ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

তন্ত্র মন্ত্র জগতে নতুন নাম- নীরেন ভাদুড়ি - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

 


  • বই -  নীরেন ভাদুড়ি সমগ্র (প্রথম খন্ড)
  • লেখক – সৌভিক চক্রবর্তী 
  • প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
  • প্রকাশনীঃ দীপ প্রকাশন
  • প্রকাশকালঃ এপ্রিল ২০২১
  • মুদ্রিত মূল্যঃ ৩০০/- 


বাংলা সাহিত্যে তন্ত্র মন্ত্রের আবির্ভাব বা জনপ্রিয়তা সম্ভবত বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত তারানাথ তান্ত্রিকের হাত ধরে। যিনি পরবর্তীকালে বিভূতিভূষণপুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায় নিজের রাজত্ব বিস্তার করেছিলেন। বাঙালি তন্ত্রপ্রেমী পাঠকমাত্রেই তারানাথভক্ত। এবং সেই সুত্র ধরেই বর্তমানকালে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, কালীগুণীন প্রভৃতির আগমন। এই তালিকায় অন্যতম সংযোজন অবশ্যই নীরেন্দ্রনাথ ভাদুড়ি ওরফে নীরেন ভাদুড়ি। তবে এক্ষেত্রে কাহিনী শুধুমাত্র তন্ত্র মন্ত্র আচার বিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ না হয়ে কিঞ্চিৎ রহস্য রোমাঞ্চকেও ছুঁয়ে গেছে। যদিও বর্তমানকালের তন্ত্র মন্ত্র ঘরানার গল্পগুলিকে ঠিক সাহিত্যের পর্যায়ে ফেলা যায় কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়।তাও স্বল্প সময়ের জন্য স্বাদ বদলের খোরাক হিসাবে এই ঘরানার গল্প কাহিনীর জুড়ি মেলা ভার।  

বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজের সংস্কৃতের প্রাক্তন অধ্যাপক শ্রী নীরেন্দ্রনাথ ভাদুড়ি। ভাদুড়ি মশাই সামান্য পঙ্গু হওয়ায় ক্র্যাচের সাহায্যে চলাফেরা করলেও, পঙ্গুত্ব ওনার কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত আনতে পারেনা কখনই। ওনার সাথে আছে আরও কয়েকটি চরিত্র। তিতাস, পল্লব, অমিয়, দীপক প্রমুখ। এঁদের ঘিরেই বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে এবং সেই সব ঘটনার বা দুর্ঘটনার পরিত্রাতারূপে প্রতিবারই অধ্যাপক ভাদুড়ি মঞ্চে প্রবেশ করেছেন।আর এইভাবেই এই বইয়ের গল্পসংগ্রহের প্রথম খণ্ড রচিত হয়েছে। প্রতিটি গল্পের চরিত্ররা একই। তাঁদের মধ্যেই সমস্ত গল্পগুলো আবর্তিত হয়েছে। 

এই ধরণের গল্প বিশেষ বিশ্লেষণ করার অবকাশ দেয়না। তাই খুঁটিনাটি সাহিত্যরস বিশ্লেষণে মাথা না খাটানোই ভালো। শুধুমাত্র মনোরঞ্জনের জন্য পড়তে খারাপ লাগে না। এই বইটিতে মোট তিনটি গল্প আছে। দুটি গল্প ও একটি উপন্যাস। 

গল্প:

- অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ

- পর্ণশবরীর শাপ

উপন্যাস:

- নিকষছায়া। 


নিকষছায়াঃ 

বইয়ের সর্বশেষ উপন্যাসটি প্রকৃতপক্ষে লেখকের নীরেন ভাদুড়িকে নিয়ে রচিত  প্রথম গল্প।এই গল্পেই তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে। তাই “নিকষছায়া” গল্পটি শুরুতে পড়লে জানা যায় কিভাবে ভাদুড়ি মশাই তন্ত্রের জগতে নিজেকে আবিষ্কার করলেন, তাঁর অতীত কি, কোন গুরুর থেকে তাঁর তন্ত্র সাধনার দীক্ষালাভ, কি উদ্দেশ্যে সেই দীক্ষা তিনি নিয়েছিলেন প্রভৃতি বিষয়ে। এই গল্পটি পড়া থাকলে পরবর্তী গল্পগুলোর সূত্র ধরে পড়তে সুবিধা হয়। 


অতীতের এক ঘটনার সাথে বর্তমানে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা জুড়ে যেতে থাকে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মাধ্যমে। বাস্তবগ্রাহ্য যুক্তি তর্ক ধীরে ধীরে পথ হারিয়ে ফেলে অলৌকিক ইঙ্গিতবাহী ঘটনার জটাজালে। এক পিশাচ ও অসম্ভব অসহনীয় এক দুর্গন্ধর সাথে যুক্ত হয় কয়েকটি হঠাৎ উধাও হওয়া মৃতদেহ। বিকৃত তন্ত্রসাধনার বর্ণনায় যখন গা গুলিয়ে ওঠে তখনই মন্ত্রের আঘাতে সেই পৈশাচিক ক্রিয়াকে বিকল করতে ভাদুড়ি মশাই পরিত্রাতারূপে আবির্ভূত হন। সব মিলিয়ে জমাটি কাণ্ডকারখানায় গল্প জমে ওঠে। গল্পের সাথে বেশ কিছু বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা গল্পের রেশ শেষ অবধি ধরে রাখে। গল্পের প্রয়োজনে যৌনতা এলেও তা বিকৃতি বা কদর্যতা তৈরি করেনি। বরং যথাযোগ্য প্রয়োগে গল্পের গতি ধরে রাখতে সাহায্য করেছে।বীভৎস রসকে লেখক খুব সুন্দরভাবে এখানে প্রয়োগ করেছেন।  


পর্ণশবরীঃ 

প্রতিশোধপরায়ণ এক নারী, দেবী পর্ণশবরীকে নরবলি দিয়ে জাগিয়ে তোলে।কিন্তু দেবীকে নিয়ন্ত্রণ করার বা পুনরায় নিদ্রিত না করায় দেবীর প্রকোপ এক অভিশাপরূপে স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর নেমে আসে। তারপর সেই নরকাগ্নি থেকে সমগ্র চটকপুরকে এবং প্রায় উন্মাদ মিতুল ও তিতাসকে বাঁচাতে দেবীর মুখোমুখি হন ভাদুড়ি মশাই। গল্পের শেষে পল্লব আর ভাদুড়িমশাইয়ের দেবীর সামনে আত্মাহুতি দেবার প্রতিযোগিতা আর সেইসাথে শেষমেশ দেবীর স্বরূপে আবির্ভাব এবং অতঃপর শেষ ভালো যার সব ভালো প্রবাদকে মাথায় রেখে চলচ্চিত্রের সঠিক রূপায়নের ভঙ্গিমায় গল্পের সমাপ্তি টানা পড়তে পড়তে বিরক্তি আসলেও অযৌক্তিক গল্পপ্রেমী পাঠককূল লেখককে সাধুবাদ জানাতে বাধ্য হবেন। প্রশ্ন করা যেতে পারে যে একজন পঙ্গু অসুস্থ ও বয়স্ক মানুষ কি করে পাহাড়ি রাস্তায় স্বচ্ছন্দে সমস্ত ক্রিয়াকলাপ সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন, যেখানে সম্পূর্ণ সুস্থ ও জোয়ান মানুষও তা করতে অপারগ!! কিন্তু এই ঘরানার বৈশিষ্টই হল ‘গল্পের গরুকে গাছে চাপানো’। সুতরাং বুদ্ধি খরচ না করে পড়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই মঙ্গল। না হলে সর্বশক্তিমান ত্রিকালদর্শী ঈশ্বরকে বোকা বানানোর মত উদ্ভট যুক্তি রচনা করার কথা মাথাতেও আসে কি করে?


অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদঃ

অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ গল্পটি এই তিনটি গল্পের মধ্যে খানিকটা ভালো লাগে। ভাদুড়ি মশাইয়ের যৌবনকালের গল্প এটি । জলদাপাড়ায় গন্ডার পোচিং, এক শয়তান তান্ত্রিক, মাকড়খাকি প্রেতের দল এবং মহিষ দেবতা টাঁড়বারোকে কেন্দ্র করে রচিত গল্পটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক টানটান গতিতে এগিয়ে চলে।এই গল্পে লেখক সমাজে পতিতাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে এক হৃদয়গ্রাহী যুক্তিগ্রাহ্য বর্ণনা দিয়েছেন, যা পড়তে ভালো লাগে। গহিন অরণ্যের গভীর গর্ভে তন্ত্রসাধনা পাঠকমনে রোমাঞ্চের সঞ্চার করতে সক্ষম হয়। 

বইয়ের ভূমিকাতে লেখক দাবী করেছেন এই বইয়ের কাহিনীগুলো অপর দশটা তন্ত্র নির্ভর গল্পের চাইতে সম্পূর্ণ পৃথক। এই কাহিনীগুলো আদ্যন্ত যুক্তি নির্ভর, অলৌকিকের অ্যান্টিথিসিস। যদিও গল্প পড়ে সেরকম কিছু মনে হয়না।যুক্তি ও লৌকিক জ্ঞান বজায় রাখলে এই গল্প লেখা বা পড়া কোনটাই সম্ভব নয়। সেই এক ধরণের আর দশটা গল্পের মতই শুরু থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত নানা রকম ভয় ভীতি দেখিয়ে, চরম বিকৃত বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরী করে, আজগুবি তন্ত্রসাধনার ততধিক আজগুবি আচারবিধি জানিয়ে, নানান মন্ত্রতন্ত্রের ক্ষমতা দেখিয়ে, একদম বিপদের শেষ সীমায় পৌঁছে উত্তেজনায় দম আটকে বিপর্যস্ত হয়ে যখন হাল ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে ; সেইরকম চরম পরিস্থিতির অন্তিম বেলায় জাদুবলে মাথায় বিদ্যুৎ চমকে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার রাস্তা আবিষ্কার করে দুষ্টের দমন করে ফেলা। তবে লেখকের এইসব দাবী দাওয়া বাদ দিলে, গল্পের বুনট ও ঝরঝরে লেখনীর গল্পগুলো পড়তে খারাপ লাগে না। প্রচ্ছদ ও অলংকরণও যোগ্য সঙ্গত করেছে।এবং স্বীকার করতে বাধা নেই হাজার হাজার  তন্ত্র-মন্ত্র ঘরানার গল্পের ভিড়ে লেখনীর গুণে এই বইটি অতি অবশ্যই ভিন্ন স্বাদ বহন করে।  সবমিলিয়ে সময় কাটানোর জন্য একবার পড়াই যায়। 






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ