ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

কাঁটাগাছ — সুদর্শন লোধ

 

 

 
এই নদী শফিককে বারবার অবাক করে দেয়। যখন ওর সাত বছর বয়স, তখন ওর চোখের সামনেই ওর দাদা ডুবে মারা যায়। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলো, ঘরে বাবা নেই। পরে গ্রামের মুরুব্বিদের কাছে শুনেছিল, ওর বাবাকেও খুন করে এই নদীর তীরেই কারা যেন ফেলে গিয়েছিল। এখন সেই নদীই শফিকের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কষ্ট হয়, খুব কষ্ট হয় ওর—নদীর দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে। নদীর স্রোত আসে আর যায় , তবু কিছু অব্যক্ত যন্ত্রণা থেকেই যায়— যেগুলো আর স্রোতের মতো চোখকে ফাঁকি দিয়ে বয়ে চলে যায় নাপ্রকান্ড পাথরের ন্যায় বুকের মাঝে আটকে থাকে আর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।

শফিক কোনোদিনও ওর মাকে দেখেনি। ওর জন্মের সময়েই মারা যায়। ওর কাছে মায়ের স্মৃতি বলতে উঠোনে একটা কুৎসিত কাঁটাজাতীয় গাছ। ছোটোবেলায় বাবা বলেছিল ওটা নাকি আগে ছিল না, মা মারা যাবার পরপরই সবাই দেখতে পায়। বাবা জীবদ্দশায় অনেক চেষ্টা করেও গাছটা ওপড়াতে পারেননি—সেটা শফিক জানে। কুঠারের আঘাতে দুʼটুকরো করা হয়। ঠিক দিন সাতেকের মধ্যেই গাছটি আবার জেগে ওঠে এবং দেখতে দেখতে আগের আকৃতি ধারণ করে। শেষে বাবা অ্যাসিড দিয়ে মারার চেষ্টাও করেছিলেন—আশ্চর্যজনক ভাবে গাছটির এতেও কোনো ক্ষতি হয়নি। শফিক কিন্তু গাছটিকে বড় ভালোবাসে। দুপুরের মধ্যে সমস্ত মাছ বিক্রি করে, শহর থেকে ফিরে ঐ গাছের পাশেই বসে থাকে, গাছের পাশেই উনুন টেনে এনে দুটো ভাতে-ডালে ফুটিয়ে খায়; মাঝেমাঝে শুয়ে ঘুমিয়েও পড়ে। রাস্তা দিয়ে যে যায় সেই বলে, “ওরে শফিক, পাগলামি বন্ধ কর, ঘরের দোরগোড়ায় ওরম কাঁটাঝোপ রাখিস নে, মঙ্গলজনক নয়—দেখলি তো তোর বাপ-মা-দাদার অবস্থা!। কতবার এমনও হয়েছে কথাবার্তায় উত্যক্ত হয়ে শফিক ওদের দিকে কাস্তে নিয়ে তেড়ে গেছে। তবে নদীর মতো এই কাঁটাগাছ দেখে শফিক অবাক হয়না। একভাবে তাকিয়ে থাকতে কষ্টও হয়নি কোনোদিন। অদ্ভুত এক অজ্ঞাত শান্তির মায়াবন্ধন জড়িয়ে আছে এই গাছে আর এই উঠোন চত্বরে।

শফিকের ছেলেবেলার একমাত্র বন্ধু ছিল মোহন। ওর সঙ্গেই মাঠে-ঘাটে ঘুরতো, নদীতে ঢিল ছুড়তো, গাছে উঠতো। এরপর একদিন একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। সেদিন ছিল দোলপূর্ণিমা—  বিকেলে বেরিয়ে  মোহন আর ঘরে ফিরলো না। আর তাকে কেউ দেখেনি। সেই রাতে, সেই জ্যোৎস্নামাখা রাতে শফিক দেখেছিল, ওদের উঠোনের সেই কাঁটাগাছটি হাত চারেক লম্বা হয়ে গেছে। তারপর আর কোনোদিনও গাছটি বাড়েনি।
 
 
এক শীতের রাতে শফিক চাদর মুড়ি দিয়ে বারান্দায় শুয়েছিল। গভীর রাতে একটা অস্পষ্ট গোঙানিতে ওর ঘুম ভেঙে যায়। একা থাকতে থাকতে শফিকের অস্বাভাবিক সাহস হয়ে গিয়েছিল। কাস্তে হাতে ও উঠোনে নেমে আসে। দুইদিন আগে অমাবস্যা ছিল, সেভাবে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা—তবে তার মধ্যেও একটা দৃশ্য দেখে শফিকের বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। সেই কাঁটাগাছটার পাশে বাবু হয়ে একজন মহিলা মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে দুলছে। যেন পাঁচালী পড়ছে; মোহনের মাকেও অনেকটা এই ভঙ্গিতে পাঁচালী পড়তে দেখেছে শফিক। মুখ দেখা যাচ্ছে না— পুরো উঠোনটাকেই খুব অস্বচ্ছ কুয়াশার বেষ্টনী গিলে নিয়েছে। হঠাৎই গোঙানির আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায় এবং একটা সুন্দর মিষ্টি নারীকন্ঠে সেই ছায়ামূর্তিটি অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, “মানিক, ভয় পাস ক্যানে রে? আমি তো তোর আম্মু!
শফিকের হাত থেকে কাস্তেটা পড়ে গেল। কেঁদে ফেললো সে, এতদিনের যত চাপা দুঃখ, ক্ষোভ, হতাশা মনের গভীরে অবগুন্ঠিত ছিল—তারা যেন চোখের জলের মাধ্যমে বেরিয়ে আসার একটা সুযোগ পেয়ে গেল।
 
কোথায় ছিলি আম্মু? আমাকে সবাই একা করে চলে যায় কেন, আম্মু ?”
 
চুপ্! ইস্ , ব্যাটাছেলের আবার কান্না করতে আছে? বাপটা কিছুই শেখাতে পারেনি দেখছি—পারবেও বা কোত্থেকে! জুয়াড়ি একটা, ওতেই তো মরলো। এখন, সোজা হয়ে বস দেখি এখানে। কিছু কথা আছে।”
 
শফিক মৃত মায়ের বকুনিতে হতভম্ব হয়ে মাটিতে বসে পড়ে। তারপর আবার ওর মা বলে—এটা তো আর একটা জীবন নয় রে হতভাগা! কাঁটা আঁকড়ে আর কদ্দিন এভাবে থাকবি, হ্যাঁ? একটা বিয়ে কর, ছেলেপুলে কর, ঘর সংসার কর; তারপর—
 
তারপর?”
 
তারপর এখান থেকে চলে যা, এখানে আর থাকিস না—ভালো কথা বলছি, না শুনলে বড় বিপদ। বাপটা গেল গেল, কিন্তু আমার রফিককে কেন মরতে হলো!
 
শফিক কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় চারিদিক আবার আগের মতন হয়ে গেল। ও আবার আগের মতন বিছানায় শুয়ে আছে। যেন কিছুই হয়নি। ঐ রাতে আর ঘুম এল না ওর। কিরকম একটা নেশাগ্রস্ত হয়ে রইল পরের দিনটা—কাজে বেরোনো হলো না। রাতে আবার অপেক্ষা করে শফিক, কিন্তু আম্মুর দেখা আর পায়না।
একদিন খুব ভোরে শফিক মাছের আড়তে যাবে, এমন সময়ে রহিম চাচা এসে হাজির। শফিক একটু খুশিই হলো। চাচার মতো মানুষ হয়না, শফিকের দুর্দিনে সর্বদা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রাথমিক কথাবার্তার পরে তিনি কেমন যেন উশখুশ করতে লাগলেন—এগুলো বলতে আসেননি তিনি, এসেছেন খুব বড় মাপের প্রস্তাব সঙ্গে করে!
শফিক হেসে বললো, “কিছু বলবেন চাচা?”
 
আমার মেয়ের সঙ্গে তোর বিয়ে দেবো।
 
আকাশ থেকে পড়ে শফিক—আপত্তিকর কিছু নয় এটা কিন্তু রহিম চাচার মেয়ের সঙ্গে বিয়েটা একটু অপ্রত্যাশিত।
 
মানে—আমি, বিয়ে... আপনার....
 
কারুর কাছে মন বাঁধা আছে নাকি?”
 
জিভ কেটে অপ্রস্তুত হয়ে বলে, “না না, একদম না।”
 
রহিম চাচা নিশ্চিন্ত হলেন।
তাঁর মেয়ে সাজিদা খুব সুন্দরী না হলেও বেশ সুশ্রী। তবে ওর মিষ্টি ব্যবহার ওকে প্রকৃতই সুন্দরী বানিয়ে রেখেছে। মেয়েটির খুব কষ্টের জীবন। ডান হাতের কব্জির পর থেকে আর বাকী অংশ নেই—জন্ম থেকেই। শফিক সবই জানতো কিন্তু রহিম চাচা ওর জন্য যা করেছে তার জন্য সে জান দিতেও প্রস্তুত—এই বিয়ে তো সেখানে তুচ্ছ ব্যাপার। পঙ্গু মেয়েকে তার সৎ মায়ের কাছে দিনরাত অত্যাচারিত হতে দেখে আর চুপ করে বসে থাকেননি তিনি; কিন্তু কে বিয়ে করবে তাকে। পরক্ষণেই শফিকের চেহারা ভেসে আসে তাঁর মনে—লম্বা, সুঠাম শরীর; হোক একটু পাগলাটে—মনের ভালো। আর এমনিতেও এই মেয়ের জন্য বাবু গোছের 'ভদ্দর' লোক পাবেন কই?
 
 
বিয়ের পর একটু পরিবর্তন দেখা গেল শফিকের মধ্যে। পাগলাটে ভাবটা অনেকটা কমলো। সেই মায়াবী রাত্রির কথা, আম্মুর কথা—ওর স্মৃতি থেকে ধীরে ধীরে মুছে গেল। কাঁটাগাছ পড়ে রইলো কাঁটাগাছের স্থানেই। সাজিদার খুব বাগান করার শখ, অনেক রকম ফুলগাছ উঠোন চত্বরে লাগালো—গোলাপ, টগর, জুঁই, স্থলপদ্ম। বাঁ-হাত দিয়ে কষ্ট করে সব করলো। অভিশপ্ত ভিটেতে যেন শুভশক্তির অবাধ বিচরণ। শফিকের খুব আনন্দ হলো।
এভাবে বছর দেড়েক কেটে গেল। রহিম চাচা আর এ দুনিয়াতে নেই। সাজিদা এখন সন্তানসম্ভবা। শফিক বেশ কিছু টাকা জমিয়েছে। ওর ইচ্ছে এই পূর্বপুরুষের ভিটেটা সাড়াবে—তার সন্তানের জন্য।
কাঁটাগাছটা বড় হয়েছে কি হয়নি—কেটে ফেলা হয়েছে কি হয়নি, সে ব্যাপারে শফিক ভাবেই না। সত্যি কথা বলতে শফিক ঐ গাছের অস্তিত্ব ভুলে গিয়েছে।
একদিন অনেক রাতে, সাজিদা শফিককে ডেকে তুলল। সভয়ে বললো, “শুনুন, এ বাড়িতে জিন-টিন আছে নাকি?”
 
না না, জিন কেন থাকতে যাবে!
 
কেমন একটা বিশ্রী ডাক শুনলাম, আমার খুব ভয় করছে।”
 
আরে মেয়েছেলেরা এই সময়ে এরকম খারাপ স্বপ্ন দ্যাখে। তুই জল খেয়ে শুয়ে পড়, কিছু হবে না।
 
বউ ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু শফিকের মুখ শুকিয়ে গেল। ওর সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেল। ও ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের দরজা খুলে উঠোনে নেমে আসে। কাঁটাগাছটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হারিকেন বাতিটা উঁচিয়ে ধরলো—ধুলো জমে একটা দৈত্যের রূপ ধারণ করেছে সেটি! সঙ্গে সঙ্গেই চতুর্দিক ঘন কুয়াশার সমুদ্রে ডুবে যেতে থাকলো। কোথাও কোনো ঘর নেই, দেয়াল নেই, আকাশ নেই, মাটি নেই—শুধু গাঢ় অন্ধকার। এই সময়ে যেকোনও স্বাভাবিক মানুষ অনেক রকম পদ্ধতির দ্বারা এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতো; কিন্তু শফিক সেসব কিছুই করলো না—সেদিনও করেনি। হঠাৎই কোথা থেকে যেন মাটি কোপানোর আওয়াজ আর অনেক মানুষের চাপা কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। আস্তে আস্তে সেই কান্নার শব্দ গোঙানিতে পরিণত হয়। শফিকের মেরুদন্ড দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যাচ্ছে। সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে, কোনো কথা বলতে পারছেনা। না পারছে দাঁড়াতে , না পারছে পালিয়ে যেতে। একটাই কথা প্রতিধ্বনিত হতে থাকে—
 
চলে যা, সামনে বিপদ!
 
এক চমকে ঘুম ভেঙে যায় শফিকের। এই ভিটেমাটি ছেড়ে ও কিছুতেই যাবে না—এগুলো সব বাজে স্বপ্ন। গাছটাই কেটে ফেললে কেমন হয়?
কেটেও ফেললো! দুইবার দা চালাতে হলো শুধু। এই জিনিস কিনা ওর বাপদাদাও ওপড়াতে পারেনি!
এরপর আর কোনোদিন ঐসব আজগুবি দৃশ্য শফিক দেখেনি আর সাজিদাও কোনো উদ্ভট শব্দ শুনতে পায়নি।
 
 
পড়ন্ত বিকেলে গোরুর গাড়িতে বসে ছেলেকে কোলে নিয়ে শফিক বিগত দিনের এইসব কথাই ভাবছিল। ভাবছিল, দুনিয়ার কতকিছুই সে জানেনা; কতকিছুই সে বোঝেনি, বুঝতে চায়নি। ভাবছিল, সেগুলো কোনো দুঃস্বপ্ন ছিলনা। ভাবছিল, সেই বাগানের কথা—কোথায় সেই বাগান! কোথায় সাজিদা!
সেই বাগানের প্রতিটা গাছ আজকে কাঁটাগাছে পরিণত হয়েছে। আজ তার উঠোনে যেন দাঁড়িয়ে আছে তার আম্মু, আব্বু, রহিম চাচা আর দুটো বালক। পাশে একজন কমবয়স্ক বৌ শফিকের দিকে তাকিয়ে আছে; শীতল দৃষ্টি—অকেজো হাতটা দিয়ে বারবার ঘোমটা দিতে চাইছে সে , কিন্তু কিছুতেই পারছেনা। শফিকের বুক নিংড়ে কান্না এল। ছেলেকে নিয়ে সে দূরে শহরে চলে যাবে চিরদিনের মতো। পড়ে থাকুক এই স্মৃতি, পড়ে থাকুক এই নদী। আজ সে নিজেও একটা কাঁটাগাছ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ