ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

যামিনী রায় ও তাঁর শিল্পকলা ( ১ম পর্ব) -পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

আমরা সবাই প্রতিভারে করে পণ্য

ভাবালু আত্মকরুণায় আছি মগ্ন

আমাদের পাপের নিজের জীবনে জীর্ণ

করলে, যামিনী রায়

… পুঁথি ফেলে তুমি তাকালে আপন গোপন মর্মতলে

ফিরে গেলে তুমি মাটিতে, আকাশে, জলে

স্বপ্ন লালসে অলস আমরা তোমার পুণ্যবলে

ধন্য যামিনী রায়

– বুদ্ধদেব বসু

যে শিল্পী নিজেকে স্বতন্ত্র রেখেছেন, নিজের প্রতিভাকে পণ্য করে নয়, কোনও পরসংস্কৃতির চর্চা করে নয়, বরং স্বদেশের প্রত্যন্ত অবহেলিত লোকসংস্কৃতিকে তুলির আঁচড়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি দিয়েছেন, তিনিই পটুয়া যামিনী রায়। শুধুমাত্র দেশপ্রেমের টানে, নিজস্বতাকে ধরে রাখার অভিপ্রায়ে তিনি পটচিত্রের একটি আন্তর্জাতিক মান ঠিক করে দিয়ে গেছেন। তাই বুদ্ধদেব বসু কবিতায় এভাবেই স্তুতি গেয়েছেন শিল্পী যামিনী রায়ের।

নিজ স্টুডিওতে যামিনী রায়
নিজ স্টুডিওতে যামিনী রায়

বঙ্গীয় চিত্রশিল্পীদের মধ্যে অগ্রগন্য ও স্বনামধন্য শিল্পী হলেন যামিনী রায়। জন্ম ১১ এপ্রিল ১৮৮৭। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড় গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রামতরণ রায়। মাতার নাম নগেন্দ্রবালা দেবী। শিল্পী পিতার সংস্পর্শে থেকে ছোট থেকেই যামিনী রায়ের মধ্যে ছবি আঁকার শিল্পীসত্ত্বা দেখা যায়। শৈশবে ঘরের দেয়ালে, মেঝেতে কিংবা হাতের কাছে যা-ই পেতেন, তাতেই পুতুল, হাতি, বাঘ, পাখি ইত্যাদি এঁকে গেছেন নিজের মনে। গ্রামে দুর্গাপূজোর সময় নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দৌড়ে যেতেন ঠাকুর গড়া দেখতে।

শিল্প সৃষ্টিতে মগ্ন যামিনী রায়
শিল্প সৃষ্টিতে মগ্ন যামিনী রায়

১৬ বছর বয়সে কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষে আর্ট স্কুলে ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক রীতিতেই চিত্রকলায় শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি। আর্ট স্কুলে ইতালীয় শিল্পী গিলার্দি ও পরে অধ্যক্ষ পার্সি ব্রাউনের সংস্পর্শে এসে তিনি প্রাচ্য-প্রতীচ্যের উভয় শিল্পের কলা-কৌশলের সাথে পরিচিত হন। পাশ্চাত্য রীতির চিত্রকলা তাকে আকৃষ্ট করে এবং ফলস্বরূপ তিনি তাতে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন। পাশ্চাত্যের বিখ্যাত পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী পল সেজান, ভ্যান গগ, পাবলো পিকাসো ও গগ্যাঁর প্রভাব দেখা যায় তার চিত্রকলায়। পোট্রেইট, ল্যান্ডস্কেপ, তৈলচিত্র ছিল তার স্টাইল ও মাধ্যম। এছাড়াও ক্লাসিক্যাল ন্যুড পেইন্টিংয়ে তার হাত ছিল প্রশংসনীয়। নিজস্ব ঢঙে তিনি এঁকে গিয়েছেন তার মতো করে।১৯১৪ সালে ফাইন আর্টে তিনি ডিপ্লোমা প্রাপ্ত হন।

চিত্রকলার ভাবধারার পরিবর্তনঃ


হঠাৎই তিনি পাশ্চাত্য শিল্পে আগ্রহ হারাতে থাকেন, এরপর থেকে তার আঁকার বৈশিষ্ট্য, ধরন, বিষয়বস্তু, তুলির ব্যবহার ক্রমেই বদলাতে থাকে। পাশ্চাত্য ঘরানার চিত্রে যদিও তাঁর প্রতিভা প্রশংসার দাবী রাখছিল তাও নিজে তাতে সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। নিজের আঁকা ছবিতে কিছুর অভাব বোধ করছিলেন, যা তাঁকে গভীর ভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল। তা হল নিজস্বতা, স্বকীয়তা, দেশপ্রীতি। ছবিতে অনুপস্থিত ছিলো দেশীয় সংস্কৃতি, স্বদেশের মানুষ, তাদের জীবনাচার ও প্রকৃতি — কোনো উপাদানই উপস্থিত ছিল না পাশ্চাত্য চিত্রে। আর তাই প্রান্তিক জায়গা থেকে শিল্পের লোকায়ত ধারাই শিল্পীকে আকৃষ্ট করলো সবথেকে বেশি। মাটির টানে ঘরে ফিরে গেলেন যামিনী রায়। নিজস্ব ভারতীয় তথা বাঙালি ভাবধারার জন্য গর্বিত বোধ করতেন। তাই শত আমন্ত্রনেও বিদেশে যেতে রাজী হননি তিনি।
শ্রীকৃষ্ণের কালিয়া নাগ দমন
শ্রীকৃষ্ণের কালিয়া নাগ দমন

১৯২৫ সালের কাছাকাছি সময়। কালীঘাট মন্দিরের আশপাশে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ সেখানে আঁকা পটচিত্রর উপরে চোখ পড়ে তরুণ শিল্পী যামিনী রায়ের। কালী বিষয়ক চরিত্র এবং কাহিনিকে তুলির টানে, উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারে নিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। যেন ধাক্কা খেলেন যামিনী রায়। ‘ইম্প্রেশনিজম’ এবং ‘কিউবিজম’-উত্তর সময়ে শিল্পের এই সারল্য তাঁকে মুগ্ধ করল। খুঁজে পেলেন যা খুঁজছিলেন এত দিন ধরে।  কালীঘাট চিত্রকলা, অর্থাৎ ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা শহরে কালীঘাটের কালীমন্দিরের সন্নিহিত এলাকার মন্দিরকে কেন্দ্র করে হাট-বাজার গড়ে উঠেছিল। কালীমন্দিরে যে তীর্থযাত্রীরা আসতেন, ফেরার পথে স্মারক হিসেবে স্মৃতিচিহ্নমূলক বস্তু সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কালীঘাটের কালীমন্দিরের সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে স্মারক হিসেবে কালীঘাট চিত্রকলার উদ্ভব ঘটেছিল। চিত্রকলার বিষয় ছিল পৌরাণিক, ধর্মীয় অথবা পশুপাখি জাতীয় গ্রামীণ চিত্র। এগুলোই স্থানীয়রা নিজস্ব রঙে-ঢঙে আঁকতেন, যা কালীঘাট চিত্রকলা নামে বিখ্যাত ছিল। এমনি করেই শুধু কালীঘাট নয়, পটচিত্রকলার জন্মস্থান বেলিয়াতোড়, ওড়িষ্যা, প্রাচীন গুজরাট, মেদিনীপুর ঝাড়গ্রাম প্রভৃতি স্থান  থেকেও প্রচুর পট সংগ্রহ করেন যামিনী রায়।

 (আগামীতে সমাপ্য … ) 




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ