![]() |
অলংকরণ- দিব্যাংশ কুমার |
উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ছোট্ট একটি মফস্বল শহর গোবরডাঙ্গা। 'গো' অর্থে পৃথিবী, 'বর' অর্থে শ্রেষ্ঠ ও 'ডাঙ্গা' অর্থে স্থান। অর্থাৎ 'গোবরডাঙ্গা' শব্দের অর্থ হলো--- 'পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থান'। এই গোবরডাঙ্গাতে প্রায় দুশো বছর আগে থেকে একটি মেলা হয়ে আসছে, যে মেলা গোবরডাঙ্গার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আজও বহন করে চলেছে। এই মেলার জন্য গোবরডাঙ্গা ও আশেপাশের বেশ কিছু জায়গার মানুষ সারা বছর ধরে অপেক্ষায় থাকে। এই মেলার শুভ সূচনা হয়েছিল জমিদারদের হাত ধরে। তারাই মেলাটির নাম রেখেছিলেন 'গোষ্ঠ বিহার মেলা'। এই মেলার শুভ সূচনা হয়েছিল ১৮২৩ সালে জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে। জমিদার বাড়ির পাশের যমুনা নদীর তীরে একটা বড় ফাঁকা মাঠে এই মেলার শুভ সূচনা হয়।কথিত আছে দ্বাপর যুগে এই মাঠে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ গরু চড়াতে আসতেন। তাই এর নামকরণ করা হয়েছে গোষ্ঠ বিহার মেলা। বর্তমানে এই মেলা দুশো বছরে পদার্পণ করেছে। আশেপাশের ও দূরদূরান্তের বহু মানুষ বাংলা নববর্ষে এই মেলার অপেক্ষায় থাকেন। চাতক পাখি যেমন বৃষ্টির বারির জন্য অপেক্ষা করে, ঠিক তেমনি।
জমিদারি শাসন গোবরডাঙ্গায় যত বছর চলেছিল, তত বছরই এই মেলা পরিচালনার ভার জমিদারদের হাতেই ছিল। বংশপরম্পরায় এই মেলা তাঁরা পরিচালনা করে এসেছিলেন। পরবর্তীতে জমিদারী রাজ শেষ হলে একটা কমিটি তৈরি করে মেলা পরিচালনার দায়িত্ব তাদের উপর অর্পণ করা হয়েছে। তারাই মেলা পরিচালনা করে। তবে সিলেকশনের মাধ্যমে কমিটির সদস্য-সদস্যাদের পাঁচ বছর অন্তর পরিবর্তন করা হয়।
এই মেলায় একসময় সার্কাস থেকে শুরু করে যাদু, মরণকূপ, বাইস্কোপ সবই আসতো। কিন্তু বর্তমানে বন্য পশুদের সার্কাসে খেলা দেখানো নিষিদ্ধ বলে সার্কাস আসে না। তাছাড়া জাদু, বায়োস্কোপ সময়ের সাথে সাথে এখন তেমন চলে না। বর্তমানে নাগরদোলা, মরণকূপ, প্যারাসুট, বাচ্চাদের চড়ার হাতে টানা গাড়ি, ম্যাজিক, বিভিন্ন খেলনা ও প্রসাধনের দোকান, খাবারের দোকান, কাঠের আসবাবপত্রের দোকান, মাটির তৈরি জিনিসপত্রের দোকান, আইসক্রিম, ফুচকা, হোটেল আরো অনেক দোকান দেখা যায়। তবে মেলা কমিটি জায়গার ভাড়া এত পরিমানে বিগত পাঁচ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে যে কারণে অনেক দোকানদার এই মেলাতে আসেন না। ওই দশ দিন অন্য কোথাও মেলা থাকলে তারা সেখানে দোকান পাতেন।
গোষ্ঠ বিহার মেলাটি যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় তার জন্য স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও পৌরসভার পক্ষ থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন স্কুলের এনসিসির ছাত্ররা মেলায় ও মেলার পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই কদিন গাড়ি ও মানুষদের নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও বড় বড় গাড়িগুলিকে উপযুক্ত কারণ না পেলে, সন্ধ্যা ছটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত মেলা চলার দিনগুলিতে ওই রাস্তায় ঢুকতে দেওয়া হয় না। মেলা চলার কদিন বিকল্প রাস্তা দিয়ে গাড়িগুলো যেতে বলা হয়। মেলা কমিটির পক্ষ থেকে এনসিসির সদস্যদের জল ও টিফিনের ব্যবস্থা করা হয়। মেলা কমিটির এই দশ দিন একটা বড় অঙ্কের টাকা আয় হয়। যদিও এই টাকা বিভিন্ন কাজে খরচ হয়ে যায়।মেলা অফিসের উন্নতি করা থেকে শুরু করে, যারা সারা বছর মেলা অফিস দেখাশোনা করেন ও মেলা পরিচালনার জন্য এই কদিন কাজ করে থাকেন তাদের পারিশ্রমিকও এখান থেকে দেওয়া হয়। এছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য ও দশ দিন ধরে বিধান স্মৃতি সংঘের মাঠে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় তাতেও ব্যয় করা হয়। এই দশ দিনের শিল্পীদের ও অনুষ্ঠান পরিচালনা করা সদস্যদের টিফিন বাবদও একটা বড় টাকা ব্যয় হয়।
যমুনা নদীর তীরে মূলত এই 'গোষ্ঠ বিহার মেলা'টি অনুষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার অপর পারে গোবরডাঙ্গা কালীবাড়ি বিধান স্মৃতি সংঘের মাঠে এই দশ দিন ধরে মশলার মেলা চলে। দেখার মতো সেই মেলা। গোটা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় এরকম মশলার মেলা হয় না। পয়লা বৈশাখের আগের দিন রাত থেকে ফুল পাঞ্জাব লরি বোঝাই করা বিভিন্ন মশলা (সরিষা, জিরে, হলুদ, ধনে, লঙ্কা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, দারচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, মৌরি, মেথি, মগজ আরো অনেক কিছু) এই মাঠে প্রবেশ করে। দেখে যেন মনে হয় রাত দিনের ব্যবধান একেবারে ঘুচে গেছে। সারারাত এক প্রকার জেগে, পরদিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের ভোর থেকে বেচাকেনা করে সকলেই। এই মশলার মেলার জন্য বাইরের ও স্থানীয় ব্যবসাদাররা সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন। হাজার হাজার ক্রেতা সারা বছরের সংসারের প্রয়োজনীয় মশলা, বাজারের তুলনায় কম দামে এখান থেকে কিনে রাখেন। তবে যে সকল মশলা সারাবছর থাকবে, এমনই মশলা বেশি নেন। আশেপাশের এলাকার বৃহন্নলারা আয়ের সুযোগ মনে করে, ওই দিন এই মশলার মেলায় আসেন এবং হাজার হাজার টাকা আয় করে নিয়ে যান। এই গ্রীষ্মের দাবদাহে শরীরকে ঠান্ডা রাখার জন্য মশলার মেলার পাশ থেকে অনেকে আখের রস, আইসক্রিম, ঠান্ডা পানীয়, লেবু জল ও লস্যির দোকান দেন। তাদের বেচাকেনাও খারাপ হয় না। মশলার দোকানগুলো থেকে বিধান স্মৃতি সংঘ একটা ভালো টাকা ভাড়া বাবদ আয় করে থাকে।
বিকেল পাঁচটা থেকে মেলাতে মানুষ আসা শুরু করে। তবে সন্ধ্যা সাতটার পর মানুষের ঢল নামে। আবালবৃদ্ধনিতারা এই মেলায় ভিড় জমায়। তিনটি রাস্তা থাকে মেলায় ঢোকার জন্য। তাছাড়াও যমুনা নদীর পাশ থেকে মেলায় প্রবেশ করা যায়। রাত নটার সময় পা ফেলার জায়গা থাকে না। হাত ধরে না চললে সাঙ্গভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ভিড়ের মধ্যে চোর-পকেটমারের সমস্যাও লক্ষ করা যায়। সারিবদ্ধভাবে ফুচকার দোকান, হোটেল, মনোহারী দোকান, কাঠের আসবাবপত্রের দোকান, মাটির পাত্রের দোকান বসানো হয়। যাতে ক্রেতাদের কিনতে কোন সমস্যা না হয়। দশটা দোকান জিজ্ঞাসা করে কিনতে পারে তারা। এতে দোকানদাররাও কারো কাছ থেকে বেশি দাম নিতে পারেন না। তবে সপ্তাহের শনিবার ও রবিবার অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি ভিড় হয়। মেলা কমিটির পক্ষ থেকে প্রত্যেকদিন সন্ধ্যাবেলা কুইজের আয়োজন করা হয়। জেনারেল নলেজ ও গোবরডাঙ্গার ইতিহাস এই কুইজের বিষয় থাকে। প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে কুইজ অনুষ্ঠিত হয়। পাঁচটা প্রশ্নের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেন, তাদেরকে পেন ও বই পুরস্কার স্বরূপ দেওয়া হয়ে থাকে। মেলার দশম দিনে একটা বৃহৎ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করেন মেলা কমিটি। নয় দিন পর্যন্ত স্থানীয় বিভিন্ন নাচের, গানের ও নাটকের দল অনুষ্ঠান করে থাকে। শেষ দিন মূলত কলকাতা থেকে বিখ্যাত সব বেতার ও দূরদর্শন শিল্পীদের গান ও নাচ করানোর জন্য নিয়ে আসা হয়। তবে গত পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন কারণে কলকাতার শিল্পী আনা বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয় মানুষেরা বলতে গেলে দশ দিনই মেলায় যান ও আনন্দ উপভোগ করেন। যেহেতু বৈশাখ মাস, সেহেতু কালবৈশাখী ও বৃষ্টির কারণে মেলা চালানোর সমস্যা হলে, মেলা কমিটি দোকানদারদের কথা চিন্তা করে কোন কোন বছর দুই-তিন দিন মেলা বাড়িয়ে দিয়ে থাকেন। গোষ্ঠ বিহার মেলা যে মাঠে হয়, বর্ষাকালে সেই মাঠ দেখলে মনেই হবে না এখানে এত বড় মেলা বসে। যমুনা ও মাঠ জলে সমান হয়ে যায়। কিন্তু বৈশাখ মাস আসার আগে সেই জল শুকিয়ে গিয়ে মেলা বসার যোগ্য হয়ে ওঠে। মা প্রসন্নময়ীর কৃপাতে হয়তো এটা সম্ভব হয়।
এই মেলার পাশেই রয়েছে জমিদারদের নির্মিত প্রসন্নময়ী কালী ও দ্বাদশ শিবলিঙ্গের মন্দির। এই মন্দিরটি জমিদার খেলারাম মুখোপাধ্যায় নির্মাণ শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করে যেতে পারেন নি। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় ১৮২২ সালে মন্দিরটি সমাপ্ত করেন। এই মন্দির রানী রাসমণি দেখে গিয়ে দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। একই আদলে তৈরি এই দুটি কালী মন্দিরই। যারা প্রসন্নময়ী মায়ের মন্দির ও দ্বাদশ শিবলিঙ্গ কখনো দেখেননি, তারা গোষ্ঠ বিহার মেলা দেখার সঙ্গে সঙ্গে এই কালী মন্দিরও দর্শন করে পুন্য সঞ্চয় করেন।
0 মন্তব্যসমূহ