ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

পাও বিভ্রাট -সুভাষ কর

পাও বিভ্রাট
     ক'দিন হ'ল প্রায় কাজকর্মহীনভাবে সস্ত্রীক দিল্লীতে মেয়ের বাড়ীতে আছি। কাল্কাজী ডিডিএ ফ্ল‍্যাটে মেয়ের বাড়ীর মোটামুটি কাছেই গোবিন্দ্ পুরী সব্জী-কাম্-ফিস্ মার্কেট। আজ সেই বাজারেই ঘটা একটা মজার কাহিনী বলব।

     ত্রিপুরার আগরতলায় প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমার টুকটাক বাজার করার অভিজ্ঞতা ছিল। সেইসময় আমার বড়মামা নিজে আমাকে 'লাভদায়ক' বাজার কিভাবে করতে হয় তার 'ট্রেণিং'ও দিয়েছিলেন, যার অন্যতম উপাঙ্গ ছিল দরদাম করার কৌশল। অনেক কিছুর মধ্যে মাত্র একটা উদাহরণই দিচ্ছি। মামা বলতেন, "দোকানী দাম যাই বলুক, তুই বেশ নীচ থেকে দাম বলতে শুরু করবি। ভাবটা এমন করবি যেন জিনিষটা নেবার তেমন প্রয়োজন বা ইচ্ছে তোর ছিল না; নেহাৎ চোখের সামনে পড়ে গেল তাই। পরে একটা সময়ে দোকানী তোর শেষ বলা দামে রাজী না হলে 'মুচড়া মারবি' (যার অর্থ দোকান ছেড়ে চলে এসে আড়চোখে তাকিয়ে দোকানীর হাবভাব লক্ষ্য করা); দেখবি অনেক  ক্ষেত্রেই সে তোকে আবার ডেকে নেবে।  তখন বুঝবি বাবু কাবু হয়েছে, মানে তোর দামের প্রায় কাছেই সেও পৌঁছে গেছে। আর সে না ডাকলে নিজেই একটু ঘুরে আবার ফিরে আসবি; বলবি- শেষ কথা বলতে এলাম। বলে দামটা আরেকটু বাড়িয়ে দিবি। দেখিস, বেশী যেন বাড়াবি না। দেখবি কাজ হয়ে গেছে .…." ইত্যাদি।

      একটু বড় হয়েই ব্যাগ ভর্তি করে সস্তায় বাজার আনা আমার একটা তৃপ্তিদায়ক 'হবি'-তে পরিণত হয়। শেষে একদিন সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় মাত্র পাঁচ সিকিতে (এখনকার একটাকা পঁচিশ পয়সা) আধাসের টাটকা পাবদা মাছ আনতে পেরে মামার নেয়া পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ঘোষিত হই (তখন দুই আনা সের দুধের যুগ)। আজকাল অবশ‍্যি দরদাম করবার সেইসব কৌশলের প্রয়োগ সফলতার দিক থেকে শুধু অকার্যকরীই নয়, অনেকক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয়ও। আর মেয়ের বাড়ীতে জামাইয়ের আনা সপ্তাহের বাজার ফ্রীজে রেখে দেয়াই চালু বলে এখানে কখনোই আমাকে নিজে বাজারে যাবার দরকারই পড়ত না।

     তবুও খুব ইচ্ছে হ'ল বলে সেদিন সন্ধ‍্যেয় উৎসাহ দেখিয়ে নিজেই যেচে দায়িত্ব নিয়ে গোবিন্দ্ পুরী সব্জী বাজারে চলে এলাম। এই সময়ে বেশ তাজা কচি ঝিঙে দেখে কেনার ভীষণ লোভ হ'ল। আসলে দিল্লী আসার ঠিক আগটায় বেশ ক'দিন কোলকাতায় আমার এই প্রিয় সব্জীটার চড়া দামের জন‍্যে যথেষ্ট তৃপ্তি নিয়ে তা কেনা হয়ে উঠে নি। তাই নতুন জায়গায় নতুন করে সাহস সঞ্চয় করে তরতাজা ঝিঙের দিকে এগিয়ে গিয়ে শুধোলাম

----  ঝিঙা ক‍্যায়সে ভাইয়া?

----  লিজিয়ে, অব্ পঁচিশকা মাল সির্ফ বিশ রুপয়ে।

----  বিশ? থোড়া কম্ কিজিয়ে না (যদিও জানতাম, কোলকাতায় এখন এই জিনিষ কিনতে হলে ষাট টাকা কেজির কমে কোন কথাই চলবে না, তবু এতদিনের অভ‍্যেসে আমার মুখ দিয়ে তেমনটাই বেরিয়ে এল‌)। 

----  কিতনে লেঙ্গে বাবুজী?

----  দাম কম্ করনেসে থোড়া জায়দা হি লুঙ্গা।

----  কিতনা লেনা হ‍্যায় জেরা বাতাইয়ে তো।

----  সমঝ্ লিজিয়ে, কুছ্ দেড় ইয়া দো কেজি ...।

----  দো কেজি লেঙ্গে তো পনরা করকেই লাও জী।

     আমি তো প্রাথমিক সাফল‍্যের খুশীতে টগমগ হয়ে আন্দাজমতো দুই কেজি 'সেরা' ঝিঙে বেছে দিলাম।  কিন্তু এ কী? সব্জীওয়ালা সবক'টাকে ওজনের মেশিনে তুলে দিয়ে বলল, "লাও, 'শ বিশ হি দিজিয়ে "। আমি আঁতকে উঠে বললাম, "কেয়া? 'শ বিশ?

----  আরে বাবু, কুছ জায়দা ভি হুয়া, ম্যায় তো ওসকা পয়সে ছোড় হি দিয়া।

----  কাহে কা ছোড় দেনে কা বাত করতে হো? অ্যায়সে আপ্ এক কেজিকা দাম কিতনে বতায়ে থে? (আমার গলার স্বর তখন গম্ভীর ! তবে ওজন-যন্ত্রের উল্টোদিকে ঠিক ঠিক দু'কেজির-ই বাটখারার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ সাহস সঞ্চয় করছিলাম। ওর বলা দামেই তো স্রেফ ত্রিশ টাকা হবার কথা। লোকটা নিশ্চয় কিছু একটা ভুল করছে।)

----  ক‍্যায়া কেজি কেজি বল্ রহে হ‍্যায় সাব্? এক কেজি কা তো ষাট রুপয়ে আয়েগা।

---  লেকিন্ আপ্ তো পহেলে খোদ হি বিশ রুপয়ে রেট মাঙ্গে থে, অর্ বাদমে মেরে কহনে পর্ পনরামে রাজী ভি হো গয়ে! অব্ দেনে কা 'শ বিশ ক‍্যায়সে হো গয়ে?

----   হে রাম ! ম‍্যায়নে তো বিশ রুপয়ে 'পাও' বাতায়া থা ! 

----   কেয়া বোলা? পাও? ইয়ে পাও কেয়া হোতা হ‍্যায় ভাইয়া? অউর ইয়ে 'পাও' বীচমে কাহাসে আ গয়া?

     এবার পাশ থেকে এক ভদ্রলোক হেসে পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠলেন, "দাদা, দিল্লীতে এই প্রথম বাজার করা বুঝি? 'পাও' মানে এক পোয়া অর্থাৎ আড়াইশ গ্রাম। এখানে 'পাও' হিসেবে দাম বলাটাই চালু রীতি। আপনার বুঝতে ভুল হয়েছে। আর পনের বা কুড়ি টাকা কেজি ঝিঙে পাবার তো কোন প্রশ্নই উঠে না। সেক্ষেত্রে ঐ এতগুলো ঝিঙের দাম মাত্র তিরিশ বা চল্লিশ টাকা পড়বে, ভাবা যায়? আরো বিশেষ করে এই সময়টায়?

 আমি লজ্জা ঢাকতে বললাম, "হ্যাঁ, তাই তো! আমি আসলে এক কেজির দর বলেছে ভেবেছিলাম- মানে, বুঝলেন তো? এখন অন‍্য কোথাও তো পাও বলে কিছু নেই দাদা; মানে শ, দেড়শ, পঞ্চাশ এসব আছে বটে, কিন্তু .......

----  সেসব আপনাকে আর বুঝিয়ে বলতে হবে না; গোটা ব‍্যাপারটাই আমি বুঝে নিয়েছি। (তাৎপর্যের হাসি মিশিয়ে) নতুন জায়গায় মাঝে মাঝে এমন হয়ে যায় দাদা।

----  সে অবশ‍্যি ঠিক কথা। (আমি ভদ্রলোকের গুগলি আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে একটা কৃত্রিম স্মার্টনেস দেখিয়ে চটপট প্রসঙ্গান্তর বেছে নেয়াকে নিরাপদ মনে করলাম) ......তাছাড়া ষাট বছরেরও আগে বাতিল হওয়া 'চার পোয়ায় এক সের'-  এর সেই 'পোয়া' এখনো যে কোথাও বেঁচে আছে, তাও আবার খোদ দেশের রাজধানী এই দিল্লী মহানগরীতেই, সেটা যে আমি একেবারেই ভাবতে পারি নি দাদা।

     প্রবাসী বাঙালী সেই ভদ্রলোক আরেকবার মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেলেন। এদিকে সব্জীওয়ালা কি বুঝল না বুঝল ঠিক ধরা গেল না। যেন তেমন কিছুই হয় নি এইভাবেই জিজ্ঞেস করল, "ঝিঙা নেহি লেনা হ‍্যায় কেয়া, সাব্ জী?"

----  ভাইয়া, মেরে তরফসে সমঝ্নে মে জেরা ভুল হো গয়া। তুম্ এক কাম করো। সির্ফ এক কেজি হি দে দো। আসলমে মেরা বহুত বড়ী গলতি হো গয়া।

----  কোই বাত নেহি সাব, জ‍্যায়সা আপকা মর্জি ওহি লিজিয়ে। ঠিক হ‍্যায়, আপকো অব্ এক কেজিকে লিয়ে পুরা আশি দেনেকা ভি জরুরত নেহি। সত্তর হি দে দিজিয়ে।

     কোন ঝামেলার সৃষ্টি না করে বরং আমার ক্ষতি দশ টাকা কমিয়ে দেয়ায় আমি অনেকটা বাধ‍্য হয়েই বোকা ব'নে যাবার দুঃখটা ভুলে গিয়ে সব্জীওয়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতায় বাঁধা পড়লাম। কিন্তু একটা প্রশ্ন মাথা ছেড়ে কিছুতেই বেরুতে চাইল না। এভাবে সুদূর অতীতে বাতিল হয়ে যাওয়া ওজন মাপার একক 'সের'- এর এক চতুর্থাংশ বাংলার 'পোয়া' তথা হিন্দীতে 'পাও' এককটা কিভাবে এখনো সেই সের-হঠানো বিজয়ী প্রতিপক্ষ নতুন প্রবর্তিত একক 'কেজি'-রই এক চতুর্থাংশ হয়ে ব‍্যাপক জনতার হৃদয়ে ওজন মাপার একটা গণ-ইউনিট হয়ে নিজেকে ঠিক বাঁচিয়ে রাখতে পারল? তবে কি এখনো সেই 'পাও'-এর সময়টাই দিল্লীর আসল পহ্চান? রাজধানীর আসল ইতিহাস লিখতে কি তবে এখনো ছয় দশক আগে বাতিল হওয়া সেই 'পাও' এর সময়ের ধ্যান-ধারণারই আশ্রয় নিতে হবে? চারদিকের চোখ-ধাঁধানো আধুনিকতার চকমকি কি তবে শুধুই এযুগের কিছু নব‍্যগজানো রাজরাজা এবং সমৃদ্ধির আশেপাশে স্থান পেতে সংগ্রামরত ও আপাত-সফল কিছু স্বচ্ছন্দ মানুষের ইতিহাস হয়েই থেকে যাবে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ