"রথযাত্রা
লোকারণ্য মহা ধুমধাম
ভক্তেরা
লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম;
পথ
ভাবে, 'আমি দেব', রথ ভাবে, 'আমি ',
মূর্তি
ভাবে, 'আমি দেব '- হাসে অন্তর্যামী।"
হিমানীশ
গোস্বামীর 'অভি-ধানাই-পানাই'- এর সোলার
কুকারের ভাষায় বন্দিত হোক 'অমৃত-কবচ' ORS ও তার প্রকৃত জনক। লোকাচারে নিমগ্ন মানুষ
হদিশই পায় না পরম সত্যের। ঠিক যেমন অদৃষ্টের পরিহাস বর্ষিত হয়েছিল প্রাসঙ্গিক নররূপী
ORS-জনকের উপর।
নর-নারী-কিন্নর
অধ্যুষিত সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলিতে বহমান জীবকুলের অস্তিত্ব রক্ষার্থে মৃত্যু রুখতে
এ জগতে বারম্বার সৃষ্টি হয়েছে উর্বরমস্তিষ্ক প্রসূত প্রাণদায়ী খাদ্যরস, যা 'অমৃত',
'সুধা', 'পীযুষ', 'মকরন্দ' বা 'অমিয়' নামেও পরিচিত। ঋকবেদের গ্রন্থগুলিতেও 'অমৃত'
শব্দটির উল্লেখ রয়েছে।
পুরাণে কথিত, সাগর মন্থনে চৌদ্দরত্ন লাভের অন্তিম লগ্নে প্রাপ্তি
ঘটে ধন্বন্তরি আনীত 'অমৃত'- এর। বজ্রযান পন্থার বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ 'দি ইমাক্যুলেট ক্রিস্টাল
garland'- এ বর্ণিত 'রাহু' নামক রাক্ষস 'অমৃত'
হরণ করেছিল। সেই অপরাধে বজ্রপানি বুদ্ধ তাকে শতধাছিন্ন করেছিলেন। অথচ অমৃত পান করবার
কারণে মৃত্যু হলো না তার। উপরন্তু তার রক্ত পৃথিবী পৃষ্ঠে পতিত হয়ে জন্ম নিল নানান
ঔষধি গাছ-গাছড়া। ধর্ম অর্থাৎ ন্যায়ের পথে চলমান মানবকুলসহ সমগ্র পৃথিবীকে পাপ এবং
মৃত্যুর হাত হতে রক্ষা করতেই বুদ্ধদেব রাহুর রূপধারণ করেছিলেন, এটাই লোক-বিশ্বাস।
আসল কথা, যুগান্তব্যাপী সংঘটিত মহামারীর কালগুলিতে যথাসাধ্য প্রাণরক্ষার
প্রয়াসে সমকালীন যোগ্য পণ্ডিতমন্ডলী প্রস্তুত করেছেন কবচ, মাদুলী, নানান ঔষধি ও অমৃত রসসুধা। সেগুলি ধারণ অথবা সেবনের দ্বারা জীবনধারা
অব্যাহত রাখবার মানসিক ও শারীরিক শক্তি অর্জন করেছেন আমাদের বর্তমান ও পূর্বসূরীরা।
দেবতার চরণামৃত লাভে শক্তিবৃদ্ধির এক উপায়টিও আশা করি পাঠকবন্ধুদের অজানা নয়। করোনার
কবল থেকে বাঁচতে সম্প্রতি উদ্ভাবিত 'ভ্যাকসিন' ঐরূপ অমৃতেরই দৃষ্টান্ত, বলা যায়।
এ হেন আর এক মৃত্যুঞ্জয়ী অমৃত-কবচের লোকায়ত নাম ORS, বা ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন।
বৈষ্ণব কবিদের রচনায় প্রায়শঃই লক্ষিত হয়, দেবতাকে প্রিয় মেনে প্রিয়কে দেবতা
মানবার মনস্তাত্বিক প্রক্রিয়া। নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী রচিত 'দেবতার মানবায়ন' গ্রন্থে
মনোগ্রাহী আলোচনার মধ্য দিয়ে অঙ্কিত হয়েছে এই পরম্পরা। বেদ-পুরাণ, কবি-মহাকবির বহুবিধ
কবি-কীর্তির মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে দেবতা, অসুর, রাক্ষস, মহাপুরুষ নির্বিশেষে এক সুদীর্ঘ
পরম্পরা।
"বহুরূপে
সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর..."- স্বামীজির এই উক্তির মর্ম আমরা বয়ঃপ্রাপ্তির
সঙ্গে সঙ্গে অধিকতর উপলব্ধি করি। তবু আত্মম্ভর কলকাতাবাসী একই শহরে বসবাসকারী আত্মপ্রচারে
বিমুখ অথচ ' ... সংগোপনে সুধারস ... ' দ্বারা ১৯৭১ সাল থেকে সাত কোটির অধিক প্রাণ
রক্ষাকারী বীর বাঙ্গালী বিজ্ঞানী সাধক তথা শিশু চিকিৎসকটির সন্ধানই করলেন না তাঁর
জীবদ্দশায়! নেট-দুনিয়া এমন কি সমগ্র বিশ্বের সিংহভাগ মানুষের অপরিচিত এই দেবতায়িত
মানুষটির নাম ডাঃ দিলীপ মহলানবীশ।
মাত্র
তিন মাস আগের কথা। সেদিন ছিল ১৯ শে জুলাই, ২০২২। বহু চিকিৎসক ও উৎসাহীদের ভিড়ে কলকাতার হো-চি-মিন সরণিতে 'একশো তারার আলো' শীর্ষক বাঙ্গালী
মহাজীবনের সংকলনটির উদ্বোধন করলেন নোবেলজয়ী
অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই আলোকের একটি উৎস ORS-জনক তথা চিকিৎসা-বিজ্ঞানী
ডাঃ দিলীপ মহলানবীশ। পুস্তকটির নির্যাস পাঠে আংশিক পাঠক-বন্ধুদের সমৃদ্ধি ঘটেছে হয়তো।
পুস্তকটিতে প্রাপ্ত তাঁর জন্ম তারিখ ১২ই নভেম্বর, ১৯৩৪ সাল। ১৯৫৮ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে
স্নাতক ডিগ্রি প্রাপ্ত হন মেডিক্যাল কলেজ থেকে। মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্যের উন্নতিকল্পে সারা জীবন জিজ্ঞাসু মন সহ নিরলস গবেষণার
কাজে ভ্রমণ করে বেড়িয়েছেন বিশ্ব জুড়ে।
ডাঃ মহলানবীশ জীবনের শেষ তিন দশক কাটিয়েছেন এই কলকাতা শহরেই।
বেশ কিছুদিন যাবৎ বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন ORS-জনক। অতঃপর ১৬ই অক্টোবর, ২০২২,
৮৮ বছর বয়সে শনিবার রাতে ভোরের আলো ফোটার আগেই ই. এম্. বাইপাসের ধারে এক বেসরকারি
হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় চিকিৎসাধীন তারকাটি খসে পড়ল চিরতরে।
১৯৬৬ সালে গবেষণা শুরু করেন রিহাইড্রেশন থেরাপির উপর। জন হপকিন্স
ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর মেডিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ে পর্যবেক্ষক
হিসেবে যোগদানসূত্রে আবিষ্কার করলেন ORT বা ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি।
১৯৭১
সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শরণার্থীদের কলেরা রোগ যখন মড়কের আকার ধারণ
করতে চলেছে, তার মোকাবিলায় দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁর
এক শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ উদ্বাস্তু বন্ধুর চিকিৎসার তত্ত্বাবধানে
ছিলেন মহলানবিশ।
কলেরায়
আক্রান্ত হলেন শিবিরবাসিরা। তখনও পর্যন্ত ডায়রিয়ার একমাত্র চিকিৎসা ছিল শিরায় স্যালাইন
দেওয়া। চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত স্যালাইনের যোগান না থাকায় ঘনিয়ে এলো এক অনিশ্চিত
অরাজক পরিস্থিতি। এমতাবস্থায় 'জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড
ট্রেনিং'- এর সহযোগিতায় শিবিরের বাসিন্দাদের জন্য ORT ব্যবহারের ঝুঁকি নিলেন ডাঃ
মহলানবীশ।
৪ চা চামচ ৩ চা চামচ ২০ চা চামচ
টেবিল + বেকিং
+ বাণিজ্যিক
সল্ট সোডা গ্লুকোজ
(১) (২) (৩)
এই (১), (২) ও (৩) নং উপকরণের সংমিশ্রণে প্রস্তুত করেছিলেন
ORS। নিজ কর্মীদের প্রতি ছিল তিন হাজার মানুষের
উপর এই চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগের নির্দেশ।
WHO
- অর্থাৎ ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে নিবেদিত অমূল্য
প্রতিবেদনে স্পষ্ট প্রতীয়মান তাঁর রোগমুক্তিকরণ কথা- সাধনপথের বাস্তবতায় ভরপুর নানান
অভিজ্ঞতার কথা- "বনগাঁ হাসপাতালের দু'টি কক্ষের মেঝেতে গুরুতর অসুস্থ কলেরা রোগীরা
পড়েছিলেন। এদের ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইন দিয়ে চিকিৎসা করবার জন্য আক্ষরিক অর্থে তাদের
মল, মুত্র এবং বমির মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে হয়েছিল। সেখানে পৌছানোর ৪৮ ঘণ্টার
মধ্যে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমরা যুদ্ধে হেরে যাচ্ছি। কারণ সেখানে পর্যাপ্ত স্যালাইন
ছিলনা। আমার দলের মাত্র দুই সদস্যকে আই ভি (অর্থাৎ ইন্ট্রাভেনাস) তরল দেওয়ার প্রশিক্ষণ
দেওয়া হয়েছিল।"
ঘেরাটোপে থাকা ORS ব্যবহারের দ্বারা দুই সপ্তাহের মধ্যে নিজ তত্ত্বাবধানে
থাকা শিবিরগুলিতে মৃত্যুর হার নামিয়ে আনেন ৩০ শতাংশ (প্রায়) থেকে ৩.৬ শতাংশে (প্রায়)।
লবণের সঙ্গে গ্লুকোজ মিশিয়ে ORS প্রস্তুতির পদ্ধতিটি গোপনে বাংলাদেশের একটি
রেডিও স্টেশন মারফত সম্প্রচারিত হ'বার অব্যবহিত পরেই ঘুরে গিয়েছিল যুদ্ধের মোড়।
গণ-স্বীকৃতি মিলতে চলল অমৃত-কবচ ORS- এর।
৯০- এর দশকের প্রথম দিকে তিনি WHO- এর ডায়েরিয়া রোগ নিয়ন্ত্রণের
মেডিক্যাল বোর্ডের আধিকারিক পদটি অলঙ্কৃত করেন। পরিচালকরূপে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন
'ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়েরিয়াল ডিজিজ
রিসার্চ'- এর। ১৯৯৪ সালে রয়াল সুইডিশ অ্যাকাডেমি
অব সায়েন্সের সদস্য নির্বাচিত হলেন মহলানবীশ। ২০০২ সালে শিশু রোগ সংক্রান্ত গবেষণার
দরুন পোলিন পুরস্কারে ভূষিত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায়। ২০০৬ সালে থাইল্যান্ড
সরকার- এর নিকট হতে লাভ করেন প্রিন্স মাহিদোল পুরস্কার। তবে অজস্র সমালোচনার যোগ্য
জবাব দিয়ে ডায়েরিয়া চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটিয়ে
বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হলেও স্বদেশে কোনও প্রকার স্বীকৃতি পাননি এই বাঙালি
চিকিৎসক।
WHO- এর প্রতিনিধিরূপে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মসাধনা সম্পাদনকারী
ORS-জনকের কর্ম জীবনের শুরু পার্ক সার্কাসের Institute of Child Health থেকে।
করোনাজনিত অতিমারীতে স্তব্ধ বিখ্যাত লিটল ম্যাগাজিন 'তালতলা দর্পণ'-
এর সঙ্গে যুক্ত লেখিকার শ্রদ্ধাভাজন কলকাতাখ্যাত এক গবেষণাগারের প্রয়াত কর্ণধার ডাঃ
সুবীর দত্ত মহাশয়ের সঙ্গে ছিল তাঁর পারিবারিক সখ্যতা। মহলানবীশের ভাষায়, "এখন
আমার দিনের শেষ। .... আমার এক বন্ধু প্রফেসর সুবীর দত্ত; ওকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কি করি
বল তো?'
— 'তুই তো ইনস্টিটিউট অফ্ চাইল্ড হেল্থ- এ কাজ করেছিলি
গোড়ার দিকে ...'
— 'ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড
হেল্থ নিশ্চয় একটা প্রথম ইয়ে হওয়া উচিৎ যেখানে আমি কিছু সাহায্য.....। (আমি অভিভূত
হয়ে গেছিলাম)"
তাই সেই হাসপাতালের উন্নতিকল্পে ১ কোটি টাকা দান করলেন তিনি এবং
তাঁর সহধর্মিণী, লেডি-ব্রেবোর্ন কলেজের পদার্থ বিদ্যার প্রাক্তন অধ্যাপিকা শ্রীমতি
জয়ন্তী মহলানবীশ।চিনি
আজ বিশ্বের প্রায় শতাংশ জনগণই ডায়েরিয়াজনিত রোগের চিকিৎসায়
ORS ব্যবহার করেন। সেই মোতাবেক 'ল্যানসেট জার্নাল' এই ORS রূপী 'অমৃত-কবচ'- টিকে আখ্যা
দেন ''বিংশ শতকের সম্ভাব্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা বিষয়ক অগ্রগতি" হিসেবে।
আন্তর্জাতিক মাপের এই মানুষটির সঙ্গে বহু বিদগ্ধ চিকিৎসক ও সাংবাদিকের
সাক্ষাৎ ঘটত 'ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব চিলড্রেন অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজেস', স্বহস্তে
গড়ে তোলা 'সোসাইটি ফর অ্যাপ্লায়েড সাইন্স' আর টালিগঞ্জের আস্তানায়। দেবতুল্য মানুষটির
প্রকাশ্য স্বরূপের আড়ালে বিরাজ করত এক জিজ্ঞাসায় মাতোয়ারা মন। ভালোবাসতেন ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞানের আলোচনায় যোগ দিতে। বিশ্বাস করতেন যুব
সমাজের তারুণ্যের ক্ষমতা ও তার জয়গানে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের
কাজ নিয়ে আলোচনা করতেন। AIDS গবেষণা বিষয়েও ছিল তাঁর প্রবল উৎসাহ। তাঁর স্নেহভাজন
শ্রী পান্ডার প্রশ্ন ছিল, 'অল্প কথায় এত ভাল যুক্তি সাজিয়ে যেভাবে আপনার প্রকাশিত
গবেষণাপত্রগুলিতে সিদ্ধান্তে উপনীত হন, তা কে শেখালেন?' হাসিমুখে তিনি জবাব দেন,
'আমার ভাবার ও লেখার ক্ষমতার দৌড় ধরে ফেলেছিলেন মাস্টারমশাই। ভাব-সম্প্রসারণ করে জমা দিলাম। পাশে মন্তব্য লিখেছিলেন-
" চিন্তার দৈন্য সুস্পষ্ট"। ... ..., মাত্র তিনটি শব্দ, কিন্তু কি অসাধারণ
বিশ্লেষণ ! সেই দিন থেকে ঐ মন্তব্য মনে রেখে চেষ্টা করে যাচ্ছি ভালো করে লেখার'। বলেই
আবার হাসি।
প্রাণবন্ত
মানুষটি থমকে গেলেন ২০২১- এ, স্ত্রী বিয়োগের
মুহূর্ত থেকে। দিল্লীর ICMR- এর কোভিড্ মহামারী গবেষণার দায়িত্বপ্রাপ্ত- এর
অনুরোধে ওই সংস্থার নতুন গবেষকদের গবেষণার নানা দিক শেখানোর ন্যায় গুরুদায়িত্ব পালনের
প্রস্তাব খারিজ করলেন মহলানবীশ। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষটি জানান- দুয়েক বছর আগে
থেকেই উনি সভা-সমিতিতে যোগ দেওয়া স্থগিত রাখছেন; স্মৃতিশক্তিও বিগড়েছে বেশ।
প্রশংসনীয় বিষয়, ১৫ই আগস্ট, ২০২১ স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন
উপলক্ষ্যে ICMR- এর তরফে 'Doctors And Discovers' শিরোনামে ভারতীয় চিকিৎসা-বিজ্ঞানীর
সঙ্গে ছবিসহ ছিলেন ডাঃ দিলীপ মহলানবীশ। এটি নিঃসন্দেহে তাঁর জীবদ্দশায় যোগ্য শিষ্য
কর্তৃক তাঁর প্রতি নিবেদিত সেরা শ্রদ্ধাঞ্জলি !
ঔষধ বিক্রেতার দোকান থেকে কেনা ORS অথবা নির্দিষ্ট মাত্রায় নুন,
চিনি ও জলের মিশ্রণে প্রস্তুত ঘরোয়া ORS দ্বারা ডায়েরিয়ায় নির্গত শারীরিক তরলের
মাত্রা বৃদ্ধি করে আমাদের স্বজন ও প্রতিবেশীদের জীবন বাঁচাতে উদ্যোগ নিই আমরা। চিকিৎসকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রেসক্রাইব করেন
এই ORS- এর। যে কয়েকজন মহারথীর কাঁধে ভর করে WHO- এর 'ডায়েরিয়া কন্ট্রোল প্রোগ্রাম'
ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বে, তাদের অন্যতম ছিলেন ডাঃ মহলানবীশ। এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন
আরও বহু গবেষণা। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'শিশুদের ডায়েরিয়ার সময়ে স্বাভাবিক
খাওয়া দাওয়ার গুরুত্ব'।
শুধুমাত্র
শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োজিত না থেকে তাঁর মতো গবেষণার কাজে নিজেকে পুরোপুরি
সমর্পণ করবার নজির সচরাচর চোখে পড়ে না। অথচ চিরকাল তিনি রয়ে গেলেন পর্দার আড়ালেই।
কলকাতা শহরেই থাকতেন। কিন্তু জনগণের অচেনা মানুষ হয়েই বিদায় নিলেন। সত্যি বলতে তাঁর প্রতি অবিচারের দায়ভাগ বর্তেছে
আমার ন্যায় অনেক পাঠক তথা লেখকের উপরেও।
ORS প্রয়োগ দ্বারা ডায়েরিয়া, বমন অথবা হৃদ-দৌর্বল্যে সহসা ঘর্ম-নিষ্ক্রান্ত মানুষকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে
অথবা চিকিৎসকদের পরামর্শে অনেকখানি সুস্থ করে তুলেছি বহুবার। একবারের জন্যেও স্মরণে
আসেনি অমৃত-কবচটির পিতার বিষয়ে জানবার কথা ! ১৬ই অক্টোবর, ২০২২- এ নেটের বন্ধুদের
নিকট হতে প্রাপ্ত খবরে প্রবল দুঃখবোধের তাড়নায় বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত উক্ত
বিষয়ক তথ্যাদি সংগ্রহ দ্বারা আমার প্রিয় পাঠকবন্ধুদের সঙ্গে তা বিনিময়ের উদ্দেশ্যেই
আজকের লেখনী ধারণ।
শিশুদের
ডায়েরিয়া জনিত মৃত্যু প্রতিরোধের অঙ্গ হিসেবে ২০০১ সালে প্রথমবার Indian
Academy of Paediatrics কর্তৃক পালিত হয় ORS দিবস। জনগণকে বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন
করাতে সেই থেকে প্রতিবছর ২৯শে জুলাই তারিখটিতে বিশ্ব জুড়ে ORS দিবস পালিত হয়ে চলেছে।
২০২১ সালে দিনটির উপজীব্য বিষয় ছিল- 'আর
rehydration নয়, আর dehydration নয়'। এটি দ্বারা রিহাইড্রেশন- এর গুরুত্ব
সম্পর্কে জনগণের ধারণা মজবুত হয়। আর এ বছর অর্থাৎ ২০২২- এর উপজীব্য 'Jodi no. 1
ORS & Zinc.'। Indian Academy of Paediatrics- এর প্রস্তাবনায় ছিল ২৫ - ৩১ জুলাই,
২০২২ জুড়ে ORS সপ্তাহ পালনের কথা। যাতে জনগণের মনে ORS- এর উপযোগিতা বিষয়ে স্পষ্ট
ধারণা জন্মে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে ORS- এর
ব্যবহার বিষয়ে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা রাখা হয় এদিনটিতে।
ভারতবর্ষে শিশুমৃত্যুর জন্য দায়ী মারাত্মক রোগ হিসেবে তৃতীয়
স্থানাধিকারী হ'ল ডায়েরিয়া। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৯.৯ শতাংশ এর আওতায় পড়ে।
শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য অতীব উৎকণ্ঠাজনক রোগটি হতে মুক্তির জন্য চিনতে ও জানতে হবে ORS রক্ষা-কবচটিকে। এটি রোগের বিষময় প্রভাবের
বিরুদ্ধে রণজয়ী হয়ে সমগ্র বিশ্বের সুস্থতার শতাংশ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে, তা বলাই
বাহুল্য। যে কোনো রোগের ন্যায়ই এক্ষেত্রেও চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরী।
এযুগের সাহিত্য চর্চাকারী বৃত্তের তরফে প্রাসঙ্গিক
অমৃত-কবচ ও তার জনকের সাধনা বিষয়ে আরও তথ্য ও সেগুলির বিনিময় আহ্বান করি। এভাবেই
এগিয়ে চলি ক্রমশঃ রোগমুক্ত সুস্থ ও সুন্দর
স্বপ্নময় আগামীর পথে।
শিশুর স্বাস্থ্য
সম্পর্কে মায়েরা অনেক বেশি ওয়াকিবহাল। তবু নতুন প্রজন্মের জননীদের সচেতনতা
বৃদ্ধি করতে লিপিবদ্ধ হল শিশুদের dehydration জনিত বিশেষ কিছু লক্ষণ:-
➧শুষ্ক ঠোঁট,
➧অন্ততঃ প্রায় ৮ ঘণ্টা যাবৎ সামান্য প্রস্রাব অথবা প্রস্রাবহীনতা,
➧ গাঢ় বর্ণ যুক্ত মূত্র,
➧ চোখে পড়বার মতন অনিদ্রা,
➧ ক্রন্দনকালে অশ্রুহীনতা ( চোখের জলের
অভাব ),
➧ দ্রুত হৃৎ-স্পন্দন, ইত্যাদি।
বন্ধুদের সকলের জানা থাকলেও অমৃত-কবচটি ঘরে বানানোর উপায়টি বিনিময়
করতে চাই নতুন প্রজন্মের মায়েদের সঙ্গে। ঘরোয়া ORS প্রস্তুতির উপকরণগুলি হল:-
➧স্বচ্ছ পানীয় জল (অন্যথায় ফুটিয়ে ঠান্ডা করা জল) ১ লিটার,
➧চিনি
৬ চা চামচ এবং
➧লবণ ১/২
চা চামচ।
জলের মধ্যে চিনি ও লবণকে পরিষ্কার পাত্রে ভালোভাবে মিশিয়ে ঢাকা
দিয়ে রাখতে হবে। ২৪ ঘণ্টা পর ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা মিশ্রণটি দুষিত হবার ঝুঁকি থাকায়
ওই সময়ের মধ্যে মিশ্রণটি পান করা না হলে নতুন একটি মিশ্রণ একই ভাবে পরিষ্কার পাত্রে
আরেকবার বানিয়ে আবৃত করে রোগীকে পান করাতে হবে (অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মাফিক)।
২,৫০০ বছর পূর্বে সুশ্রুত
অবশ্য ডায়েরিয়া রোগীর নিরাময়ার্থে রাইস
ওয়াটার, ডাবের জল ও গাজরের স্যুপের পরামর্শ দিয়ে গিয়েছেন। অন্যদিকে, ১৯৬৪ সালে
সর্বপ্রথম দু'জন কলেরা রোগীর উপর সফলতার সঙ্গে ORS প্রয়োগ করেন US আর্মির ক্যাপ্টেন ফিলিপস।
ডায়েরিয়া প্রতিরোধে ORS - এর গ্রহণযোগ্যতা আদরণীয় হবার কারণ সমূহ নিম্নরূপ
:-
➧ স্বল্প ব্যয়ে চিকিৎসা সম্ভব;
➧ রোগীর নিজ গৃহেই চিকিৎসাটি চলা সম্ভব;
➧উপকরণগুলি ব্যয়সাপেক্ষ তো নয়ই বরং সহজলভ্যও;
➧ ফুটন্ত অথবা পরিশোধিত জল জরুরী নয়; পানীয় জলই যথেষ্ট ;
➧কলেরাসহ বহু ডায়েরিয়া ঘটিত রোগের উপশমেই প্রযোজ্য এটি ;
➧কলেরায় এটির প্রয়োগে মৃত্যুহার ৪৯.৩ শতাংশ থেকে হ্রাস
পেয়ে হয়েছে ০.১১ শতাংশ।
১৯৭১ এ বাংলাদেশে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের ৫০- তম বার্ষিকী
উদ্ যাপিত হল ২০২১ সালে। ওই মাহেন্দ্রক্ষণে সকলের অগোচরে রইলেন নম্রস্বভাব যুক্ত আলোক-উৎস,
ORS নামযুক্ত অমৃত-কবচ- এর জনক ডাঃ দিলীপ
মহলানবীশ। অনুতপ্ত মানবজাতির তরফে ORS-জনকের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের ক্ষুদ্র প্রয়াসের
পথে আকাঙ্ক্ষা করি পাঠকবন্ধুদের সহানুভূতি আর
গুরুদেবের 'নৈবেদ্য' ভুক্ত প্রার্থনার বাণীর অংশ-বিশেষের ঐকতান:-
"...
জ্ঞান যেথা মুক্ত যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবস শর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি,
...দেশে দেশে দিশে দিশে কর্ম ধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়,
... তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের
নেতা,
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ;
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।।"
0 মন্তব্যসমূহ