লেখা শুরুর আগেই বলে রাখা দরকার, অনেক বিশ্লেষণের পর যারা পৃথিবীতে মানুষের যা কিছু না পাওয়া, যা কিছু বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, মানুষের সব অপূর্ণতা, অন্যায়, হানাহানি, সব কালো অন্ধকার দিকের জন্যে ইতিমধ্যেই স্থিরভাবে 'ধর্ম' কেই চিহ্নিত করে ফেলেছেন, তাদের জন্যে এই লেখা নয়। ধর্মে আস্থা রাখা একজন মানুষ হিসেবে অনুরূপ হাজারো লাখো মানুষের জ্ঞাতার্থে ধর্মীয় জগতের কিছু মূল্যবান তথ্য পরিবেশনই এই লেখার উদ্দেশ্য।
সম্প্রতি দেশব্যাপী নানা ছলছুতোয় ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের শক্তি প্রদর্শন চলছে। ঘটে চলেছে তথাকথিত নীচুজাতের মানুষের উপর অমানবিক অত্যাচার! বিপরীতে, 'ধর্মনিরপেক্ষতা'-র নামে তোষণ, আস্কারা ও উস্কানিমূলক বিভাজন-প্রয়াসও কম নয়। জন্ম নেবার পরেই মানুষ একটা মিথ্যে বেড়াজালে আটকে পড়ে। সেই বেড়াজাল ক্রমশঃ বিভ্রান্তি বাড়িয়ে তার মনুষ্যত্বের প্রকৃত পরিচয়কে আড়াল করে জাতপাতধর্মের গৌণ পরিচয়টাকেই বড় করে মেলে ধরে। যুগে যুগে কত মহাপুরুষ এই মনুষ্যসৃষ্ট মিথ্যে ভেদাভেদের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সতর্ক করেছেন, কিন্তু আমরা তাদের উপদেশ শিকেয় তুলে রেখে তাদেরকে পূজোর আসনে বসিয়ে স্রেফ ফুল-বেলপাতাই ছিটিয়ে যাচ্ছি; আর নিজেরা পুরো উল্টোপথে হেঁটে জাতপাতধর্ম ভিত্তিক নিত্যনতুন ভেদাভেদের চর্চা করছি।
সাম্প্রদায়িকতার সূক্ষ্ম ও স্থূল কদর্য চেহারা যেভাবে সমাজকে দূষিত করে তুলছে, তাতে আমরা না চাইলেও খোদ ধর্মকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সুযোগ তৈরী হয়ে যাচ্ছে। একথা তো অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কোন ধর্ম যদি মানুষে মানুষে প্রেম ও সদ্ভাব সৃষ্টির সহায়ক না হয় তবে তা আর যাই হোক, মানবধর্ম হতেই পারেনা। এবিষয়ে কর্মযোগী অযাচক সন্ন্যাসী স্বামী স্বরূপানন্দের এই বক্তব্যটি খুবই প্রাসঙ্গিক: "মানুষের সহিত মানুষের কর্ম-সম্বন্ধকে বিস্তারিত করার নামই ধর্ম। যাহা মানুষকে মানুষের পর করে, শত্রু করে, তাহা অধর্ম"। তাই, যদি আমরা ধর্মের নামে কোন বিশেষ মানুষকে অবহেলায় বা অসম্মানে দূরে সরিয়ে দিই বা চিরকাল দূরেই রাখি, কিংবা তার উপর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠি, তাহলে প্রকৃত অর্থে অধর্মেরই চর্চা করা হয়।
এবার আসা যাক জাতপাত বা বংশগোত্রের বিচারে মানুষকে হেয় করার প্রসঙ্গে- যাকেও কিনা সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মেরই অনুমোদনপ্রাপ্ত একটা বিষয় বলে চালিয়ে দেয়া হয়। এবিষয়েও স্বামী স্বরূপানন্দ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন- "তুমি মানুষ, ইহাই তোমার প্রকৃষ্ট পরিচয়। ইহার অধিক কোন পরিচয় আমার নিকটে প্রয়োজন হয় না। আমি মানুষেরই পূজারী, তাহার নাম বা গোত্রের পূজারী নহি। তাহার জন্ম বা জাতি আমার দৃষ্টিতে নগণ্য। তাহার ভিতর সুপ্ত ব্রাক্ষ্মণ্যই আমার পূজার বিগ্রহ"।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে এই 'ব্রাক্ষ্মণ্য' বা ব্রাক্ষ্মণত্ব বলতে কি বোঝায়? স্বামী স্বরূপানন্দের দৃষ্টিতে- "মানবত্বের চরমোৎকর্ষই হ'ল ব্রাক্ষ্মণত্ব, নির্দিষ্ট বংশে জন্মের নামও ব্রাক্ষ্মণত্ব নয়, স্কন্ধে উপবীত-ধারণও ব্রাক্ষ্মণত্ব নয়। মানবত্বের চরমোৎকর্ষকে লাভ করাই হ'ল ব্রাক্ষ্মণত্ব লাভ। মানবমাত্রেরই মানবত্বের চরমোৎকর্ষে পৌঁছুবার অধিকার আছে। সুতরাং মানবমাত্রেই ব্রাক্ষ্মণ হ'বার আকাঙ্ক্ষারও অধিকারী"।
পাঠক কি কখনো কোথাও লক্ষ্য করেছেন যে কোন একটি বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কিছু লোক একত্রে বসে (সংখ্যাটা তিন থেকে উপরে যতোধিক খুশী হতে পারে) নিবিষ্ট মনে সমবেত কন্ঠে প্রার্থনা করছেন, যেখানে বাংলা সঙ্গীত গীত এবং সংস্কৃত স্তোত্র/মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে, অথচ সেখানে কীর্তনাদিতে সাধারণভাবে ব্যবহার্য কোন বাদ্যযন্ত্রেরই- যেমন খোল করতাল হারমোনিয়াম ইত্যাদির বাহ্য হুল্লোড় অনুপস্থিত, এবং যেখানে পূজার আসনে আরাধ্য হিসেবে নেই কোন দেবদেবী বা মানবগুরুর প্রতিমূর্তি; বরং বিরাজ করছেন পরমেশ্বরের প্রতীক তথা 'ওঁঙ্কার' বিগ্রহ? যদি তেমনটি কেউ লক্ষ্য করে থাকেন, তবে জানবেন প্রায় একশ শতাংশ সম্ভাবনা হ'ল সেখানে অযাচক সন্ন্যাসী অখণ্ড মণ্ডলেশ্বর শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব প্রবর্তিত 'সমবেত উপাসনা' অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যাতে অংশগ্রহণকারীরা হয় 'অখণ্ড' মন্ত্রে দীক্ষিত, না হয় বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা নিয়ে আসা যে কোন ধর্মাবলম্বী (হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান মুসলমান ইত্যাদি) অনুরাগী কোন ধর্মাত্মা। বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা নিয়ে আসা যে কারোর জন্যে এখানে অবারিত দ্বার।
একজন 'অখণ্ড' বলতে কাকে বোঝাবে, এবিষয়ে বলা হয়েছে- "মনুষ্যত্বই অখণ্ডের আদর্শ। অখণ্ড হিন্দুও নয়, মুসলমানও নয়, খ্রীষ্টানও নয়, বৌদ্ধও নয়,- অখণ্ড হচ্ছে মানুষ। যে মানুষ অপর মানুষকে ঘৃণা করে না, যে মানুষ অপর মানুষকে পর ভাবে না, যে মানুষ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার যূপকাষ্ঠে নিজেকে বলি দেয় না, যে মানুষ মানুষের সাথে মানুষের মিলনের সূত্র আবিষ্কারেই নিয়ত নিরত, যে মানুষ অতীতের মহত্বকে অস্বীকার না করেও অতীতের ভ্রমত্রুটীকে সংশোধনের সৎসাহস রাখে,
যে মানুষ ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বর্তমানকে পরিচালিত করে, যে মানুষ সকল সম্প্রদায়ের মৌলিক একত্বে বিশ্বাস করে, যে মানুষ সর্বজীবকে জানে ভাই, সর্বমানবকে জানে আপন, সর্বদেশকে জানে স্বদেশ, সর্বভাষাকে জানে ইষ্টনামেরই বহিঃপ্রকাশ, সকল সংঘকে জানে নিজের প্রতিষ্ঠান, সকল মত ও পথকে জানে নিজের মত ও পথের অন্তর্ভুক্ত সত্য,- সে হচ্ছে অখণ্ড।" ('অখণ্ড সংহিতা সপ্তম খণ্ড)
সমবেত উপাসনা প্রবর্তনের বয়স বর্তমানে কম করেও একশ বছর অতিক্রান্ত। প্রবর্তক স্বামী স্বরূপানন্দ সর্বদা এই অনুষ্ঠানটিতে সকল উপাসকদের সাথে সমসাধক হিসেবে স্বয়ং সূক্ষ্মদেহে উপস্থিত থাকেন বলে মানা হয়। তাঁর নিজের কথায়- "এই একটা কথাকে তোমরা স্থায়ী সত্য রূপে বিশ্বাস করিও যে, যেখানে সমবেত উপাসনা রহিয়াছে, সেইখানেই আমি বিরাজ করিতেছি। আমার পাঞ্চভৌতিক দেহ প্রত্যক্ষ ভাবে সেখানে না থাকুক, আমি আমার সর্ব্বস্বরূপ লইয়া সেইখানে অবস্থান করিতেছি।" সমবেত উপাসনার আসরে তাই উপাসকদের সাথেই সামনের দিকটায় তাঁর জন্যেও একটি বিশেষ উপাসক-আসন পাতা থাকে। তাঁরই নির্দেশে অনুষ্ঠানটিতে তাঁর নিজের কোন প্রতিমূর্তি রাখা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আগেই বলা হয়েছে, এখানে উপাস্যের বেদীতে একমাত্র ওঁকার বিগ্রহই স্থাপিত থাকেন।
এই উপাসনার শুরুর দিকটায় স্বামী স্বরূপানন্দ প্রণীত মহাগ্রন্থ 'অখণ্ড সংহিতা'-র কোন একটি খণ্ড থেকে পরিস্থিতি অনুসারে খানিকটা নির্বাচিত অংশ পাঠ করা হয়। ঘন্টাখানেক স্থায়িত্বের এই উপাসনায় গীত প্রতিটি সঙ্গীত এবং উচ্চারিত প্রতিটি স্তোত্র ও মন্ত্রই সম্পূর্ণভাবে অসাম্প্রদায়িক প্রকৃতির- কারণ তাদের কোনটাই বিশেষ কোন দেবদেবী, অবতার বা গুরুর বন্দনা নয়; বরং সবগুলিই শুধুমাত্র পরমেশ্বর-উদ্দিষ্ট ও তাঁর প্রতিই নিবেদিত, অর্থাৎ এক ও অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের স্মরণ, মনন ও ধ্যানের অনুকূল।
একসময় সমাজে ব্রক্ষ্মগায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণে অব্রাক্ষ্মণ কিংবা ব্রাক্ষ্মণ স্ত্রীলোকেরও অধিকার ছিল না। সুদীর্ঘকাল অনুশীলিত এই অন্যায় ও অযৌক্তিক প্রথা ভেঙে স্বামী স্বরূপানন্দ 'সমবেত উপাসনা' নামক এই বিশেষ অনুষ্ঠান প্রবর্তন করে অব্রাক্ষ্মণ ও স্ত্রীলোক নির্বিশেষে একত্র হয়ে সমবেত কন্ঠে গায়ত্রী মন্ত্র গাইবার প্রথা প্রচলন করেন। স্বামী স্বরূপানন্দের কথায়- "এই গায়ত্রীমন্ত্র প্রতিটি মানুষকে ব্রাক্ষ্মণত্বের আকাঙ্ক্ষা প্রদান কচ্ছে- যে আকাঙ্ক্ষায় তার পূর্ণ অধিকার আছে"।
উপাসনায় সমবেত কন্ঠে ব্রক্ষ্মগায়ত্রী মন্ত্র গীত হ'বার অব্যবহিত পরের অংশটিতেই কিছুক্ষণ নীরবতা পালিত হয়। সেইসময় উপস্থিত সকলে যার যার গুরুদেব দ্বারা প্রদত্ত নির্দিষ্ট ইষ্টমন্ত্র নীরবে জপ করেন। যারা কোন গুরুর দীক্ষিত ন'ন, তারাও সেইসময়ে নিজেদের রুচি ও পছন্দমত ঈশ্বরের যেকোন নাম জপ করতে পারেন। জপের প্রারম্ভে জগন্মঙ্গল সংকল্প বাধ্যতামূলক। তখন সবাইকে মনে মনে ভাবতে হয়, "আমি জগতের মঙ্গলকারী হচ্ছি; আমার দেহ, মন, প্রাণ, আত্মা সব জগতের মঙ্গলের জন্যে তৈরী হচ্ছে"। অর্থাৎ কারো ঈশ্বরসাধন শুধু যেন একার মুক্তির জন্যে না হয়, তা যেন সমগ্র জগতের কল্যাণার্থে হয়, এই অনবদ্য শিক্ষাটিই এই সমবেত উপাসনার মাধ্যমে দেয়া হয়েছে।
স্বামী স্বরূপানন্দ বলেছেন, "সমবেত উপাসনা এক মহামিলনের সাধনা।... উপাসনা তোমাদের জীবনে দিব্যায়ন বিধান করুক"....(অখণ্ড সংহিতা ষোড়শ খণ্ড)। তিনি আরো বলেন, "সমবেত উপাসনার মধ্য দিয়া তোমাদের প্রত্যেকের জীবন প্রেমময়, সুখময়, তৃপ্তিময় হউক। তোমাদের মনঃপ্রাণ অমৃতময় অখণ্ড-নামের সাধনে একান্তভাবে নিয়োজিত হইয়া মৃত্যুনাশকারী অমৃত আহরণে প্রযত্নবান্ হউক"... (অখণ্ড সংহিতা চতুর্দশ খণ্ড)। বোধ করি সেজন্যেই এই উপাসনায় গীত উদ্বোধনী আরতি স্তোত্রের প্রথম লাইনটিই হ'ল:-
"জয় জয় ব্রক্ষ্ম, পরাৎপর, ঈশ্বর,
শমন-গর্ব-পরিভঞ্জ…."।
সমবেত উপাসনায় নিয়মাবলী ও শৃঙ্খলা রক্ষার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে আলোচনায় আজ থেকে প্রায় ৮৫ বছর আগে (১৪ জানুয়ারী ১৯৩৫) স্বামী স্বরূপানন্দ ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, "একদা তোমাদের এই উপাসনা লক্ষ লক্ষ লোকে একত্র মিলিয়া অনুষ্ঠান করিবে" .... (অখণ্ড সংহিতা পঞ্চদশ খণ্ড)। ১৯৮৪ সালে তাঁর মহাপ্রয়াণের বাইশ বছর পরে সেই ভবিষ্যতবাণী সত্যিই বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বামী স্বরূপানন্দের জন্মোৎসব উদযাপন উপলক্ষে তৎকালীন অখণ্ড সঙ্ঘপ্রধান সন্ন্যাসিনী সংহিতাদেবীর উপস্থিতিতে আসামের শিলচরে একত্রে প্রায় দেড় লক্ষ উপাসকের যোগদানে অনুষ্ঠিত সমবেত উপাসনা এখন অব্দি সর্ব্বোচ্চ জমায়েতের সমবেত উপাসনা। বহু মুসলিম ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিও ঐ উপাসনায় অংশ নিয়েছিলেন।
সমবেত উপাসনার অন্তর্নিহিত সমন্বয় সাধনের বৈশিষ্টে ও স্বকীয়তায়, এবং স্বামী স্বরূপানন্দের অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে তা আজ সমাজে ব্যাপকভাবে সমাদৃত একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, আজ সমাজে তা এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জোয়ারও এনেছে। আজকাল বিবাহ, অন্নপ্রাশন (মুখে ভাত), গৃহপ্রবেশ, হাতেখড়ি, ইত্যাদি যাবতীয় সামাজিক অনুষ্ঠানাদিও এই সমবেত উপাসনার মাধ্যমে উদযাপিত হচ্ছে, যেখানে রবাহুত ব্রাক্ষণ পুরোহিত দ্বারা মন্ত্রোচ্চারণ করানোর কোন প্রয়োজন পড়ে না। উপস্থিত সকলের সমবেত প্রার্থনাই ঐসব অনুষ্ঠানাদির প্রধান অঙ্গ ও চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পারলৌকিক ক্রিয়াদি অর্থাৎ শ্রাদ্ধের বিকল্প হিসেবে এই সমবেত উপাসনার ব্যবহার তো ইদানীং বহুজনবিদিত। একথা অনস্বীকার্য যে মৃত্যুর পর প্রেতাত্মার তথাকথিত বন্ধনমুক্তির জন্যে পিণ্ডাদি দানের বহুপ্রচলিত বৈদিক প্রথাটির একটা সুন্দর শোভন যুক্তিসমৃদ্ধ বৈকল্পিক প্রথা হিসেবে সমবেত উপাসনার গ্রহণযোগ্যতা আজ ক্রমবর্ধমান। এই প্রথাটিতে 'শ্রদ্ধাই শ্রাদ্ধ' এই ধারণায় আস্থা রেখে হারানো প্রিয়জনের স্মরণে সকলে মিলে সমবেত উপাসনার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে প্রয়াতের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়, এবং এটাকেই 'শ্রাদ্ধ' হিসেবে মেনে নেয়া হয়। সমাজের শিঁকড়ে দীর্ঘদিনের যে সংস্কার গেড়ে বসেছে তার বিরুদ্ধে গিয়ে এই সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণে তাঁর অনুরাগীদের অনুপ্রেরণা ও আস্থার জায়গা হ'ল তাদের প্রাণের ঠাকুর স্বামী স্বরূপানন্দের অগ্রণী চিন্তাধারা, তাঁর অপার করুণা ও বরাভয়। শুধু দীক্ষিত অখণ্ডরাই নয়, অখণ্ড সমাজের বাইরেও আজকাল অগণিত মানুষজন 'অখণ্ড মতে শ্রাদ্ধ' (মানে সমবেত উপাসনার মাধ্যমে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান) উদযাপনকে ক্রমশঃ বেশী বেশী করে পছন্দ করছে এবং মেনে নিচ্ছে।
বিয়ের ক্ষেত্রে হবু দম্পতির প্রত্যক্ষ যোগদানে এবং তাদেরকে প্রথম সারিতে বসিয়ে সমবেত উপাসনা অনুষ্ঠিত হয়। উপাসনা সমাপনান্তে পবিত্র ওঁকার বিগ্রহ এবং উপস্থিত উপাসকদের সামনে বর ও কনে যার যার মাতৃভাষায় প্রতিজ্ঞা ও পারস্পরিক সম্মতি প্রদানের মাধ্যমে পরস্পরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করে। স্বামী স্বরূপানন্দ তাঁর দূরদৃষ্টির সুবাদে এই পন্থায় অনুষ্ঠিত বিবাহকে বাস্তবোপযোগী তথা আইনসিদ্ধ করার ব্যবস্থাও পাকা করে গিয়েছেন। অখণ্ড মতে বিবাহের সংখ্যা অখণ্ড মতে শ্রাদ্ধের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম হলেও আজ কিন্তু তার সংখ্যাটাও ক্রমবর্ধমান।
শতাব্দীব্যাপী পরিচালিত অভিনব 'চরিত্র গঠন আন্দোলন', আচণ্ডাল ব্রাক্ষ্মণে গায়ত্রীমন্ত্রের অধিকার প্রদান, স্বাবলম্বনের আদর্শে দৃঢ়ভাবে পথ চলে সেবামূলক বহুমুখী প্রতিষ্ঠান 'দি মালটিভার্সিটি'-র গঠন ইত্যাদির মতোই স্বামী স্বরূপানন্দের এইসব সমাজ-সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডেও তেমন আশ্চর্যান্বিত হবার কিছু নেই; কারণ তাঁর নিজেরই কথায়- "আমি পৃথিবীতে নূতন ইতিহাস সৃষ্টি করিতে আসিয়াছি; গতানুগতিকতা আমার পন্থা নহে"। শুধু কথায় নয়, কার্যক্ষেত্রে অভিক্ষা ও অযাচকত্বের মতো সুকঠোর নীতির সার্থক রূপায়ন করে এই সুমহান্ জীবন প্রতিটি ব্যক্তিমানুষকে প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার পথে চলবার, এবং সমগ্র জাতিকে সেই পথে অনুপ্রাণিত করার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
আশা করি ধর্মের নেতিবাচক উৎকট বহিঃপ্রকাশে মানসিকভাবে পীড়িত সুহৃদেরা শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব প্রবর্তিত সমবেত উপাসনা সম্পর্কে অবগত হয়ে ধর্মীয় সমাজে ইতিবাচক সংস্কার আনয়নের আরো এক মহতী প্রচেষ্টার সন্ধান পেয়েছেন এবং কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হতে পেরেছেন। বর্তমানের ঘোর সাম্প্রদায়িক বিচারবুদ্ধি ও উস্কানিমূলক আচরণের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে এজাতীয় সকল মহাপুরুষদের দেয়া শিক্ষা আমাদের সহায়ক হোক, এই প্রার্থনা জানিয়ে এই অমৃত প্রসঙ্গের আলোচনায় ইতি টানছি।
0 মন্তব্যসমূহ