ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

দুই বাড়ি এক ফটক — জোড়াসাঁকোর ধারে -পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

  • বই– জোড়াসাঁকোর ধারে 
  • রচয়িতা– অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাণী চন্দ 
  • প্রকাশক– বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়
  • প্রকাশকাল– কার্তিক, ১৩৫১ 
  • পৃষ্ঠা– ১৫১


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপামর বাঙালির হৃদয়ের গভীরে এমন এক স্থান জুড়ে আছেন যে প্রতি মুহূর্তে তাঁকে আমরা স্মরণ করি। কবিগুরুকে জানার, চেনার আগ্রহ আমাদের অপরিসীম। সেই সূত্রেই সমগ্র ঠাকুর পরিবারের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ও ঠাকুর পরিবারের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের বিষয়ে জানার কৌতূহলও আমাদের চিরকালীন।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখক-লেখিকার রচনা থেকে আমরা ঠাকুর বাড়ির বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারি। পরিচিত হতে পারি বাংলা শিল্প ও  সাহিত্য জগতের মূলস্তম্ভ স্বরূপ এই পরিবারের বিভিন্ন মানুষের সাথে, তাঁদের আচার-বিচার, শিল্প-সাহিত্য চর্চার সাথে। ঠাকুর পরিবারের আভ্যন্তরীণ পারস্পরিক সম্পর্ক, বিভিন্ন ঘটনা ও আত্মীয়-স্বজন সম্পর্কে যে রচনাগুলি লেখা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম তিনটি হল ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’, ‘ঘরোয়া’ এবং ‘দক্ষিণের বারান্দা’ বইগুলি।      

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাণী চন্দ রচিত 'জোড়াসাঁকোর ধারে' বইয়ে লেখকযুগল ঠাকুর পরিবারের একটি অনন্য পর্ব উদ্ঘাটন করেছেন।  


অবন ঠাকুরের হস্তলিপিতে লেখা 'জোড়াসাঁকোর ধারে'  বইয়ের ভুমিকা  বড়ই সুন্দর। 

অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন —

ভূমিকা

যত সুখের স্মৃতি তত দুঃখের স্মৃতি - আপনার মনের এই দুই তারে যা দিয়ে দিয়ে এইসব কথা আমার শ্রুতিধরী শ্রীমতি রাণী চন্দ এই লেখায় ধরে নিয়েছেন, সুতরাং এর জন্যে যা কিছু পাওনা তাঁরই প্রাপ্য।

সুখের কথা লেখার টানে ধরে রাখা সহজ নয়, প্রায় বাতাসে ফাঁদ পাতার মতো কঠিন ব্যাপার সুতরাং যদি কিছু দোষ থাকে এই বইখানিতে সেটা আমি নিতে রাজি হলেম - ইতি

শ্রীঅবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

জন্মাষ্টমী

১৩৫১


ভুমিকা থেকেই আমরা বুঝতে পারি আমাদের প্রিয় অবন ঠাকুর নিজের জীবনের কথা বলে গেছেন এবং তাঁর স্নেহধন্যা শিষ্যা রাণী চন্দ সেই স্মৃতিচারণা বইয়ের আকারে লিখে গেছেন। এ এক অনবদ্য স্মৃতিকথা- যা পড়তে পড়তে ঠাকুর বাড়ির অলিন্দে ভ্রমণ হয়।

দুই শরিকের দুটি পাশাপাশি বাড়ি এক ফটকের ভেতরে, এ বাড়ি ও বাড়ি, সব মিলিয়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি। সেই বাড়িতে বড় হয়ে ওঠার কথা তুলে ধরেছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরুর ন্যায় অবন ঠাকুরও স্কুল পালানো ছেলে। স্কুল ছেড়ে সারা বাড়িময় তাঁর ভ্রমণ আমাদের নিয়ে যায় কখনও বৈঠকখানা ঘরে, কখনও ছোট পিসিমার ফরাস বিছানো মেঝেতে, কখনও বাবামশায়ের ঘরে, কখনও জ্যোতিকাকার আঁকার ঘরের দরজায় উঁকি, কখনও নতুন কাকিমার ঘরের গানের আসরে, খাটের তলায় মাকড়সার শিল্পরচনা দেখতে এবং তাঁর গোপন "পরীস্থানে"। আমরাও হারিয়ে যাই তাঁর সাথে তাঁর ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর ধারে- "অনেকগুলো ঘর, অনেকগুলো মহল, অনেকখানি বাগান জুড়ে দুই বাড়ি মিলিয়ে" এক বিশাল প্রাসাদোপম বাড়িতে, যা সমস্ত বাঙালির কাছে সংস্কৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ পীঠস্থান। অবন ঠাকুরের কথায় - "এ-বাড়ি ও-বাড়ি বলতুম মুখে, কিন্তু ছেলেবুড়ো চাকরবাকর সবাই জানতুম মনে দুখান বাড়ি এক বাড়ি। কারণ, এক কর্তা ছিল; একই নম্বর ছিল, ৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলি।"

সারাদিনের দৌরাত্ম্যর ফলে জুটেছিল "বোম্বেটে" উপাধি। স্মৃতির মণিকোঠায় জমা বহু চরিত্র। রামলাল, পদ্মদাসী, বুদ্ধুবেয়ারা, মনিখুড়ো, রামু কোচওয়ান ,অক্ষয়বাবু, ছিরু মেথর আরও কত শত লোকজন। ছিল উৎসবের জাঁকজমক। জোড়াসাঁকোর বাড়ির সাথে আছে কোন্নগরের বাগান বাড়ি ভ্রমণ, পলতার বাগানবাড়ির বর্ণনা। বাবামশায়ের ইচ্ছা ছিল দুই ছেলে বিদেশ যাবে, অবন থাকবে ওনার সাথে — দেশ ভ্রমণ করবেন তাঁকে নিয়ে। কিন্তু তা আর হল না। তাঁর হঠাৎ মৃত্যু অবনীন্দ্রনাথের বাল্যকালের সমাপ্তি ঘটাল। দেশ ভ্রমণ তিনি প্রচুর করেছেন কিন্তু বাবামশায়ের অভাব বোধ থেকে গিয়েছে চিরকাল।

গঙ্গাযাত্রী ক্লাব বানিয়েছিলেন; তার কাজই ছিলো গঙ্গায় স্টীমারে চড়ে বেড়ানো। মুসৌরী পাহাড়, পুরীর কোনারক দেখেছেন শিল্পীর দৃষ্টি দিয়ে। প্রাতিষ্ঠানিক তেমন কোন শিক্ষা না থাকলেও পরবর্তীতে হয়েছেন বিখ্যাত শিল্পী, শিক্ষক হয়েছেন নন্দলাল বসুর মতো শিল্পীর। লিখেছেন ছোটদের জন্য গল্পগ্রন্থ। বিখ্যাত হয়েছেন চিত্রশিল্পীরূপে। নিজের অঙ্কনকলা সম্পর্কে বলেছেন —

"ছবিটি আঁকি তুলিটি জলে ডোবাই, রঙে ডোবাই, মনে ডোবাই, তবে লিখি ছবিটি। সেই ছবিই হয় মাস্টারপিস। অবিশ্যি, সব ছবি আঁকতে যে এভাবে চলি তা নয়। জলে ডুবিয়ে রঙে ডুবিয়ে অনেক ছবির কাজ সেরে দিই, মন পড়ে থাকল বাদ। এমন ছবি একটা এঁকে যদি ছিঁড়ে ফেলতে যাই, তোমরা খপ করে হাত থেকে তা ছিনিয়ে নিয়ে পালাও। ঠকে যাও জেনো।"

তিনি বেঁচে থাকতেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি মাড়োয়ারী ধনীর কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছিলো, যে বাড়িতে এককালে গিজগিজ করতো চাকরবাকর, আসতো যেতো কত রাজা, মহারাজা, জমিদার, লাট, বেলাট, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীতের সব দিকপালেরা, গানের আসর বসতো, আড্ডা দিতে আসতো কতো মানুষ। বিলেত থেকে আনানো আসবাব দিয়ে সাজানো হতো জোড়াসাঁকোর বাড়ি কিংবা কোন্নগড়ের বাগান বাড়ি। দেশ বিদেশ থেকে আনা হতো ফুলের গাছ। পার্টি বসতো, আসতো নানা মানুষ। রবি ঠাকুরের গল্পের নয়নজোড়ের বাবুদের মতোই যেন বিলাস ব্যসনের চুড়ান্তর ফলে জোড়াসাকোঁর ঠাকুর বাড়িরও সেইসব জৌলুস সব শেষ হয়ে গেল। অবন ঠাকুরদের সাথে সাথে হারিয়ে গেল জোড়াসাঁকোর বাড়ি, তাদের সেই রমরমা, সেই আভিজাত্য। সমস্ত কিছু। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটবেলার বহু ঘটনা ও তাঁর শিশু চোখে দেখা বৈচিত্রময় চরিত্রদের সমাহার, তাঁর শিশু মনের ব্যাখ্যা সম্বলিত হয়েছে এই বইয়ের পাতায় পাতায়।  

ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সম্বলিত এই বই পাঠ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে নিয়ে যায়। পাঠক মিশে যান এক বিখ্যাত পরিবারের জীবনযাত্রায়, বিখ্যাত মানুষদের সাহচর্যে, মুগ্ধ হয়ে যান শিল্প ও সাহিত্যের আঁতুড়ঘরে। আত্মজীবনীমূলক লেখারূপে এই বই চিরকাল বই প্রেমীদের কাছে আদরণীয় হয়ে রয়ে যাবে। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ