যতটা হিসাব করি-এই বুঝি টাকা শেষ! ততটা হিসেব ঘর সৌখিনতায় করি না। নিজকে,নিজের ঘরটাকে পরিপাটি করার জন্য যে পরিমান অর্থ ব্যয় করি-এর ছটাক পরিমান অর্থ অন্তরের সাজ মস্তিষ্কের খাদ্য জ্ঞানের জন্য করি না। একটা বই কিনে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার মনোভাব এখনো অন্তরের অজন্মা-ই রয়ে গেল। আমাদের সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন-
”বই কিনে কেউ কোনদিন দেউলিয়া হয় না।“
বই কখনো ধংসের বস্তু হতে পারেনা। রাগে অভিমানে কখনো বইয়ের সাথে খারাপ আচরণ করা মূর্খতা। তার চেয়ে বড় মূর্খতা হচ্ছে বই না পড়া। কোনো একটা বই বাজারে এসেছে কিন্তু সেই বইটাকে কেউ না পড়া মানে সেটাকে অপমান করা। বই আবার অপমানিত হয় কিভাবে? বই নয়- বরং বইয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অপমান করা হয়। বই পোড়ানোর চেয়েও গুরুতর অপরাধ অনেক আছে সেগুলোর মধ্যে একটি হল বই না পড়া"।
আত্মীতা করতে হলে বইয়ের সাথে করা উচিৎ। প্রেম হোক বয়ের সাথে। ভালবাসা বিলিয়ে দেওয়া হোক বইকে। বইয়ের রাজ্যে নেমে আসুক বেঁচে থাকার সম্ভাবনা। প্রতিভা বসু বইয়ের সাথে সম্পর্ক করে বলেছিলেন,
”বই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ আত্মীয়, যার সঙ্গে কোনদিন ঝগড়া হয় না,কোনদিন মনোমালিন্য হয় না।"
বই কেনা একটা মানুষিক রোগ হওয়া উচিত,যেন ভারসাম্যহীন হয়ে শুধু বই কেনা যায়। বই কেন হয়ে উঠোক শখের বিষয়। বই কিনে পড়া-না পড়া পরের বিষয়,শুধু যেন বই কেনা হয়। ”বই কিনলেই যে পড়তে হবে, এটি হচ্ছে পাঠকের ভুল। বই লেখা জিনিসটা একটা শখমাত্র হওয়া উচিত নয়, কিন্তু বই কেনাটা শখ ছাড়া আর কিছু হওয়া উচিত নয়।”- প্রমথ চৌধুরী অতীত কেউ ভুলতে পারেনা আবার অতীতের সব মনেও থাকে না তাই বই পড়ার মাধ্যমে অতীতকে বর্তমানে রাখা যায়। রবী ঠাকুর বলেছিলেন-”বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেয়া সাঁকো।” যে তার অতীত ভুলে যেতে বসেছে সে চাইলেই বই পড়ার মাধম্যে তার অতীত ফিরে পাবে। অতীত রোমন্থন করতে চাইলে বই পড়ার বিকল্প নেই। বর্তমানকে সাজাতে চাইলে বই হবে পুষ্প রূপ প্রতিমা আর বইয়ের প্রতিটা বাক্য হবে পুষ্পরেণু। বুক-সেল্ফ ঘরের সৌন্দর্য বাড়ায়। একটা রুম বই ছাড়া অপূর্ণ। সিডনি স্মিথ বইয়ের সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে বলেছিলেন-" ঘরের কোন আসবাব পত্র বইয়ের মত সুন্দর নয়"। আমরা মনে করি যে,আমাদের জীবনে অনেক জিনিসের প্রয়োজন যা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে বইকে শো পিচ এর মত ভাবা উচিৎ। ডক্টর মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেছেন- ”জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই এবং বই।”
বই মানুষকে দুঃখের সাথে সন্ধি করতে শেখায় সুখের সাথে বৈরীতা যোগায়। কষ্টের বিপরীতে আন্দের জোয়ার আনে। ”বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে,তার জীবনের দুঃখ কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।“
(শরৎচন্দ্র চট্রোপধ্যায়)
0 মন্তব্যসমূহ