মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে
আমি মানবএকাকী ভ্রমি বিস্ময়ে/ভ্রমি বিস্ময়ে..
-রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর
বিশ্বকবির
অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে একসুরে আরও একবার বলতেই পারি, "সময়ের সমুদ্রে আছি; কিন্তু এক মুহূর্ত সময় নেই। দু'বছর টানা মহামারীকৃত লক্-ডাউন এবং নানান
বাধা-নিষেধ ভয়-ভীতির গণ্ডি পার হ'য়ে বিশ্ববাসী গোপনে সন্ধান করেছে দেহ-মনের
সুদূর পারে নিজেকে হারিয়ে ফেলবার ঠিকানা। আকাশের আলোর মাঝে খুঁজেছে মুক্তির পথ।
সত্যি বলতে, করোনার
কবল থেকে বেরিয়ে নতুন বিশ্ব যখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে সুস্থ সবল পদক্ষেপে চলতে
শুরু করল, অধিকতর
সাহসী শিশুর ন্যায় ভ্রমণের দুয়ার খুলতে না খুলতেই তখন একদল পথিক শুরু করেছিল
ছোটখাটো নিকটবর্তী ভ্রমণ পথে চলা। তারাই আবার সাহসী ভ্রমণ পিপাসুদের
ইন্ধন জুগিয়েছে নানান ভ্রমণ পথের দৃশ্যসমূহ সোশ্যাল মিডিয়া মারফত প্রেরণ করে
করে। বলতে দ্বিধা নেই, ওই ধরনের
অনুপ্রেরণাই বর্ধিত করেছে 'ত্রয়ী'-র পিপাসা। আমাদের
ক্ষুদ্র দলটির অধিনায়ক শ্রীমান বাপটুস ব্যবস্থা করে ফেলল বাকি দুই সদস্যকে নিয়ে
একটি মনের মতন ছোটখাটো সুন্দর অথচ বিস্ময়ে ঘেরা আনন্দ-ভ্রমণের!
কলকাতার
কয়েকটি জমিদার বাড়ির সঙ্গে কলকাতাবাসী জনসাধারণের একাংশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং
আবদ্ধ আত্মীয়তাসূত্রে। আমাদের বাহিনীও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে সেই
বাড়িগুলিতে বসবাস করছেন উত্তরসূরীরা- কেউ প্রাচীন গঠনের ভিতরে, কেউ বা
পুনর্নবীকৃত অংশে। কিয়দংশ বিক্রিতও। সাজিয়ে
গুছিয়ে নতুন প্রজন্মান্তরের নিকট জলজ্যান্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন তুলে ধরবার মতন
বন্দোবস্ত চোখে পড়ে না। তবু
বানানো রূপকথার গল্পের বাইরের সত্যিকারের রাজা-রাজড়া, জমিদার পরিবারের কাহিনী জানবার জন্য
আমার মতন চিরশিশু পাঠক-মন উৎসুক বাংলার ঘরে ঘরে।
মুঠো মুঠো
স্বপ্নকে সাথী ক'রে দেহ-মনের
সুদূর পারে নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলতে- মহামারীকৃত বন্দীত্ব মুক্তির আলো
খুঁজতে একটি ছোট্ট সুজুকি সুইফ্ট গাড়ি ভাড়া নিয়ে রওনা দিতে চলেছি। আমাদের লক্ষ্য পথের ঠিকানা কলকাতার সীমান্ত ছাড়িয়ে নবীকৃত- “বাওয়ালি রাজবাড়ি”।
করোনার
সময়ে অনুভব করেছি যে সমগ্র বিশ্বের মাটি, জল আর আকাশের উপর রাজত্ব চালিয়ে
যাওয়া মানুষগুলি ক্রমশঃ আরও বেশি করে হয়ে উঠেছে আমাদের আপনজন। তাই ভ্রমণকাহিনী
লেখবার অছিলায় নেট দুনিয়ার সকল বন্ধুদের সঙ্গে বিনিময় করছি এই ভ্রমণে অর্জিত
মানসিক খোরাক! পাঠক বন্ধুরা এই কাহিনী পাঠ করে ও সম্ভাব্য ক্ষেত্রে সশরীর ভ্রমণের
দ্বারাও ঘোচাতে পারেন একাকীত্বের জ্বালা। কবিগুরুর ভাষায় আহ্বান জানাই বিশ্ববাসী
প্রিয় পাঠক বন্ধুদের-“আপন হতে
বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া/ বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।”
আষাঢ়
মাস। লবণহ্রদের বাসস্থান থেকে রওনা দেবার আগের মুহূর্তে সৃষ্টির অপরূপ দক্ষিণায়
কয়েক পশলা বর্ষণ ঘটলেও সকাল দশটা বেজে ত্রিশ মিনিটে গাড়িতে ওঠবার সময় থেকে আকাশ
সম্পূর্ণ পরিষ্কার। রাস্তা সামান্য ভিজে।আমাদের গাড়িটি এগিয়ে চলেছে। করুণাময়ী
পেরিয়ে নিক্কোপার্কের পাশ দিয়ে ই.এম.বাইপাসে পড়লাম। বাইপাস ধরে কিছুটা এগিয়ে 'মা-সেতু' পেলাম। এই 'মা-সেতু'তে উঠে সাইন্স-সিটির মোড় থেকে ডানদিকে
ঘুরলাম। একই সেতুর একটি জায়গায় 'মা' নাম পাল্টে হ'ল 'এ জে সি বোস রোড সেতু'। এই সেতুর শেষ প্রান্ত থেকে আরেকটু
এগিয়ে বা দিকে ঘুরে কিছুদূর গিয়ে ডানদিকে পড়ল আলিপুর চিড়িয়াখানা।
ডাইনে
চিড়িয়াখানা ও বামে জাতীয় গ্রন্থাগার (national library) উভয়বিধ উষ্ণতার মাঝখান দিয়ে আমাদের
রাস্তা। আলিপুর রোড ধরে একটু এগিয়ে ডায়মন্ডহারবার রোডে এসে পড়া গেল। আমার পাঠক
বন্ধুদের সিংহ ভাগেরই জানা আছে, এই ডায়মন্ডহারবার রোডটি শুরু হয়েছে
খিদিরপুর থেকে। একটু এগিয়ে ২০১৮- এর সেপ্টেম্বরের ৪
তারিখ অপরাহ্নে অকস্মাৎ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়া ও ২০২০-এর ডিসেম্বরের ৩ তারিখে
নতুন করে চালু হওয়া সেই 'মাঝেরহাট
সেতু'টি পড়ল। অত্যন্ত
আধুনিক প্রযুক্তি সহযোগে নির্মিত এই সেতুটির নির্মাণ বা নবজন্ম-মুহূর্তে নেতাজীর
১২৫-তম জন্ম-জয়ন্তীকে স্মরণে রেখে এটি নামাঙ্কিত হয়েছে ' জয়হিন্দ সেতু ' পরিচয়ে।
এই 'জয়হিন্দ সেতু' থেকে আরও এগিয়ে ডানদিকে পড়ল আলিপুর
মিন্ট বা টাকশাল। এটি কয়েন বা মুদ্রা তৈরীর কারখানা। আরেকটু
এগিয়ে তারাতলার মোড়। এই মোড় থেকে ডান দিকে গেলে বজবজ
পাওয়া যায়। তারাতলার মোড় থেকে আরও এগিয়ে গেলাম
ডায়মন্ডহারবার রোড ধরেই। কিছুটা এগিয়েই পড়ল বেহালা ট্রামডিপোর
মোড়। এখানে এখন আর ট্রামডিপো নেই। ঠিকানার
নামটিই শুধু মাত্র রয়েছে। ট্রামডিপোর মোড়ে বা দিকে পড়ল বিখ্যাত সিদ্ধেশ্বরী
মন্দির। আর উল্টোদিকে ব্রাহ্ম সমাজ রোড। বলা
বাহুল্য হলেও বলি, ব্রাহ্ম সমাজ রোড ধরে একটু এগিয়ে পড়ে
প্রাচীন 'সোনার
দূর্গাবাড়ি'।
ডায়মন্ডহারবার
রোডে পড়েছি থেকেই লক্ষ্য করে যাচ্ছি মেট্রোরেলের কাজ অনেকখানি এগিয়ে গেছে। এটি
ঠাকুরপুকুর থেকে এসপ্ল্যানেড অবধি আসবে। ডায়মন্ডহারবার রোড ধরে এগিয়ে চলেছি। বামদিকে
বেহালা ব্লাইন্ড স্কুল ও আমার মাসি- শাশুড়ী পঠিত বিবেকানন্দ কলেজটি অতিক্রম
করলাম।
একটু
এগিয়ে দেখি বেহালা চৌরাস্তার মোড়।আরেকটু এগোলেই সখের বাজারের মোড়।এই মোড় থেকে
ডানদিকে গেলে পড়ে একটি প্রাচীন
চন্ডীমন্দির। এর পাশেই
বসে বার্ষিক চন্ডীমেলা। মেলাটিও অতি প্রাচীন। এতদঞ্চলেই সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বিখ্যাত আটচালাটি অবস্থিত। আমার
স্বর্গীয় পিতৃদেব শৈশবে মাতৃহীন হয়ে মাতুলালয়সূত্রে কিছুদিন কালাতিপাত করেছিলেন
এই পরিবারের এক শরিকি গৃহে।
ডায়মন্ডহারবার
রোড ধরে আরও এগিয়ে চললাম। একসময়ে পড়ল ঠাকুরপুকুরের মোড়। এই মোড় থেকেই ডায়মন্ডহারবার রোডটি ত্যাগ
করলাম। ডানদিকে ঘুরে একটি খালের পাশ দিয়ে এগোলাম। রসপুঞ্জ গ্রামের পাশ দিয়ে
চলেছি। কিছু বড় বড় স্কুল গজিয়ে উঠেছে-_ দেখলাম। একটি বড়
মোড়-বিবিরহাট। এর পরে পথে পড়ল বাখরাহাটের মোড়-এ অঞ্চলটি পাইকারী বাজারের জন্য বিখ্যাত। আরেকটু
এগিয়ে ডানদিকে পড়ল বাওয়ালি হাই স্কুল। মাত্র দু'টি ঘণ্টার তফাতে চলে এলাম কলকাতার
বাইরে এক অতীত বিস্ময়ের কাছাকাছি!
রাজবাড়ির
অদূরে গাড়ি রাখতেই রাজবাড়ির দুই পাইক কোথা থেকে উপস্থিত হয়ে সাদরে পথ দেখিয়ে
নিয়ে চললেন মাঝে- মধ্যে জল কাদা জমা রাস্তা কাটিয়ে মোরাম করা পথ বরাবর। এই রাজকীয় যাত্রাপথে
পায়ে পায়ে ধরা পড়ল নির্মীয়মান জগন্নাথ মন্দির-দর্শনার্থীদের জন্য আপাতত বন্ধ
রাখা আছে। আরেকটু এগিয়ে গোপীনাথ জীউর মন্দির, তার ঠিক উল্টোদিকে আকাঙ্ক্ষিত- 'বাওয়ালি রাজবাড়ি'।
সিংহদুয়ারে
পৌঁছে দিয়ে অদৃশ্য হলেন তরুণদ্বয়। দোরগোড়ায় লালপেড়ে সাদা শাড়ী পরিহিতা এক
ভদ্র শিষ্টা রমণী আমাদের 'ত্রয়ী'-কে বরণ করে নিলেন একে একে। শঙ্খধ্বনি
আর প্রদীপের আলোর মৃদু শিখার ছোঁয়ায় হৃদয় ভরল ও সুস্নিগ্ধ প্রসন্নতায় অনুভূত
হল রাজকীয় সমাদর প্রাপ্তি। সিং দরজার গলিপথ অতিক্রম করলাম ধীর পদক্ষেপে।পরবর্তী গন্তব্য আর কর্তব্য নির্ণয়ে
মগ্ন; সহসা
স্বপ্নের সীমানা অতিক্রম করে আরেক শিষ্টা লাল পেড়ে সাদা শাড়ী পরিহিতার আবির্ভাব। কিংকর্তব্যবিমূঢ়
ত্রয়ীর মুখের সম্মুখে এনে উপস্থিত করলেন মৃৎপাত্রে সুসজ্জিত কতিপয় অভ্যর্থনা-পানীয়
পূর্ণ ঘট-প্রতিজনের জন্য পাতিলেবুর দেশীয় সরবৎ। অতিথি
নারায়ণ বিস্ময়ে মুগ্ধ! জীবন-স্মৃতির পাতা থেকে হৃতপ্রায় এমন আপ্যায়নে এত দূর
ভ্রমণের পর উদ্ভূত যাবতীয় ক্লান্তি ও প্রশ্ন চিহ্ন উবে গেল কর্পূরের ন্যায়।
রাজবাড়ি
পথ-প্রদর্শক নির্দেশিত পথ বরাবর একতলা পেরিয়ে চললাম উপরতলায় সুরক্ষিত এবং
প্রত্যাশিত ভোজনালয়ের দিকে। যাত্রাপথে অনুভূত সুদৃশ্য ঐতিহ্যমন্ডিত পুরাতনী
ছোঁয়ায় সৃষ্ট স্থাপত্য ও শিল্প- চাতুরীর স্বাদ শহরের পাঁচতারা কেন দশতারা
হোটেলকেও বুঝি হার মানাতে চায়। বিশালকায় পাত্রে জলে ভাসমান সুগন্ধী টাটকা ফুলের
পাঁপড়ি! মনে আগত রাজকীয় ভাবনা পৌঁছে গেল অনেক উচ্চস্তরে। সিঁড়ি বেয়ে ঘেরা
গাড়িবারান্দা পার হয়ে সামান্য অফিসিয়াল কাজ সেরে উপস্থিত হলাম ভোজনালয়ের
দ্বারে।
সেখানে
একই রকম পোশাক পরিহিত সপ্রতিভ তরুণ-তরুণীরা অভ্যাগতদের নিয়ে চলেছেন আলো-
বাতাসযুক্ত এক-একটি আসন অভিমুখে।একটি করে সুপরিসর টেবিলের উভয় পাশে দু ' টি করে মোট চারটি আসন।বিশাল কক্ষটিতে
অজস্র আসন বর্তমান। দেওয়ালগুলি রাজবাড়ির অতীত ঐতিহ্য
রক্ষা করেই দন্ডায়মান- ভাঙ্গা অংশগুলির মেরামতি হলেও প্লাস্টারের ধরন পাল্টানো হয়নি। তৎকালীন
ঐতিহাসিক ভোজন কক্ষটিকে এক্কেবারে অক্ষত অবস্থায় রেখেছেন বর্তমান কর্তৃপক্ষ। মোটা
মোটা থামগুলি ইতিহাসের অতন্দ্র সাক্ষী। আজ থেকে ২৫০ বছর পূর্বে যারা এখানে
রাজকীয় ভোজন দ্বারা আপ্যায়িত হ'তেন তাদের তুলনায় আমাদের প্রতি সমাদরের বহর কম না অধিক তা বলতে পারব না। দেওয়ালে
টাঙানো রয়েছে এই রাজবাড়িটির ভগ্নপ্রায় অবস্থার অর্থাৎ সংস্কার-পূর্ব অবস্থার
অনেকগুলি ফটোগ্রাফ। বর্তমানে
এই রাজবাড়িটি জনগণের জন্য ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে খুলে দেওয়া হলেও এটি
সংস্কার করে প্রাচীন আদলটিতে যত্ন করে ফিরিয়ে আনবার সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল এবং
ভালোবাসাযুক্ত প্রয়াস অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
প্রথম
থেকেই আমাদের টেবিলের উপর স্থাপিত জলে ভাসমান গোলাপ- পাঁপড়িযুক্ত মাঝারী মাপের
কাঁচ পাত্রদু'টির
প্রত্যেকটিতে দু'টি করে
প্রজ্বলিত মোমের বর্তিকা ভাসিয়ে দেওয়া হ'ল। দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা!! এ হেন কাজগুলি অভ্যস্ত ভঙ্গিমায় করে
চলেছেন ইউনিফর্ম পরিহিতা এক এক জন রমণী।শহরের অতি আধুনিকা তরুণীরা পর্যন্ত এমন
অভিনব আদব- কায়দা রপ্ত করেছেন কিনা জানা নেই। তবে 'ত্রয়ী' সহ সকল পর্যটকই অভিভূত।
হাত
ধোয়ার জন্য চক্রাকারে কর্তিত লেবুযুক্ত উষ্ণ জল পরিবেশিত হ'ল ছোট মাটির পাত্রে। অন্য একটি
মৃৎদানীতে রয়েছে একটি করে পুরু এবং বিস্তৃত ন্যাপকিন বা রুমাল-হাত মোছবার জন্য।
একটি ঐচ্ছিক বিশুদ্ধ পানীয় জলের বোতল আমরা সংগ্রহ করে নিলাম।
মিষ্টি
ছাড়া দইয়ের ঘোলের স্বাদযুক্ত 'ছাঁচ' পরিবেশিত
হল ছোট সরু লম্বা আকৃতির মৃৎপাত্রে। এটি হজমের
জন্য জবরদস্ত। নিরামিষ ও আমিষের মধ্যে দ্বিতীয়টিকেই
নির্বাচন করলাম আমরা। তবে প্রথম থেকেই অতিথিরা ওয়াকিবহাল- স্টার্টার হোক বা মেইন কোর্স- সব খাবারই যত পারো তত খাও- নেই কোনও সীমায়ন।
টেরাকোটার
পাত্রে চলে এল সুগন্ধী বাসমতী চালের ঝরঝরে ভাত, শাকভাজা, স্বল্প বড়ি ও অধিক পোস্ত সংযুক্ত ভাজি,আলু ভাজা, বেগুনী, ছোট ছোট পৃথক মৃৎপাত্রে সুক্ত, চচ্চড়ি, কড়াইশুটি দেওয়া মুগডাল, সুস্বাদু স্যালাড (শসা, টোম্যাটো,গাজর ও পিয়াঁজ কুচির উপর লবণ, মরিচ ও
লেবুর রস ছড়ানো), গন্ধরাজ
লেবু আর কাচা লঙ্কা (টেবিলে আগে থেকেই রাখা ছিল)। লবণদানী ও সস্ দানী সকলের জন্য।
প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি খাদ্য পুনর্বার পরিবেশনের জন্য তৎপর পরিবেশকের দল।
চলে এল
আমিষের পসরা একে একে। ভেটকির পাতুরি, কচু পাতা- চিংড়ি, মাটনের
অপরূপ কারি, সঙ্গে
কয়েকটি লুচি ভাজা। এসে গেল পাঁপড়, আমসত্ত্ব- খেজুর- কিশমিশের চাটনি, সঙ্গে দই, সন্দেশ, রসগোল্লা। এলাহী ব্যাপার! এক পরিবেশিকা
না জানি কোন কৌশলে অনুভব করেছেন দইয়ের প্রতি স্থিত আমার ব্যক্তিগত অতি প্রীতির
কথা। প্রথমবার অন্যান্যদের তুলনায় অধিক পরিমাণে পরিবেশনের পর বারম্বার অনুরোধে
লজ্জিত করে তুললেন আমাকে।
যাক সে কথা; অতি উপাদেয় ও সুস্বাদু মিষ্টি পান সেবনে সাঙ্গ হ'ল রাজকীয় আদর-যত্ন ও আদব-কায়দায় কৃত মধ্যাহ্ন ভোজনের পালা। এই প্রসঙ্গে আমার প্রিয় পাঠক বন্ধুদের জানিয়ে রাখি, মধ্যাহ্ন ভোজনে অংশগ্রহণকারীদের জন্য রাজবাড়ির দরজা খোলা থাকে বিকেল চারটে পর্যন্ত। কথায় বলে, 'খেতে পেলে শুতে চায়'। ক্ষণিকের বিশ্রাম গ্রহণের ইচ্ছে জাগল আমাদের মনেও। আপ্যায়ক আপ্যায়িকাদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ের পর প্রবেশদ্বার পার হয়ে ঘেরা প্রকান্ড দেউড়ি পেরিয়ে সিড়ি বেয়ে উপস্থিত হলাম দালানে উপবিষ্ট সঙ্গীত- মগ্ন বাউলদের সন্নিকটে। কিছুক্ষণ তাদের সান্নিধ্য উপভোগের পর প্রাঙ্গণ- সংলগ্ন সিড়িতে সজ্জিত বনরাজির সঙ্গে একক, দ্বৈত ও পারিবারিক ছবি তুলে রাখলাম। সামনে অনেক দূর পর্যন্ত ডাইনে ও বামে রাজপ্রাসাদোপম সজ্জাসীমা বরাবর নজর রাখলাম। প্রাসাদের উপরতলার ঘরগুলি রাত্রিযাপনকারীদের দখলে। নিশ্চিন্তে কিছুদিন নিরালাযাপনের জন্য রাজবাড়ির সুবন্দোবস্ত প্রশংসনীয়।
ক্ষণিকের
অতিথিদের জন্য প্রশস্ত তৎকালীন ঐতিহাসিক জেলখানাঘরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আলো-আঁধারী বিশ্রামকক্ষটি। সেখানে সুরক্ষিত
প্রাচীন জমিদারদের ব্যবহৃত বহু নিদর্শন। ওখান থেকে বেরিয়ে সদরে যাবার আগেই
দক্ষিণে সিড়ি বেয়ে উঠলে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট পৃথক হাল-ফ্যাশনের
প্রসাধন কক্ষ।সেখান থেকে পরিচ্ছন্ন হ'য়ে সদর থেকে বহির্গমনের পথে দেখা হয়ে গেল
বরণকারিনীর সঙ্গে। পরমাত্মীয়ার ন্যায় রাজবাড়ির তরফে বিদায় সম্বর্ধনা জানালেন
জোড় হাতে; আমরাও
জোড় হাতে জানালাম প্রতি-বিদায়-সম্ভাষণ।
অজানা
বিস্ময়ের অমোঘ আকর্ষণ আমাদের 'ত্রয়ী' কে নিয়ে
চলল হাঁটাপথেই পরিত্যক্ত পুষ্করিণী ও মন্দিরগুলির পরিদর্শনে। রাজবাড়ির
পশ্চাৎভাগেই রয়েছে সুইমিং পুল। রাজবাড়ির বাইরের ন্যায় ভিতরেও রয়েছে
সান্ধ্য স্ন্যাক্সের ব্যবস্থা,অবশ্যই ধার্য্যমূল্যের বিনিময়েই। প্রতি
সন্ধ্যায় রাজবাড়ির প্রাঙ্গণ সংলগ্ন সিড়ির দু'পাশ বরাবর সারি ধ'রে প্রতি সারিতে প্রদীপ প্রজ্বলিত হয়। এরপর হয়
সন্ধ্যারতি, গাইডের মুখে শুনলাম।
ভ্রমণ
বিলাসী মনের দর্পণে প্রতিভাত হয় রাত্রের আলো-আঁধারী প্রাঙ্গণের প্রদীপের শোভা-প্রাসাদ
অভ্যন্তরের যে কোনও প্রান্ত এমন- কী করিডোর থেকেও সে'টি দৃষ্টি-নন্দন। ওই আবেশ ধরে রাখতে ইচ্ছে জাগে প্রতি
দিনের জীবনেও। রয়েছে পিয়ানো রুম। যে কোনও
সঙ্গীতানুরাগী পর্যটক সেটির সদ্ব্যবহার দ্বারা আত্মতৃপ্ত হতে পারেন মন চাইলে।
ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে পরের বার এখানে আরেকবার আসতে পারলে ও সেই সঙ্গে নৈশযাপনের
সুযোগ পেলে তখন ও'টি ছুঁতে
পারব আশা রাখি, যেটি এবারে পারিনি।
শোনা গেল
প্রতিটি ঘরে রয়েছে সিড়িযুক্ত পালঙ্ক আর অন্যান্য শহুরে সুযোগ- সুবিধা, কিন্তু প্রাচীন আদলেই। তবে পালঙ্কে শুয়ে পুরাতনী আমেজে গুনতে চেষ্টা করা যেতেই পারে সিলিংয়ের
কড়ি - বরগা।
জানা গেল পরিচালক সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে ঋতুপর্ণ ঘোষ তাদের চিত্রনাট্যে
ব্যবহার করেছিলেন এই ঘরগুলিকে। শুনলাম 'গয়নার বাক্স' ও ' চোখের বালি'- র স্যুটিং নাকি হয়েছিল এখানকার ঘরেই।
প্রাসাদের
বাইরের সকল স্থান আমাদের মতন এক বেলার আগন্তুকের জন্য খোলা- ঘুরে বেরিয়ে দেখবার জন্য।জঙ্গলে ঘেরা
জলের মধ্যস্থ স্থাপত্য- 'জলটোরি'। এর নামানুসারে স্থানটির নাম হয়েছে 'জলটোরির বাগান'। বন্ধুরা এখানে এসে এটি মনে করে
দেখবার সময়ে আমাদের মতই স্মরণে আনবেন- ঐ স্থাপত্যের উপরে পুজারতা ঐশ্বরিয়া
আর সঙ্গে বুম্বাদাকে দেখা গিয়েছিল ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত 'চোখের বালি'- র পর্দায়, গাইড জানালেন।
এই
রাজবাড়িটিতে ঘুরে আসবার পর এটি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নানান
তথ্য আহরণ করলাম ও এগুলির একটি সংকলিত রূপ পাঠক বন্ধুদের কাছে তুলে ধরছি। রাজবাড়ি
থেকে ফার্ম- হাউসের দূরত্ব প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার। ফার্ম- হাউসটির একটি অংশ 'গাছ- বাড়ি' নামেও খ্যাত। এখানে বিভিন্ন মূল্যে
থাকবার ব্যবস্থা রয়েছে।পাশাপাশি বেশ কিছু তাঁবু রয়েছে। এগুলির ভিতরটি শহরের বড়
হোটেলের ন্যায়। রয়েছে ক্রীড়া এবং কনফারেন্সের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষ। আর গাছগুলির
পরিচয় লিপিবদ্ধ তাদের গায়েই। নানান চেনা আর অচেনা গাছে ঘেরা এই 'গাছ- বাড়ি'।
গাইডের
বদান্যতায় জানতে পারলাম, বাওয়ালির মন্ডল জমিদারদের আসল পদবী
ছিল রায়। শোভারাম রায় 'মন্ডল' উপাধী দ্বারা সম্মানিত হন।তার নাতি
রাজারাম সেনাবাহিনীতে সাহসিকতার পরিচয়দানের পুরষ্কারস্বরূপ হিজলীর সম্রাটের নিকট
হতে বজবজ এবং বাওয়ালিসহ মোট ৫০ টি গ্রামের শাসনাধিকার অর্জন করেন। ১৭১০ সাল নাগাদ তারা বাওয়ালিতে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে শুরু করেন।
রাজারামের নাতি হারাধন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনীর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন এবং তার
পূত্রেরা বাওয়ালিতে বহু মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
একের পর
এক মন্দির ঘুরে চলেছি। অগুনতি মন্দির। একজন গাইডের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অন্ততঃ
তিনশত বছরের পুরাতন প্রায় একশত মন্দির বেষ্টিত বাওয়ালিতে প্রথম মন্দির প্রতিষ্ঠা
হয়েছিল হরনন্দ মণ্ডলের পাওয়া স্বপ্নাদেশ থেকেই। তিনি স্বপ্নাদেশ পান রাধা-কৃষ্ণ
মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য।
একটি
অক্ষত মন্দিরে পূজার্চনা চলছে। অন্যগুলি ভগ্নপ্রায়; কিছুক্ষেত্রে চলেছে মেরামতির কাজ।
বংশানুক্রমে 'মন্ডল' উপাধী আরোপিত উত্তরপ্রদেশজাত 'রাই' বংশটি সমকালীন জমিদারদের মধ্যে যথেষ্ট
খ্যাতি অর্জন করেছিল। সে সময়ে মন্দির নির্মাণ যথারীতি একটি প্রথায় পরিণত হয়েছিল। ওই
কৃষ্ণভক্ত পরিবারটি বাওয়ালি রাজত্বকাল চলাকালীন প্রায় ৭০ বছর ধরে বাওয়ালি তথা
পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রচুর কৃষ্ণমন্দির স্থাপন করেন। এগুলি সমসাময়িক স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও শিল্পকলার নিদর্শনবাহী।
বাওয়ালিতে
অবস্থিত মন্দিরগুলির মধ্যে আকারে ও দৈর্ঘ্যে সর্বাপেক্ষা বড় রাধাগোবিন্দ জীউর
মন্দিরটি। এটি নির্মিত হয় সম্ভবতঃ ১৭৯৪ সালে। প্রবেশদ্বারের গায়ে আজও শোভিত কিছু
বিলীয়মান ফুলের নকশা। নবরত্ন শৈলীতে গঠিত মন্দিরটির উচ্চতা
দেখবার মতো। মন্দিরের ত্রিস্তরবিশিষ্ট প্রবেশদ্বার আজও আহ্বান জানায় ভ্রমণ পথের
অতিথিদের, আর কানে কানে ফিসফিসিয়ে জানিয়ে চলে
গৌরবময় অতীতের গল্প-
গাঁথা।বহুদিন যাবৎ মন্দিরের ছাঁদ ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রায়। যেটুকু
অবশিষ্ট তা- ও নিশ্চিহ্ন হবার পথে।
কিঞ্চিত
দূরত্বে বিরাজিত আরও কতিপয় সমকালীন মন্দিরের স্থাপত্য। খানিক
এগিয়ে দেখতে পেলাম রাধাশ্যাম মন্দির সংলগ্ন নাটমন্দির। বর্তমানে এটির অবস্থা অতীব
শোচনীয়। তবু জীর্ণ মন্দিরটির শিল্প- স্থাপত্যে
বন্দী হয়ে আছে প্রবীণ ইতিহাস। নাটমন্দির থেকে যত ভিতরে যাচ্ছি, শোনা যাচ্ছে স্থাপত্যের নীরব কণ্ঠ-_ জানিয়ে চলেছে তার বহু ঐতিহাসিক
সাফল্যের কাহিনী। অন্যদিকে বাংলার ঘরে ঘরে স্থিত আমার পাঠক বন্ধুদের ন্যায় সহসা
উদাস ও বিহ্বল আমিও। আশৈশব পরিচিত দক্ষিণেশ্বর নাটমন্দিরে
ভবতারিণী মায়ের সমুখে উপবিষ্ট ভজনকারিনীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল মনে- '... যেথা আছে শুধু ভালোবাসাবাসি সেথা যেতে প্রাণ চায় মা...'। সমগ্র বিশ্ববাসীর এই একটিই চাওয়া- মহামারী
সে'টি একাই
আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে গেছে।
এর ঠিক
পাশেই রয়েছে আটচালা শৈলীতে নির্মিত রাধাশ্যামসুন্দর মন্দিরটি। জমিদার পরিবারের সদস্য প্রিয়লাল মন্ডল কৃত এই দেবাঙ্গনটি। এখানকার
অন্যান্য মন্দিরগুলির ন্যায় এটির মেঝেও মার্বেল পাথর দ্বারা প্রস্তুত। দেওয়ালে
বিভিন্ন ফুলের নকশা ছিল, তা স্পষ্ট; তবে কালের প্রভাবে তা নষ্ট হয়ে গেছে। মন্দিরের
অভ্যন্তরে অপেক্ষমান ছিল আরও বিস্ময়! মাত্র কয়েক শতকের ব্যবধানে কত না আড়ম্বর
ছিল এখানে!
ঠিক পাশেই
ত্রিস্তর বিশিষ্ট প্রবেশদ্বারের গায়ে ফুলের নকশাযুক্ত আরেকটি আটচালা শৈলীর
মন্দির। তবে পাশাপাশি মন্দির দুটিই বর্তমানে
গৃহদেবতার। এতদ্ভিন্ন আরও কিছু মন্দির এখানে বিরাজমান। তার মধ্যে
উল্লেখযোগ্য রাধাবল্লভজীর মন্দির,রাজ-রাজেশ্বর মন্দির প্রভৃতি। একই
জায়গায় এতগুলি কৃষ্ণ মন্দিরের অস্তিত্ববিশিষ্ট বাওয়ালি বা মন্দির- নগরীর নামকরণ
হয়েছিল 'নব-বৃন্দাবন', জানা গেল।
কথিত আছে, আদি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরটির সূত্রও নাকি
এখানেই প্রোথিত। রাধাশ্যামসুন্দর মন্দিরের পার্শ্বস্থ ভগ্নপ্রায় দ্বিতল বাড়িটিই
হ'ল “মন্ডল-ভিলা”। ঐতিহ্যমন্ডিত ভিলাটির দেওয়ালের
প্লাস্টার খসে গিয়েছে। ভিলাকে ঘিরে থাকা যে উদ্যান বা বাগানের
কথা শুনে এসেছিলাম, তা আজ চিহ্নহীন।
মন্ডল
পরিবারের বড়-তরফ জমিদার কলকাতার
টালিগঞ্জ রোডে তৈরী করেন রাসমন্দির। এখানে
নাটমন্দির ও রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরটির
নির্মাণ শুরু হয় ১২৩৫ বঙ্গাব্দে এবং প্রতিষ্ঠা হয় ১২৪১ বঙ্গাব্দে।প্রায় ২০০ বছর বয়স্ক এই প্রাচীন
মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করে চলেছেন লোকমাতা রাণী রাসমণির কন্যার বংশধরেরা।
টালিগঞ্জ
রোডেই রয়েছে ছোট-তরফ জমিদারের রাসমন্দিরটিও।প্রবেশ পথে দুটি শিলাতে প্রাপ্ত-আরম্ভ
১২৫২ বঙ্গাব্দ ও প্রতিষ্ঠা ১২৫৬
বঙ্গাব্দ। এখানকার নবরত্ন মন্দির তৈরি করেন ছোট
জমিদার প্যারীলাল এবং মনিমোহন দাসমন্ডল। টালিগঞ্জের
দুই বাড়ির প্রথমটিতে কার্তিক পুজো ও দ্বিতীয়টিতে চৈত্র পুজো হয় সম্বৎসর। তিন দিন ধ'রে মেলাও বসে। ১২২৩
বঙ্গাব্দের ফাল্গুনমাসে কৃষ্ণা একাদশীর দিন টলিগঞ্জে বর্তমান দ্বাদশ শিব মন্দিরের
মাঝখানে সাজানো চিতায় সহমৃতা হন বংশের জনৈক পূর্ব-পুরুষ মানিক মণ্ডলের স্ত্রী, শোনা যায়। সতী মুক্তকেশীর শাঁখা-
সিঁদুর নাকি অদ্যাবধি রক্ষিত টালিগঞ্জের বাওয়ালিদের বাড়িতে।আদি গঙ্গার ধারে এক
কালে তৈরী হয়েছিল 'গঙ্গা
গোবিন্দের ঘাট', 'গোপালজীর
ঘাট'।
কথিত আছে, রাণী রাসমণি ওই নবরত্ন মন্দির দর্শনে
এসে অনুপ্রাণিত হয়ে মাতা ভবতারিণীর মন্দিরটি হুবহু একই ধাঁচে করবার পরিকল্পনা
করেন। আর
এখানকার পুকুরবেষ্টিত আটচালা শিবমন্দির দ্বারা প্রভাবিত হ'য়ে প্রতিষ্ঠা করলেন গঙ্গার ধারে দ্বাদশ
শিবমন্দির। তবে নবরত্ন মন্দিরে চাতাল আছে, নাট
মন্দির নেই। কিন্তু রাণীমা মা ভবতারিণীর মন্দিরের
সামনে রচনা করলেন নাটমন্দির।
'বাওয়ালি' নামটিকে অনেকে হট্টগোল সংক্রান্ত অর্থে
প্রয়োগ ক'রে থাকে।
তবে এক্ষেত্রে
নামটি গভীর ও বিশেষ অর্থবহ।এমনিতে 'বাওয়ালি' বলা হয় সুন্দরবনের গোলপাতা
সংগ্রহকারীদের। নানা মুনির নানা মত অস্বীকার করি কি
করে! কারও মতে, সুন্দরবনের
কাঠকাটা শ্রমিক শ্রেণীই বাওয়ালি। কাঠ কাটবার সময়ে হিংস্র জন্তুর আক্রমণ
ও অন্যান্য দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে ওই কাঠুরেরা বাউলদের সাহায্য নেয় বলে তাদের
নাম হয়েছে 'বাওয়ালি'। লোকবিশ্বাস মতে, বাউলেরা বাঘ- বাঁধা মন্ত্র জানে। তারা গণ্ডি কেটে বাঘকে বন্দী করে
কিম্বা মন্ত্র পড়ে বাঘের মুখ বন্ধ করে দেয়। ভ্রমণকাহিনী লেখিকার অজানা বহু মতও
রয়েছে। তবু বহুবিধ জ্ঞাত মতামতের নির্যাস, অতীতে ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের বলা হ'ত 'বাওয়াল সম্প্রদায়'। আর 'ই' প্রত্যয় যোগে উৎপত্তি 'বাওয়ালি' নামের। অবশ্য
লোককথা অনুসারে, 'বনে এলি
গেলি'- এই কথাই 'বাওয়ালি' নামের উৎস।
নামের
সূত্রে কি যায় আসে! প্রাসাদ আর একগুচ্ছ মন্দিরের সিংহভাগ বাওয়ালি জমিদার বংশের
দেবত্র সম্পত্তি। দীর্ঘ অবহেলায় কিছু মন্দিরের হাল খুব
খারাপ। গোবিন্দজী এবং লক্ষ্মী-জনার্দনের মন্দির আর দ্বাদশ শিবমন্দিরের ছত্রে
ছত্রে প্রাচীন স্থাপত্যের ছাপ মনকে উড়িয়ে নিয়ে যায় ইতিহাসের জগতে।জানা গেল ঐ
বংশের বর্তমান পুরুষ তাদের মন্দিরগুলিকে ভীষন ভালোবাসেন- বাঁচিয়ে রাখবার পক্ষেই। পালাপার্বণে
কেবল ক'দিনের
জন্য জেগে ওঠে আধুনিক বাওয়ালির মন্দিরগুলির ভগ্নাংশ।
শুধুমাত্র
ভ্রমণকাহিনী পাঠ দ্বারাই যারা ভ্রমণের স্বাদ মেটাবেন তাদের সঙ্গে আমার ভীষন
সহমিল। কবিগুরুর ভাষায় অকপট বিনিময় তাদের জন্য- 'আমি ভ্রমণ করতে ভালোবাসি, কিন্তু
ভ্রমণের কথা কল্পনা করতে আরও ভাল লাগে'।
বাওয়ালির
আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আরও অনেক অজানা ইতিহাসের পাহাড়। সেগুলি
জানবার পর পাঠক বন্ধুরা তথ্য বিনিময় করলে আমি ও অন্যান্য বন্ধুরা সমৃদ্ধ হব, নিঃসন্দেহে।
এই লেখা
শেষ করবার মুহূর্তে অবগত হলাম আমাদের অত্যন্ত প্রিয় জুটি রাজ ও শুভশ্রীর শুভ
পরিণয় সংক্রান্ত রিসেপশন পার্টির অনুষ্ঠানটিও এখানেই সম্পন্ন হয়েছিল। বাওয়ালিতে
ভালো লাগার সমস্ত অভিজ্ঞতা বিনিময় করলাম। এটি পাঠকদের অবকাশকে কিছুটা আনন্দময় করে
তুললে সার্থক হ'বে আমার 'ভ্রমি বিস্ময়ে!!'...।
বিকেল
সাড়ে পাঁচটা নাগাদ রওনা দিয়ে একই পথে সাড়ে সাতটার মধ্যে ফিরে এলাম আমাদের লবণ
হ্রদের আধুনিক উপনগরীতে, পুরনো
ঠিকানায়।তবে অজানাকে জানতে, বুঝতে, গভীরভাবে অনুভব করতে আরও ঘুরে বেড়াব
বিদেশে, দেশে, দূরে, কাছে- পিঠে, যখন যেখানে মন চায়। চলো চলে যাই, হাতে হাত রেখে ক'জনে! ইতি
"আমি
চঞ্চল হে,
সুদূরের পিয়াসী"।
0 মন্তব্যসমূহ