ব্যাগের মধ্যে মোবাইলটা বাজছে। ঘরের তালা খুলতে খুলতে কান আর গলার ফাঁকে মোবাইল ফোন চেপে ধরে রেখা বলে, “হ্যালো? বলুন।”
“আপনি কে বলছেন?”
“আপনি কে বলছেন সেটা আগে বলুন,
ফোনটা তো আপনি করেছেন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ বলছি বলছি। আমি
বারাসাত থেকে বলছি। আপনারা কি ‘দিবসরাত্রি’ কাগজে পাত্রী চাই এ বিজ্ঞাপন দিয়েছেন?”
“হ্যাঁ, দিয়েছি।”
“আপনি কে বলছেন?”
বিরক্তি চেপে রেখে রেখা “আমি
ছেলের মা। বলুন, আপনি কি জন্য ফোন করেছেন?”
“না, মানে আপনার ছেলে কোথায় থাকে?”
“বিজ্ঞাপনে তো উল্লেখ করাই আছে,
ছেলে বিদেশে চাকরি করে। এও লেখা আছে যে পাত্রীর ফটো আর সংক্ষিপ্ত বিবরণ হোয়াটস
অ্যাপে জানাতে হবে। আমাদের পছন্দ হলে আমরা যোগাযোগ করে নেব!”
ওপ্রান্তের স্বর কাঁচুমাচু,
“হ্যাঁ সে তো লেখাই আছে। তবুও মানে জানতে চাইছিলাম, মানে আজকাল যা সব হয়েছে, ওই
মানে ম্যাট্রিমনি থেকে বিজ্ঞাপন দেয় তো, মানে জেনুইন পার্টি কি না সেটাই জানতে
চাইছিলাম। এই আর কি...”
“ঠিক আছে, আমি এখন কথা বলার
অবস্থায় নেই। আপনি সন্ধ্যার পরে ফোন করবেন, কেমন?”
এই বলে ফোনটা কেটে দেয় রেখা। খুব
রূঢ় ভাবে কথা বলতে খারাপ লাগে। যার কন্যাদায়, তার কষ্ট কে বুঝবে? সে চেষ্টা করে
সকলের সঙ্গে মোটামুটি মাথা ঠাণ্ডা রেখে কথা বলতে। মাঝে মাঝে পেরে ওঠে না। আজকাল
মাঝে মাঝেই মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে। প্রেসার চেক করানোর ব্যাপারটা রোজই ভুলে
যাচ্ছে। মোবাইল ফোনে আজও ধাতস্থ হতে পারেনি সে। তবুও ছেলের জন্য ফোন ব্যবহার করতেই
হয়। তবে স্কুলে সে ফোন নিয়ে যায় না। মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরে নিজে হাতেই চা বানিয়ে
নেয়, চা খেতে খেতে পেপার পড়ে রেখা। তারপর স্নান করে ঠাকুরকে একটু জল-বাতাসা দিয়ে
দুটি ঝোল ভাত খেয়ে স্কুলে যায়। এত সকালে সাধারণত ফোন আসে না। যারা ওর রুটিন জানে,
তারা সন্ধ্যার পরেই ফোন করে। চা আর পেপার নিয়ে ড্রইং রুমে জুত করে বসে রেখা। একটু
পরেই মণি এসে যাবে। মণি তার পুরনো কাজের লোক। রান্না করে। দরকার হলে টুকটাক বাজারও
করে দেয়। টুকিটাকি সবজি-পাতি, বিস্কুট ইত্যাদি ফুরিয়ে গেলে ওকে আগের দিনই টাকা
দিয়ে রাখে রেখা। মণি এনে দেয়। ছুটির দিন রেখাই নিজে হাতে বাজার করে সারা সপ্তাহের
মাছ, তরিতরকারি, দুধ, পাউরুটি ইত্যাদি। মুদি দোকানের মাসকাবারি বাজার ফর্দ মণির
হাতে পাঠিয়ে দিলে ওরা বাড়িতে পৌঁছে দেয়। এবার দরজায় বেল বাজলো। মণি এসেছে। দরজা
খুলে দিয়ে রেখা ফোন আর কাগজ রেখে স্নানে যায়।
বাণীমন্দির উচ্চ বিদ্যালয়ের বড়দিদিমনি
রেখা পাল। আজকাল স্কুলের ঝামেলা আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে। বছরে তিন চারবার
বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা ও পরিচালন সমিতি পরিদর্শনে আসে। রাজ্যের
ফাইলপত্র রেডি রাখতে হয়। প্যারেন্ট-টিচার মিটিং থেকে আরম্ভ করে সব টিচারদের ডিউটি
ভাগ করে দেওয়া, স্কুল কমিটির মিটিং, নন-টিচিং স্টাফদের অভাব-অভিযোগ,
ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা, ইত্যাদি হাজারো ঝামেলা সামলে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।
স্কুলের কাজ বাড়িতেও পিছু ছাড়ে না। মণি রান্নাবান্না সেরে দিয়ে বিকেলে চলে যায়
রেখা ফেরবার অনেক আগেই। ওর কাছে এক সেট চাবি থাকে। সন্ধ্যায় রেখা বাড়ি ফিরে এলে
আটটার দিকে আসে তরু। ওর মা আগে এ বাড়িতে কাজ করত। রেখার শাশুড়ির সময় থেকে। এখন বয়স
হয়ে গেছে। কাজ করতে পারে না। তরু রাত্রে রেখার কাছে থাকে। খাল পাড়েই ওদের বস্তি।
রাত্রের খাবার গরম করে দেয়, রেখার সঙ্গে টিভি দেখে। ড্রইং রুমে লো ভলিউমে টিভি
দেখছে তরু। শোওয়ার ঘরে অনুচ্চ স্বরে ফোনে কথা বলছে রেখা। আলোক রবিবার ফোন করে।
সারা সপ্তাহের সব জমানো কথা হয় তখন ওর সঙ্গে। কয়েক সপ্তাহ আগেই কথা হচ্ছিল, “কিরে,
তোর মতলবটা কি বল তো? বিয়ে ফিয়ে করবি না? নাকি মেমসাহেব বিয়ে করবি ঠিক করে রেখেছিস?
আজকাল তো আবার বিয়ের আগেই একসাথে থাকে, লিভ ইন না কি যেন বলে?”
“ওসব কিচ্ছু না মা। তুমি এত ভেব
না। কাজের চাপে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”
“না রে বাবু, শরীরটা আজকাল ভাল
যাচ্ছে না। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে। যদি তোর বৌ দেখে যেতে না পারি?”
“আমার বৌ দেখে যাওয়াটা বড় কথা নয়।
মাথা ঝিমঝিম করছে তো তুমি দেবাশিস কাকুকে দেখাচ্ছ না কেন? শোন, আমি কাকুকে ফোন করে
বলব?”
“না না, আমিই চলে যাব। স্কুলের কাজের
চাপে যাওয়া হয়ে উঠছে না। তুই বল না, বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভাবছিস?”
“না না এখনই কিছু ভাবছি না।”
“কেন? তোর গার্লফ্রেন্ড নেই?”
“থাকলে কি তোমাকে বলতাম না?”
“তাহলে?”
“কি তাহলে?”
“বয়স তো হচ্ছে বাবু! এ বছর তিরিশ
হল তোর। বিয়ে করবি না?”
“কাকে বিয়ে করব? পাত্রী কোথায়?”
“কেন তোর ওদিকে জানাশোনা হয়নি
কারো সঙ্গে?”
“হয়েছে তো। ওরা সব বিবাহিত বা
অলরেডি এনগেজড।”
“তাহলে, তুই যদি বলিস, আমি এখানে বাংলা
কাগজে বিজ্ঞাপন দিই?”
আলোক জোরে হেসে ওঠে, “ওসব
বিজ্ঞাপন দিয়ে আজকাল বিয়ে টিয়ে হয় না মা। এখন সব ম্যাট্রিমনি সার্ভিস নয় তো
অ্যাপের থ্রু যোগাযোগ হয়।”
“তাহলে তুইও সেইসব কর না?”
“মা, তোমার আজকাল কি হয়েছে বলো
তো? যখনই ফোন করি, শুধু বিয়ের কথা বলতে থাকো কেন?”
রেখা চুপ করে থাকে। তার
দীর্ঘশ্বাস শুনে আলোক বলে, “বেশ, তুমি কাগজে বিজ্ঞাপন দাও।”
রেখা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, “দেব? তুই
বলছিস?”
“হ্যাঁ, তারপর পাত্রীর বাড়ি থেকে
যখন যোগাযোগ করবে, আমাকে পাবে কোথায়?”
“কেন? তুই আসবি। আমি চার-পাঁচটা
মেয়ে বাছাই করে রাখব। তুই এসে যাকে ফাইনাল করবি, তার সাথেই বিয়ে পাকা করব।”
আলোক হাসে, “এভাবে হয় না মা।”
“এভাবেই হয়। এই তো সেদিন রত্না
বলছিল ওর ননদের মেয়ের কি সুন্দর পাত্র জোগার করেছে পাত্রপাত্রী বিজ্ঞাপন দেখে।”
“ঠিক আছে মা, তুমি দেখ। আমার কোন
আপত্তি নেই। তবে হুট করে বললে তো আর আসা যাবে না।”
“না না, আমি সেভাবেই কথা বলে নেব।”
এরপর রেখা ‘দিবসরাত্রি’ কাগজে
পাত্রপাত্রী কলামে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। প্রত্যেকদিন স্কুল থেকে ফিরে ফোনের কল লিস্ট
ভরে থাকা সেইসব অজানা নম্বরের মিসড কল দেখে দেখে কল ব্যাক করে। কত পরিবার, কত
বিচিত্র গল্প, কত রকমের কথা, অদ্ভুত সব দাবী আর উদ্ভট শর্ত। কারো সঙ্গে দুটো কথা
বলেই রাগ করে রেখে দেয়, কারো সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে বাক্যালাপ চলে, কারো সঙ্গে কথা
বলতে বলতে সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়, কারো সঙ্গে কথা কাটাকাটি পর্যন্ত হয়ে যায়। মিষ্টি
মিষ্টি মেয়েদের হাসিমুখের ছবি, সঙ্গে তাদের জন্ম তারিখ, সময়। রেখা ছবিগুলোর দিকে
তাকিয়ে থাকে। এমনই একটি মেয়ে তার আদরের বাবুর বৌ হয়ে আসবে। সে অচেনা কোন ছবির গায়ে
স্নেহের ছোঁয়া দিয়ে বলে, “কিরে, আমায় মা বলে ডাকবি তো? আমার বাবুকে ভালবাসবি তো?”
শ্বশুরমশাইয়ের কাছ থেকে যোটক মেলানো শিখেছিল। আলোকের জন্ম তারিখের সঙ্গে পাত্রীর
জন্ম তারিখ মিলিয়ে যোটক বিচার করে দেখে রেখা। যেটা মোটামুটি মেলে, সেটা ডায়রিতে
নোট করে রাখে। যেটা মেলে না, তাদের মেসেজ করে জানিয়ে দেয়, “দুঃখিত, কুণ্ডলী ম্যাচ
করেনি,” আর ছবিটা ফোন থেকে ডিলিট করে দেয়। এই এক নতুন জগত হয়েছে তার। স্কুলের নানা
ঝঞ্ঝাট থেকে বেরিয়ে এসে একটা অন্যরকম জগতের তাজা হাওয়া যেন। রবিবার আলোক ফোন করলে
ওকে কিছু ছবি দেখায়। কফিতে চুমুক দিতে দিতে আলোক সেসব দেখে হালকা ভাবে দুয়েকটা
মন্তব্য করে। রেখা বলে, “দেখ, বাবু, এই মেয়েটা বেশ সুন্দর না? এদের বাড়ির লোকেদের
ব্যবহারও খুব ভাল, জানিস? তুই খ্রিস্টমাসের ছুটিতে এবার আসছিস তো?”
“হ্যাঁ মা, সেরকমই তো ঠিক আছে।
তবে এখনই কিছু বলতে পারছি না সিওর করে। খ্রিস্টমাসে না আসতে পারলে অন্য যে কোন
সময়ে ছুটি ম্যানেজ করে চলে আসব।”
“না না তা কি হয় বাবু? তোর বাপির
চলে যাওয়ার দিনটা আমরা একসাথে স্মরণ করব না? আর আমি পাত্রীপক্ষদের বলে রেখেছি,
ছেলে ডিসেম্বরে আসবে। তুই টিকিট কেটে রাখিস বাবু, নয়তো পরে পাওয়া যাবে না।”
আলোক অন্যমনস্ক ভাবে বলে, “হুঁ।”
আজও স্কুল থেকে ফিরে রেখা ফোন
নিয়ে বসেছে। গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন ছোটবড় বিবাহ প্রতিষ্ঠানের মেসেজে অতিষ্ঠ হয়ে
উঠেছে সে। আজ একজনের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেল।
“আপনারা আমার নম্বর পেলেন কোথা
থেকে?”
“কেন, আপনি কাগজে বিজ্ঞাপন
দিয়েছেন না?”
“দিয়েছি। আমি পয়সা খরচ করে
বিজ্ঞাপন দিয়েছি। সেটা এই পেপারের সঙ্গে আমার চুক্তি। আপনারা বিনা খরচে সেই বিজ্ঞাপন
থেকে ফোন নম্বর পেয়ে যাচ্ছেন আর পাত্র পাত্রী দু’পক্ষ থেকে ব্যাবসা করতে চাইছেন।
তাই তো? আপনারা তো থার্ড পার্টি, সোজা কথায় দালাল। কিন্তু আমি তো কোন দালালের
ফাঁদে পা দেব না। ফের যদি বিরক্ত করেন, আমি কিন্তু থানায় কমপ্লেইন করব।”
ওপ্রান্তের মেয়েটা অত্যন্ত দুঃসাহসী।
তেড়েফুঁড়ে উঠেছে, “হ্যাঁ করুন কমপ্লেইন। আমরা ফ্রড নই, জানেন? আমাদের সংস্থা কুড়ি
বছরের পুরনো। রেজিস্টারড সংস্থা। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।”
“না, আমার খোঁজ নেওয়ার কোন দরকার
নেই।”
“সেটা আলাদা কথা, কিন্তু আমরা
এভাবেই ডাটা কালেক্ট করে থাকি।”
রেখা রাগে ফোন কেটে দেয়। নম্বরটাও
ব্লক করে দেয়। বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা ছিল যে, পাত্র বিদেশে চাকরি করে। বোধহয় প্রচুর
পয়সা আছে ভেবেই বহু বেনো জল ঢুকে পড়েছে। এমনকি অনামা কিছু ইনভেস্টমেন্ট কম্পানিও
ফোন করছে, মেসেজ করছে। আজ একটা নতুন মেসেজ দেখে আরও বিরক্ত হয় রেখা। চার-পাঁচটা
ছবি, গরীব বাচ্চাদের গরম জামাকাপড় দেওয়া হচ্ছে। ‘পথের সাথী’ লেখা একটি সাইনবোর্ডের
সামনে একটি লোক হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে, নিচে লেখা রয়েছে—“আমরা গরীব শিশুদের জন্য
কাজ করি। আপনার ঘরে পুরনো জামাকাপড় থাকলে আমাদের দেবেন, এই শীতে গরীব বাচ্চাদের
আমরা তা পৌঁছে দেব।”
মেসেজটা দেখে রেখা আশ্চর্য হলেও
মুছে ফেলতে পারে না। তার মনে পড়ে বাবুর ছোট হওয়া জামাপ্যান্ট শাশুড়ি মা খালপাড়ের
বস্তিতে গিয়ে দিয়ে আসতেন। বলতেন, “বৌমা, এত দামী দামী পোশাক ছোটদের জন্য কিনতে
নেই, বাচ্চারা তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে, ওগুলো তখন আর কোন কাজে লাগে না!” রেখা বলত, “মা
আপনি আপনার ছেলেকে বলুন। ও শুনলে তো? আমিও তো কত বারণ করি। এত ড্রেস এনো না। শোনে
কই? আদর দিয়ে দিয়ে ছেলের মাথা খাচ্ছে।”
“বৌমা, তোমরা যদি কিছু মনে না
করো, তাহলে বাবুর ছোট হয়ে যাওয়া পোশাকগুলো আমাকে দাও, আমি বস্তির ছোট ছোট
ছেলেপিলেদের দিয়ে আসব। ওরাও জামা গায়ে দেবে। আমাদের বাবু আশীর্বাদ পাবে।”
কিন্তু পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনে
দেওয়া ফোন নম্বরে যে এত বিচিত্র রকমের যোগাযোগ আসতে পারে, রেখার তা ধারণার বাইরে
ছিল।
দেখতে দেখতে পৌষ মাস পড়ে গেল।
বাবু গত সপ্তাহে ফোন করেনি। বলছিল, ইয়ার এন্ডিং, খুব কাজের চাপ যাচ্ছে। সময় পেলেই
ফোন করবে। এর আগের সপ্তাহে যখন কথা হল, রেখাকে চিন্তা করতে বারণ করল, আর বার বার
করে প্রেসারের ওষুধগুলো নিয়মিত খেতে বলল। রেখা ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইল, “আসবি তো
বাবু?”
“এই তো প্রত্যেক সপ্তাহে দেখা
হচ্ছে মা!”
“এই দেখায় কি মন ভরে? তুই আসবি।
আমি মেয়ে দেখে রেখেছি। তুই তাদের দেখতে যাবি না? বিয়েটা কি হাওয়ায় হবে? তোকে তো
আসতেই হবে। এবছর দেখা সাক্ষাৎ হয়ে কথা এগোলে সামনের বছর গিয়ে বিয়ে হতে পারবে। একটা
জিনিস হতে সময় লাগে না? বিয়ে হল সারা জীবনের ব্যাপার, এ কি ছেলেখেলা?”
“মা, কার সাথে কার কি চক্কোর আছে,
কে জানে? না জানি কেমন মেয়ে এসে কপালে জুটবে? আমি দিব্বি আছি। আবার কি অশান্তি
সেধে সেধে বরণ করব?”
“তুই এখন কেন এসব বলছিস? তোর
কথাতেই তো বিজ্ঞাপন দিলাম। তুই কি আসবি না?”
“ওহ মা, তোমার সেই এক কথা! বিয়ে
বিয়ে। আমি কি বলেছি বিয়ে করব না? এখানেই কারো সঙ্গে চেনাজানা হয়ে বিয়ে ঠিক হলে ভাল
হয়।”
“সে তো আমিও বলেছিলাম। তুই তো
বললি, কেউ দেখা নেই তোর, আমাকে মেয়ে দেখতে বললি...”
“শোন মা, এখন রাখছি। ফোন না পেলে
চিন্তা কোর না। খ্রিস্টমাসে আসতে না পারলেও নেক্সট মান্থে ট্রাই করব। তুমি কিন্তু
মন খারাপ করবে না। মণি মাসিকে নিয়ে কালীঘাটে গিয়ে বাবার জন্য পুজো দিয়ে দিও। আমি
মনে মনে বাবাকে স্মরণ করবই।”
ফোন রেখে দিয়ে রেখা গুম হয়ে থাকে।
মনের ভিতর যেন ছানা কেটে গেছে। চুপ করে বসে থাকতে থাকতে একসময় কি খেয়াল হয়, ‘পথের
সাথী’-র নম্বরে ফোন করে।
ওপ্রান্তের অচেনা ছেলেটি যেন
কৃতজ্ঞতায় গলে যায়। রেখা জানতে চায় ওদের কাজকর্মের কথা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন
করে অনেক। দিদিমণিগিরির স্বভাব। ছেলেটি অসহিষ্ণু হয় না একটুও। সব প্রশ্নের জবাব
দেয়। কেউ তাদের সম্পর্কে এত কিছু জানতে চায় এতেই সে খুশি। বার বার অনুরোধ করে
রাজারহাটে একবার তাদের প্রধান কেন্দ্রে আসবার জন্য। বড়দিন একটা অনুষ্ঠান করে ওরা
পথশিশুদের নিয়ে। রেখাকে আগাম নিমন্ত্রণও করে ছেলেটি। ওর নাম অলোক। কথা বলতে বলতে
ভুলবশত দুয়েকবার মুখ ফসকে আলোক বলে ফেলে রেখা।
২৪ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে একটা
মেসেজ আসে হোয়াটসঅ্যাপে, আলোক একটা ছবি পাঠিয়েছে। উত্তাল সমুদ্র, সাদা ফেনার মত
স্থির একটি ঢেউয়ের সামনে সংক্ষিপ্ত পোশাকে একদল উচ্ছ্বসিত তরুণ তরুণী, যাদের মধ্যে
হাসিমুখে আলোকও রয়েছে। নিচে লেখা, “মা, হঠাৎ একটা সুযোগ এসে গেল। তোমাকে আগে থেকে
বলতে সময় পাইনি। সিসিলি এসেছি। দারুণ জায়গা! অফিসের কলিগদের সঙ্গে এসেছি। এরপর
তোমাকেও একবার নিয়ে আসব। রিয়েলি মা, পৃথিবীতে এত্ত সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে জাস্ট
ভাবতে পারবে না! এনি ওয়ে, মেরি ক্রিসমাস মা। ভাল থেকো। কাল ফোন করব।”
রেখা অনেকক্ষণ সমুদ্রের বুকে
একঝাঁক খুশিমুখের সেই স্থিরচিত্রের সামনে বসে থাকে স্থানু হয়ে। আচমকা যেন তার
জগতটা একেবারে শূন্য মনে হয়। অনেকক্ষণ পরে তরু ডাকে, “পিসীমা, খাবে না?”
এই তরু অল্প বয়সে পালিয়ে গিয়েছিল বিহারের এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে। দু’বছর পরে ফিরে এসেছে একটি মেয়ে কোলে নিয়ে। ও এখন অনেকগুলো বাড়িতে রান্নার কাজ করে। ওর মেয়েকে ভাল স্কুলে ভর্তি করেছে। মায়ের চিকিৎসাও করাচ্ছে। তরুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে রেখা। মুখে ক্লিশে কর্তব্য পালনের রুক্ষতা নয়, আছে দায়িত্ববোধের ছাপ।
রেখা বলে, “খাবার বাড়, আসছি।” তরু
রান্নাঘরে গেলে রেখা উঠে চোখে মুখে জল দেয়। তারপর
পুরনো কাঠের আলমারিটা খুলে দেখে
থরে থরে সাজানো বাবুর ছেলেবেলার কত জামা-প্যান্ট। একটা ঢাউস ট্যুরিস্ট ব্যাগে একে
একে ভরতে শুরু করে সেসব। তাপসকে ফোন করে বলে দেয় গাড়ি নিয়ে সকাল সকাল চলে আসতে।
আজ বড়দিন। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে
এমন এক দিনে রাজীব চলে গিয়েছিল। খুব সকালে উঠে রেখা নতুন গুড়ের পায়েস রান্না
করেছে। রাজীব নতুন গুড়ের পায়েস খেতে ভালবাসত। ঠাকুরকে নিবেদন করে প্রসাদী পায়েস সে
ভরে নেয় একটা বড় টিফিন কৌটোতে। গাড়ির হর্ন শুনে ধীরে ধীরে জামাকাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে
তালা দিয়ে বাইরে আসে। মণিকে ওর ঘর থেকে তুলে নেবে। ওকে আগে থেকে তৈরি থাকতে বলে
দিয়েছে রেখা, তার সঙ্গে কালীঘাটে পুজো দিতে যাবে। তাপস এগিয়ে এসে রেখার হাত থেকে
ব্যাগটা নিয়ে বলে, “কোথায় যাবেন ম্যাডাম?”
“রাজারহাট যাব। ‘পথের সাথী’ চেনো?”
“না। ঠিকানা আছে তো আপনার কাছে? গুগল
ম্যাপে লোকেশন সেট করে দেব।”
রেখা দুর্গা দুর্গা বলে গাড়িতে
ওঠে। হঠাৎ মনে পড়ে, “আরে, ফোনটা আনা হল না যে! আলোক যদি ফোন করে, পাবে না।”
তাপস বলে, “ম্যাডাম, গাড়ি ঘোরাই? ঘরে
গিয়ে ফোনটা নিয়ে আসবেন তো?”
একটু ভেবে রেখা বলে, “নাহ, থাক।”
0 মন্তব্যসমূহ