দেবী, যাঁর দীর্ঘ ‘ঈ’ কারের মাঝে লুকিয়ে আছে আমাদের চেতনা, আমাদের ভাব, আমাদের আদি রূপ এবং দীর্ঘতম মানসিক শৃঙ্খল, যা যুক্ত করে রাখে সৃষ্টির আদিশিরাকে। কালের প্রাচীরে থাকা অশুভ পঙ্কিলতাকে শোষণ করেছেন এবং সৃষ্টির বুকে ফিরিয়েছেন রঙীন আল্পনা, দৃঢ় মনন, দুরন্ত স্ফুলিঙ্গ এবং শাশ্বত বৌদ্ধিক তারুণ্যতা। দেবী লাবণ্যময়ী, যাঁর লাবণ্য প্রকৃত অর্থেই তাঁর শুভ স্বচ্ছ ভাবনা ও সৃষ্টির সংমিশ্রণ, যেটি কোনোকালেই বিনষ্ট হবে না তীব্র সংঘাতে। নান্দনিকতা আর গতিময় ছন্দের চালিকাশক্তি তিনি, যিনি একসূত্রে সজ্জিত করেছেন শক্তি, সাহস এবং প্রত্যয়কে, যাঁরা একযোগে সংহার করতে পারেন তামসের গায়ে অঙ্কিত ধ্বংসের সমীরনকে, সৃষ্টির দেহে আঘাত করা কোনো দানবিক নখরকে। মহাদেবের রুদ্রবীণায় জাগরিত উচ্চরাগে তিনি মিশিয়েছেন শান্ত স্নিগ্ধ রাগিনিকে, ভৈরবী গাম্ভীর্যতার আদিশাখায় ফুটিয়েছেন ভীমপলশ্রীর ন্যায় কোনো নতুন সুমধুর তরঙ্গায়িত শাখা, যাঁরা সুরহীন রসহীন রুক্ষ পাশব কোটরে জাগরিত ঘটায় আসল সুরের। স্বরের সত্ত্বায়, ধী-শক্তির অন্তরে, প্রেরণার শিলায় আর উচ্ছলিত ঝর্ণার বুকে সঞ্চিত নুড়ির প্রতিটি চলনে তিনি আছেন মিশে। কখনো যোগমায়া, কখনো জয়দূর্গা, কখনো কৌশিকী, কখনো চামুন্ডা, কখনো মহিষাসুরমর্দিনী-নানা রূপে তিনি বিরাজিতা। রূপ কী?? শুধুই বাহ্যিকতা, যা পার্থক্য করতে শেখায়?? নাকি রূপ আসলে শুদ্ধ পরিশ্রত রূপক, যেটি উন্নত হতে শেখায়?? রূপ আসলেই সেই চিরন্তন সত্য, ন্যায় ও সৃষ্টিশীল আনন্দের সংমিশ্রিত ধ্রুবক, যার বিনাশ নেই। পুরানে মহামায়ার সেই প্রতিটি ঝরে যাওয়া কোষিকা আসল বহিরাঙ্গের পরিবর্তনশীল দিনলিপি, যেগুলি সাধারণ চোখে কেবল ত্বক। ত্বক আর চেতনার মধ্যবর্তী অংশতেই নিমজ্জিত থাকে আসল রূপ, যা ন্যায়ের দিকে ধাবমান, যেটিকে কখনো অন্বেষণ করা যায়, কখনো করা যায় না। যাঁরা অন্বেষণ করতে পারেন, তাঁরাই আসল শক্তিকে, এবং আসল লাবণ্যকে বুঝতে পারেন, আর যাঁরা পারেন না তাঁরা বহিরাঙ্গকেই সঠিক হিসেবে ভাবেন। এই চেনা আর জানার মাঝে আটকা পড়েই অন্বেষণ হয়ে ওঠে না, কিন্তু আরাধনার আসল অর্থ বুঝতে এই অন্বেষণ একান্ত প্রয়োজনীয়। সত্যি বলতে রাগ, রাগিনী, আগুন, হোম প্রতিটিই অখণ্ড সত্ত্বা থেকে সৃষ্ট সত্ত্বা।
ব্রিটিশাবৃত
বাংলায় জমিদারি মেজাজে অনুষ্ঠিত হওয়া দেবী আরাধনা এবং সাধারণের মাঝে বহু যুগ ধড়ে
ভিন্ন ভিন্ন পৌরাণিক ধারা বজায় রেখে দেবী আরাধনা উভয়েই এক আরাধনার দুই রঙ্গ। কোথাও
দেবী দুরন্ত রাজনন্দিনী,যিনি অদ্বিতীয়ার মেজাজে সামলাচ্ছেন তাঁর
রাজ্য, অন্য দিকে দেবী হয়ে উঠেছেন সাধারণের মাঝে
অনন্যা। যিনি আরাধনা করছেন,
তাঁর বা তাঁদের
ভাবতরঙ্গতেই দেবীর বাহ্যিক সত্ত্বার প্রতিফলন আর প্রতিটি ভিন্ন বাহ্যিকতার মাঝে
থাকে টান, আবেগ, নান্দনিক
উচ্ছাস ধ্রুবক হয়ে বিরাজিতা। তালে,
গতিতে, সংগীতে,অঙ্কনে, দুরন্ত
প্রত্যাঘাতের শিরায় দেবী আদ্যাশক্তি রূপে অধিষ্ঠাত্রী। তৎকালীন বাংলায় আড়ম্বরের
অংশ রূপে উঠে আসা জমিদারবাড়ির দুর্গাপুজোতে দেবীর যে আরাধনা হয় তা মূলত রাজকীয়, যেখানে দেবী শক্তিশালী রানী বা সম্রাজ্ঞী হয়ে রক্ষা
করছেন সাম্রাজ্যকে। আবার,
যেখানে মা পূজিতা
হচ্ছেন পুরান, লোকাচার এবং আঞ্চলিক আনন্দ মেনে, সেখানে মা হয়ে উঠেছেন আমাদের আপনজনা, যিনি রানীর বেশকে বর্জন করে আপন করেছেন আসল ভূমিকে।
বিপ্লবীদের দেবী আরাধনার মাঝে মিশে থাকা সাধনা, একাত্মবোধ, সমগ্রতাবাদী অখণ্ডতাবোধ, কিংবা তরুণ প্রজন্মের দেবীর সম্মুখে কৌশলগত প্রদর্শন-সবই
মূলত আদি শক্তির প্রতীক। দেবী সৃষ্টিশীল,
তাই আল্পনা ও চালচিত্রর
উৎপত্তি ঘটে, দেবী অন্যায় প্রতিরোধকারী, তাই লাঠিখেলা,
ব্যায়াম এবং মেয়েদের
তলোয়ার চালানোর প্রদর্শনীর মাধ্যমেই দেওয়া হয় অঞ্জলি, আবার দেবী এবং দেবাদিদেব সংগীতের প্রতীক এবং ছন্দের
প্রতীক, তাই সঙ্গীতিক পরিবেশের মাধ্যমে
দেবীবন্দনাও হয়ে ওঠে আরাধনার অংশ।
আদিপুরুষের
আঙুলের ছোয়ায় জেগে ওঠা রুদ্রবীণা নিরন্তর বেঁধে রাখে কণ্ঠ আর সুরের মোহিনীকে। আর উচ্চানুরাগ
এর দোলায় তৈরী হওয়া ছন্দ মিশে যায় প্রকৃতির রোশনাই এ এবং প্রকৃতিপ্রেমীর নীলচে
ওড়নায়। রাগিনী ধ্বনিকে চেতনায় বাঁধে,
ভাষাকে বাঁধে আবেগে,আর মনকে বাঁধে বিশ্বকৌণিকতার প্রতিটি ছত্রে। প্রাচীন
বাংলায় ষষ্ঠীতে জাগরণী সঙ্গীত,সপ্তমীর খেয়াল, অষ্টমীর উত্তরপূরবীয় গজল, নবমীর টপ্পা প্রকৃত অর্থে জীবনের ছন্দ, যা মিশে রয়েছে সমাজের বিচিত্র দিকে। নবরঙ্গে ভেসে গিয়ে ধ্রুপদী মুদ্রাতে ঘটে
রুদ্ররঙের কাছে স্নিগ্ধ স্থির জ্যোতির্ময়ী যোগিনীর সমর্পন। সংহারের পর আসে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া যা শান্ত এবং ‘মঙ্গলম’
হয়ে ওঠে। দুরন্ত নদীর বক্ষে ভাসমান প্রদীপের মেলা কিংবা ব্রিটিশাবৃত ভারতবর্ষে
মশালের আলোয় বিপ্লবীদের আরাধ্যা দেবীকে রক্ষা করা-উভয়ের মাঝেই ফুটে ওঠে আরাধনা, যা তেজদীপ্ত আলোকের পথে প্রবহমান। মশালের আলো একদিকে
প্রতিরোধী আগুন, অন্যদিকে মননের আগুন বা সংকল্পের আগুন, যা ধারণ করতে হয়েছে ভবিষ্যতকে রক্ষা করতে এবং এই ‘রক্ষা’ র দিকটি আরাধনার অন্য এক দিক। অপরদিকে ভাসমান প্রদীপ
নির্দেশ করছে সময়ের প্রহমানতা,
বার্তা, আকুতি,
বাহ্যিক খোলশ। অন্য
অর্থে খাঁটি আগুনের শিখায় মোহকে ত্যাগ করা। দেবী দশভুজা পারিবারিক বন্ধনের প্রতীক
বহন করেছেন। দেবী নিজেই বৃহত্তর পরিবারের অংশ এবং প্রধাণ মূল। জাগতিক ঐশীরা কখনো
স্নিগ্ধ পার্বতী,কখনো দশভুজা অসুরদলনী। দশ দিককে দেবী
সামলে চলেন নানারকম কৌশল দিয়ে,
যার প্রতিটিই বহন করে
মেধা, মনন, চিন্তন, জটিল ও সরল বোধ,
অন্বেষণ, যুক্তি,
স্থিতি, লয় ইত্যাদি নানা আণবিক সত্ত্বা।
যুগের পর যুগ
ধরে সমাজের সাথে, প্রকৃতির সাথে, ব্যতিক্রমী স্রোতের সাথে মিশ্রিত হয় আদ্যাশক্তির
অংশরা। দুর্গম উপত্যকা এবং দুর্ধর্ষ শৈলশিরার বুকে বড়ো হওয়া জাগতিক কোনো অন্বিতা
লড়াই করে, লড়াইয়ের প্রতিটি ভাষা শেখে, বাহ্যিক আগুন এবং অন্তঃস্থ ন্যায়ের আগুনকে বরণ করে
একপাশে সমৃদ্ধ করে জাতিকে,
দেশকে তথা বৃহত্তর
অংশকে, অন্যদিকে সে অশুভ আঁধারের প্রাচীর ভেঙে
বন্দিনী ঝিনুককে মুক্ত করে। এখানেই ঘটে সংযোগ– দেবীত্ব এবং জাগতিক বিজয়িনীর মধ্যে
ঘটা দুরন্ত সংযোগ। কখনো কোমল শিলা হয়ে কঠোর শিলার রুক্ষ শিরা বাঁচাতে, কখনো ত্রিনয়নী-রুদ্রানী রূপে দেবত্বের সকল জ্যোতিকে
এক করে জ্যোতির্ময়ী হয়ে দানবিক ধোয়াকে পরাজিত করতে তিনি জাগরিত হন। সুন্দর
বিশ্বজনীন ও সর্বাঙ্গীন সুন্দর হয়ে উঠতে পারে তখনি যখন তা হাজারো প্রাণের সৃষ্টি
করে এবং যেই প্রাণ কখনো হতে পারে স্বপ্নউড়ানের দ্যুতির মতো, আরো বড়ো ইচ্ছেশক্তির মতো। পরিবর্তনশীল বিশ্বের
প্রতিটি কোণায় কোণায় রয়েছে বৃহত্তর দেবীত্বের অংশ। কালের নিয়মে তা হারালেও আবার
পুনরুত্থিত হয় সৃষ্টির টানে এবং স্রষ্টা খুঁজতে। পুরানের ভাষায় কাব্যিক দোলাতে
যুক্তি ও বৃহত্তর বাস্তববাদ লুকোনো থাকে,
আর যদি আমরা জাগতিক
ভাষায় এই সত্ত্বা খুঁজতে চাই তাহলে আমাদের বর্তমানতার মধ্যেই হতে হবে
একাত্ম।দখলকারী আগ্রাসন আর প্রতিবাদী আগ্রসন-এই দুই এর পার্থক্যতেই আসল শুদ্ধ
সত্ত্বা বিরাজমান। মিথ্যেঘেরা সত্য,
সম্পূর্ণ সত্য এবং
রুদ্ধ হওয়া সত্য-এভাবে খুঁজলে আরাধনার আসল অর্থটা অবশ্যই পাওয়া যায়। কিছু সময় কিছু
বাহ্যিক রূপে ফ্যান্টাসি পেতে পারেন হয়তো,
কিন্তু বাস্তবের মাটিতে
হেটে যুক্তির শাখায় বসে ফ্যান্টাস্টির মধ্যে থাকা বাস্তবতাকে চিহ্নিত করা যাবে।
ফলস্বরূপ সঙ্গীত, রাগিনী, গম্ভীরা, জটিল অশুভ আঁধারের খন্ডনকারী প্রকৃত সত্যালোকসজ্জার
রূপ ধ্বনিত হবে। ভাবনার স্তরকে ক্ষুদ্র এবং আরো শর্ট করা হলে অজস্র কাহিনীর
যৌক্তিকতাকে উন্মোচিত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং তার ফলে দৃষ্টিকোণ লঘু সীমারেখা
দ্বারা আবৃত হয়ে পড়ে। বাস্তবের পথ,
সাধারণ ভূমি, বৃহত্তর ভাবনা এবং ন্যায় ও সত্যের রঙে রঞ্জিত
যুক্তিতেই মিশে যায় এই প্রকৃতিবাদ,
দেবীত্ব, সমগ্রতাবাদ,
বিশ্বজনীন চিরন্তন
প্রবাহ। দেবী অপরাজিতা,
বারবার অশুভ শক্তির
আবির্ভাব ঘটলেও দেবী সেই শক্তির বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং সংশ্লিষ্ট
অসুরিক রূপের বিনাশ করেছেন। বৃহত্তর সভ্যতার দেবীরা অপরাজিতা হতে পারেন তখনি
যখন অসুরিক শক্তির নখরকে ভয় না পেয়ে এগিয়ে
চলেন, কিংবা কখনো হেরে গিয়েও লড়াই এর শক্তিকে
বাঁচিয়ে রেখে পুনরায় জয়ের মুকুট পরেন।
আদিশক্তির
অংশরূপে আসা দেবীশক্তি তথা প্রকৃতিশক্তি মহাবিশ্বের মাঝে দৃঢ়চেতা সাধিকা, কেননা তিনি সাধনা করছেন বৃহত্তর সৃষ্টির মাধ্যমে
জগতকে দানবিক ছোবল থেকে রক্ষা করতে,
যেখানে ত্রিশূল হিসেবে
কখনো থাকতে পারে মাইক্রোস্কোপ কিংবা আইনের অস্ত্র, বাহন
হিসেবে থাকতে পারে শক্তিশালী মেধাকে। সংকল্প বৃহত্তর হলে, উদ্দেশ্য মানবকল্যাণধর্মী হলে সেখানেই উদ্ভুত হয়
দেবীরূপে থাকা লাবণ্য,
দীপ্তি। বৃহত্তর এবং
বহুকৌণিক সমাজতান্ত্রিক দিক থেকে বিচার করলে দেবী, দেবী
আরাধনা মূলত সমৃদ্ধতা,
বোধশক্তি এবং স্নিগ্ধ
অথচ দুরন্ত সৃজনের মিলনরেখা,
যারা একযোগে রক্ষা করবে
দেশ ও জাতির বৃহত্তম মঞ্চকে। অতীতে রাজপুত্র ও রাজকন্যা দেবশক্তি আরাধনার অংশ
হিসেবে অনুশীলন করতেন,
আর তা আজ পরিবর্তিত
সমাজে প্রতিরক্ষা স্কোয়াড রূপে দন্ডামান। পৌরাণিক সত্ত্বা প্রদান করে শক্তি ও
ইতিবাচক দিক, আর পার্থিব সত্ত্বা সেই পৌরাণিক
সত্ত্বাদের মননে রেখে বাস্তবিক যুক্তিতে ভর করে এগিয়ে চলে। নান্দনিকতা, সৃষ্টিশীলতা এবং প্রাণদায়ী ভাষা-ত্রিনয়নীর তালে
সৃষ্টি হওয়া এই ত্রয়ী সাধারণের মাঝেই থাকে,
যেটির আবিষ্কারই প্রকৃত
আরাধনা। পরিশেষে একটা কথা বলা আবশ্যক,
তা হল- স্নিগ্ধতাময়
প্রতিবাদী সত্ত্বাতেই হয় আসল বোধন,
যা বোধের দরজা খুলে
চেতনাকে জাগিয়ে তৈরী করে সৃষ্টি,আর সকল নব সৃষ্টিই মেশে অদ্বিতীয়া
দেবীতে।
0 মন্তব্যসমূহ