কোলকাতায়
বড় হয়েছি বলে শীতকালে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা কোন দিনই অনুভব করিনি। হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা
ঠিক কাকে বলে সেটা বুঝেছি কোলকাতার বাইরে মামার বাড়ি বা মাসির বাড়ি গেলে। দুটোই মফঃস্বলে
হওয়ায় ছোটবেলায় বসে আঁকা প্রতিযোগিতা গুলোতে যেমন শীতের সকালের ছবি আঁকতাম, ঠিক সেই
রকম ঠাণ্ডা লাগতো। তাই, আমার মনে হয় কোলকাতায় শীতকাল অনেকটা প্রতীকী। এই প্রতীকের মধ্যে
নিঃসন্দেহে একটা মোয়া, বিশেষকরে বলতে গেলে “জয়নগরের মোয়া”। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া
দিবস হোক বা পাড়ার পিকনিক হোক, জলখাবারের প্যাকেটের অনিবার্য ও অপরিহার্য অঙ্গ মোয়া।
প্যাকেট খুলেই বা খোলার আগেই মোয়ার ভুবন ভোলানো গন্ধে বুঝে যেতাম আছে আছে, মোয়া আছে।
বৈঠকখানা বাজারের পাশ দিয়ে গেলে সার সার মোয়ার বাক্স বা রঙ্গিন হাঁড়ি যার গায়ে লেখা
“জয়নগরের মোয়া” দেখতে পেতাম, সঙ্গে সঙ্গে বাবার কাছে বায়না, মোয়া কিনবো। এইসময়ে বাড়িতে
কেউ অতিথি এলেও তথাকথিত মিষ্টির বদলে মোয়ার
বাক্স আনতেন। রিবনের বাঁধন ও বাক্সের মুখ খোলার পর রঙ্গিন পলিথিনের আস্তরনের নীচে দেখা
যেত মোয়ার সারি। কথায় আছে না- “ঘ্রাণেন অর্ধ ভোজনং”, বাক্স খুলেই হয়ে যেত অর্ধেক খাওয়া।
মোয়ার ওপর চূড়ার মত কিশমিশ প্রথম সাবাড় হত।
এই ফাঁকে
মোয়া নিয়ে দুচার কথা বলে নেওয়া ভালো। জয়নগরের মোয়া প্রসিদ্ধ হলেও, বহড়ুতে সবচেয়ে আগে
মোয়া তৈরি হয়েছিল। জয়নগর টাউনেরই মধ্যে এক গ্রাম এই বহড়ু। সম্ভবত উনিশ শতকের শেষের
দিকে গ্রামের যামিনী নামে এক ব্যক্তি নিজের ক্ষেতের কনকচূড় ধানের খই ও নলেন গুড় মিশিয়ে এক নতুন
মিষ্টান্ন বানিয়ে খাওয়ান সকলকে। বলাই বাহুল্য, শুরুতেই সুপার হিট এই মিষ্টি যা আজ “জয়নগরের
মোয়া” নামে সুপরিচিত। ১৯২৯ সালে জয়নগরের পূর্ণ চন্দ্র ঘোষ আরও আকর্ষণীয় রুপে “জয়নগরের
মোয়া” নাম দিয়ে কোলকাতার বাজারে পাঠাতে শুরু করলে মোয়ার বিশ্ববিজয়ের সূচনা।
জয়নগরের
মোয়ার আত্মীয় মুড়ির ও চিড়ের মোয়াও পাড়ার মুড়ি-মুড়কির দোকানে পাওয়া যেত ও আজও যায়। টাকায়
দুটো করে মুড়ির মোয়া কিনে বন্ধুরা ভাগ করে খেতাম। নলেন গুড়ের গন্ধ সব কিছুকেই আলাদা
মাত্রা দেয়, সেটার এক বড় উদাহরণ মোয়া।
বড়
হয়েও মোয়া ভক্তি কোন অংশেই কমেনি, বরং অনেকটাই বেড়েছে। মোয়ার মরশুম শুরুর সাথে সাথে
বাজারে গিয়ে মোয়া কিনে আনা একরকম অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। এখন ৫০ টাকা প্রতি প্যাকেট থেকে
৫০০ টাকা প্রতি প্যাকেট হিসেবে জয়নগরের মোয়া বিকোয় বৈঠকখানা বাজারে।
মোয়ার
গল্প পড়ে আপনাদের অনেকেরই মন নিশ্চয়ই মোয়া-মোয়া করছে।দেরি কেন,হাতে তুলে গন্ধ শুঁকে
মুখে পুরে দিন।
তথ্যসুত্রঃ
(১) মিষ্টান্নমিতরে- সুব্রত রুজ- সৃষ্টিসুখ প্রকাশন।
(২) মোয়ার ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।
0 মন্তব্যসমূহ