ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

সত্যমেব জয়তে-র ঢাল! - সুভাষ কর


 

১)

 

বাজারের দুই থলে হাতে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ১২ সি/২ বাসটা যখন স্টপে এল, ততক্ষণে চৈত্রের রোদ-ঘামে ফতোয়া-গেঞ্জি-পাজামা সব তার গায়ে সেঁটে একাকার। বছর ছেষট্টির দীপক বিশ্বাসের মনে হল কাজটা সে মোটেও ভাল করল না। তার যে গর্মির ধাঁচ! চট করে গরমেও ঠাণ্ডা লেগে যায়। ছাতা নিয়ে আসা উচিত ছিল। আসলে সে নিজেই জানত না আজ বাজার করতে বাড়ী থেকে বেরিয়ে কেষ্টপুরের ভেতরের বেশ ক'টা বাজার ছেড়ে একেবারে বাগুইহাটি বাজারেই চলে আসবে।  অথচ এত দূরে চলে আসার কথা বাড়িতে কাউকে বলা যাবে না। পরিবারে কড়া নিষেধ- এই বয়সে এভাবে যখন-তখন রোদে বেরুনো চলবে না। ছেলে তো সম্প্রতি বিয়ে করার পর যেন উল্টো বাবা হয়েই বলে দিয়েছে- এই গরমেও নিজের হাতে বাজার করতে চাও তো কর, কিন্তু ভোরবেলায় সব সেরে রোদের তেজ বেড়ে উঠার আগেই ফিরে এসে বিশ্রাম নিতে হবে। 


সকালে চা-বিস্কুট খাওয়ার পরই ফেসবুক-একাউণ্টটা চেক করতে কম্পিউটর-টেবিলে বসে গিয়েছিল দীপক। এই চক্করেই আজ সময়মত বাজারে বেরোনো হয়ে উঠেনি তার। ফলে কেষ্টপুরে বাড়ীর কাছাকাছি বাজারগুলিতে পছন্দমত মাছের দেখা কোথাও মেলেনি। এদিকে আজ শুক্রবার। শিউলি, মানে দীপকের পরিবারের হোম-মিনিষ্টার- যিনি এখন একাধারে মা এবং শাশুড়িমাও- ফাস্টফুড-জাঙ্কফুড-ফ্যান ব’নে যাওয়া নিজের কর্পোরেট-চাকুরে ছেলে আর বৌমাকে প্রত্যেক ‘উইক এণ্ডে’ একটু রুচি-পরিবর্তনের মাছ খাওয়াতে আগ্রহী। শুক্রবার বিকেল থেকেই শুরু হয়ে যায় এর প্রস্তুতিপর্বও। দীপককে সেই অনুযায়ী প্রতি শুক্রবারই ‘বিশেষ বিশেষ’ মাছ নিয়ে আসার ঢালাও নির্দেশও দেয়া রয়েছে। কিন্তু একসময়ে চাকুরীক্ষেত্রে সময়ের প্রতি নিষ্ঠার জন্যে যথেষ্ট সুনাম অর্জনকারী, দীপক বিশ্বাসের মতো একজন অবসরপ্রাপ্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তি কিনা ঠিক আজকের দিনেই বাজারে বেরুবার সময়টা নিয়ে এতটা গাফিলতি করে বসল !


যাক্‌, ঈপ্সিত বাসটা দেরী না করে এসে পড়ায় এবার অন্তত: সরাসরি এবং তুলনামূলক তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরতে পারবে দীপক। হাওড়া থেকে আসা এই ১২ সি/২ বাসটা ভিআইপি রোড বরাবর কেষ্টপুরের দিক থেকে এসে বাগুইহাটি পৌঁছেই একটু এগিয়ে জোড়ামন্দিরের কাছটায় ইউ-টার্ণ করে আবার কেষ্টপুরের দিকেই ফিরে যায়। পরে ভিআইপি কেষ্টপুর মোড়ে পৌঁছে সোজা না গিয়ে বাঁদিকে ঘুরে ভেতরে দীপকদের বাড়ীর কাছের মোড়টা হয়ে সোজা নিউটাউনের দিকে তার রুট। উল্টোদিকের রুটটা অবশ্যি একেবারেই অন্যরকম। তখন নিউটাউন থেকে কেষ্টপুরের ভেতর দিয়ে হাওড়াগামী এই বাসটি ভিআইপি কেষ্টপুর মোড় থেকে সরাসরি বাঁদিক হয়ে উল্টোডাঙ্গার দিকে চলে যায়- অর্থাৎ তখন বাগুইহাটি ছোঁয়ার কোন গল্প নেই। মানে বাড়ীর কাছ থেকে ধরা যায় এমন একটিমাত্র রুটের এই বাসে সরাসরি বাগুইহাটি আসা সম্ভব নয়। আগে অনেকবার কোন বিশেষ দিনে কিংবা অতিথি আপ্যায়নের তাগিদে ভাল মাছ কেনার আশায় দীপক দু’বার অটো পাল্টিয়েই দূরের এই জমজমাট বাজারটায় চলে এসেছিল। বলা বাহুল্য- সেগুলি সে করেছিল অনেকটাই এই বাসটিতে সরাসরি ফিরবার সুবিধেটাকে মাথায় রেখে। অবশ্যি সেটা পরিবারের অন্যদের জ্ঞাতসারে তথা সম্মতিতেই ঘটেছে- আজকের মতো হঠাৎ নেয়া নিজ সিদ্ধান্তে নয়।

 

বাগুইহাটি থেকে বাড়ী ফেরবার জন্যে বাসটা এগিয়ে গিয়ে ঘোরবার আগে বাগুইহাটি সাবওয়ের এপারেই চাপতে পারলে কখনোই খুব একটা ভীড়ের মুখোমুখি হতে হয় না। কিন্তু একি? আজ যে পুরো উল্টো! অকল্পনীয় ভীড়! দু’দুটো থলের ওজন বয়ে তার মত এক বৃদ্ধের পক্ষে এতে উঠা প্রায় অসাধ্য। এমন দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এই অপ্রত্যাশিত ব্যর্থতায় তার মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। এখন উপায়? সাবওয়ে পার হয়ে ওপার থেকে অন্য কোন বাস বা অটো ধরলে কেষ্টপুর-মোড়ে পৌঁছে আবারও তা বদলাতে হবে।  নিরুপায় দীপককে ওজন বয়েই দু’বার উঠানামা করে লোক-পারাপারের সিঁড়ি-সুড়ঙ্গটা পেরোতে হল।


২)


এপারে এসে নজরে পড়ল আগের সেই ভীড়ঠাসা ১২ সি/২ বাসটাও ততক্ষণে ঘুরে এদিকে চলে এসেছে। দীপক মনে মনে বলে উঠে- “শালা উঠতে পারব না জেনেই আবার সামনে পড়ে লোভ দেখাচ্ছে! যা, দূর হ চোখের সামনে থেকে। ভেবেছিসটা কি? তুই ছাড়া গতি নেই?” এমনিতে অবশ্যি একা দূরে না বেরোলে আজকাল দীপকের খুব একটা বাসে চড়া হয় না। স্ত্রী শিউলিকে নিয়ে দূরে কোথাও যাবার সময় ছেলে বরাবরই ভাড়া-গাড়ীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এখন তো উবের, ওলা, মেরু ইত্যাদির ক্যাবেরই আমল। তাই দীপকের কোন ওজর-আপত্তিই ধোপে টেঁকে না।


বাগুইহাটি থেকে তিন ধরণের মাছ আর কিছু দুষ্প্রাপ্য সব্জি পাড়ার বাজারের তুলনায় সস্তায় কিনে দীপক আজ অনেক পয়সা সাশ্রয় করে নিয়েছে, তবুও ফেরার পথে দু’বার ভাড়া গুণতে হবে ভাবতে তার গা জ্বলছিল। তেমন প্রয়োজনে এখান থেকে একেবারে বাড়ী অব্দি পুরোটা পথই রিক্সায়ও যাওয়া যায়। কিন্তু পঞ্চাশ টাকা ভাড়া দিয়ে রিক্সা নেবে ‘রিটায়ার্ড’ দীপক বিশ্বাস? তা ও দোষটা যেখানে তার নিজেরই? কক্ষনোই না। ভেতরে ভেতরে সে ভাল করেই জানে বাসের উদ্দেশ্যে ছোঁড়া তার গালিটা ছিল স্রেফ খরচ বাড়ায় তার ক্ষোভ আর রাগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।


বেচারা ঘামঝরা বৃদ্ধের ভেতরের কষ্টটা বুঝি অন্তর্যামী টের পেলেন। দেখা গেল পেছন পেছন আসা আরেকটা প্রায় ফাঁকা বাসের কণ্ডাক্টর ‘বাজার, বাজার’ বলে হাঁক পাড়ছে। এই ডাক তো দীপকের খুবই পরিচিত। এই ‘বাজার’ মানে কেষ্টপুর মিশন বাজার। কিন্তু ১২ সি/২ বাসটা ছাড়া আর কোন বাসই তো ওই রুটে চলে না! রোদে ও ঘামে চশমার ভেতর দিয়ে দীপকের দৃষ্টি ঝলসে যাচ্ছে- বাস-নাম্বারটা ঠিকমত পড়তেও পারছে না। শেষে বাসটা খুব কাছে চলে এলে স্পষ্ট দেখতে পেল, হ্যাঁ, এটাতেও তো ‘১২ সি/২’-ই লেখা বটে! 


এই বাসরুটে বাড়ীর কাছাকাছি মাঝেমাঝেই এমন দৃশ্য সে অনেক দেখেছে। রুটের তৃতীয় কোন বাস সহজে না পাবার সম্ভাবনাকে দৃঢ়তর করে প্রায়ই একসাথে দু’টো বাস পরপর ছুটে চলে। আগে নিজের কোন প্রয়োজন না থাকাতে তেমনটি দেখামাত্র প্রতিবার তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি হ’ত। হয়তো অপরিচিত পাশের মানুষটাকে অযাচিতভাবে বলেই ফেলতো, “দেখছেন মশাই, কি অদ্ভূত কাণ্ড, এভাবেই বোধহয় রেষারেষির জন্ম হয়”। কোলকাতার ব্যস্ত পথিক-শ্রোতার এসবের জবাব দেবার সময় কই? তবু কদাচিৎ নির্লিপ্ত একটা ‘হু’ শুনলেই নিজের অনুভবের পক্ষে জনসমর্থন পাওয়া গেল বলে সান্ত্বনার তৃপ্তি খুঁজে নিত দীপক। কিন্তু আজ? প্রথমটির গা-ঘেঁষা দ্বিতীয় বাসের দর্শনে দীপকের চোখেমুখে একরাশ খুশীর ঝলক। খুব আয়াসেই বাসটায় উঠে যখন মনের মত সীটটার নীচে বাজারের থলে দুটো গুঁজে দিয়ে তার উপরেই নিজেও আরামসে বসে পড়ল, ঘর্মাক্ত দীপকের তখন নিজেকে একজন সম্রাট বলেই মনে হচ্ছিল।


সামনেই ভিআইপি কেষ্টপুরের মোড়। দূর থেকে দেখা গেল আগের বাসটা বিপুল সংখ্যক যাত্রীর মহা-বোঝা টানতে টানতে বাঁদিকে টার্ণ নিচ্ছে। একটু পরেই আদ্ধেকেরও কম যাত্রী-বোঝাই দীপকদের বাসটাও তার পূর্বসূরীর শূন্যস্থানটা পূরণ করে সেখানে এসে জমিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিন্তু আপদ বড় বালাই। সেই জমা যেন ডিপ্‌ ফ্রিজের বরফ থেকেও কয়েক ডিগ্রী নীচের তাপমাত্রার। গলবার আর নামগন্ধ নেই। মুষ্টিমেয় কিছু যাত্রী বাড়লে প্রায় দশমিনিট পর আবার তার গলা তথা ধীরচলা শুরু। বড়ই অনীহার সে চলা। আসলে তখন অফিসটাইম অতিক্রান্ত- তাছাড়া সবাই তো আর দীপকের মতো আধা-অভিজাত অথর্ব অবসর কোন বাবু নয় যে ভীড় দেখে আগের বাসটা সহজেই হাতছাড়া হতে দিয়ে পরের বাসের জন্যেই অপেক্ষা করছে।


৩)


‘সম্রাট’ দীপক বিশ্বাস পরম তৃপ্তিতে ‘তার নিজের’ বাসটায় কেষ্টপুর মেনরোড ধরে একে একে রবীন্দ্রপল্লী, হানাপাড়া ইত্যাদি পার হয়ে এলেন। আর কয়েকটা স্টপ্‌ পরেই ঘোষপাড়ায় সম্রাট নেমেও যাবেন। কিন্তু তিনি শুধু মনে মনে ছক আঁটছিলেন বাড়ী ফিরে তার নিজের দেরীর কারণ হিসেবে সম্রাজ্ঞীর কাছে ঠিক কি ব্যাখ্যা দেবেন। না জানিয়ে এত দূরে চলে আসার কথা জানাজানি হলে যে রক্ষে নেই! শান্ত নরম-মনের নতুন বৌমাটা অব্দি মুচকি হেসে বুঝিয়ে দেবে- তার নতুন ‘ভাল’ বাবাটা অন্তত: এক্ষেত্রে একেবারেই ঠিক কাজ করে নি। অবশ্যি একটা বাড়তি সুবিধে এই ‘শ্বশুরবাবা’-টির তরফে বরাবরই আছে। বাজারে বেরুলে দীপক প্রায়ই দোকানদার, কিংবা এর-তার সাথে গল্প জুড়ে দেয়। এটা সবার কাছে জানা না হলেও ইদানীং বহুলাংশে পরিবার-পরিজনবিদিত। কিন্তু আজকের দেরীর মাত্রা এতটাই বেশী যে তাকে সেইসব "সত্যি-গল্প" বলে ম্যানেজ করা অসম্ভব। আজ দীপককে সুন্দর করে বানানো কোন নিখুঁত ও নতুন মিথ্যে-গল্পই বলতে হবে। যদিও মিথ্যে-গল্প সে ভালই বানাতে পারে- সে দক্ষতা ঈশ্বর তাকে দিয়েছেন- কিন্তু তেমন বিশেষ কোন প্রয়োজন ছাড়া মিথ্যে বলায় তার যে একেবারেই অরুচি! অথচ গিন্নী বা ছেলের ঝাঁঝালো ডাঁটানি থেকে বাঁচতে আজ তাকে এটাই করতে হবে ভেবে তার বেশ অপরাধবোধই হচ্ছিল। 


সাইড-সীটে বসা এক যুবক- বছর পঁয়ত্রিশের হবে হয়ত- বেশ কতক্ষণ ধরেই মোবাইল-সেটে নানাজনের সাথে বারবার কথা বলে যাচ্ছিল। হঠাৎ সে দিব্যি অপর প্রান্তের জনৈক শ্রোতাকে বলে উঠল, “...... না, না, স্যার, আজ হচ্ছে না। আমি তো এখন কোলকাতার বাইরে আছি। পরে করে দেব খ’ন। হ্যাঁ, হ্যালো, কি বলছেন? আজই করে দেবার কথা ছিল? ও তাই? আমি নিজেই বলেছিলাম? সে যাক্‌গে, আজ তো কিছুতেই হচ্ছে না স্যার। ঠিক আছে, আমি কোলকাতায় ফিরেই যোগাযোগ করব। আপনি শুধু আজকালের ভেতর এডভান্সটা জায়গামত পৌঁছে দেবেন, ব্যস্‌ ......”।


কেষ্টপুরটা যে ঠিক মূল কোলকাতায় নয়, জিলা হিসেবে ধরলে উত্তর ২৪ পরগণায়, তা সবাই জানে। কিন্তু বৃহত্তর কোলকাতার এই কেষ্টপুরে এতদিন হল বসবাস করে কাউকে  দিব্যি কোলকাতায়ই কোন বাসে বসে এত সাবলীল ভঙ্গীতে ‘কোলকাতার বাইরে আছি’ বলতে এর আগে দীপক কখনো শুনেনি। যতক্ষণ মোবাইলে যুবকটির কথাবার্তা চলছিল, রাস্তার দুপাশে একে একে পেছনে যেতে থাকা দোকানগুলোর দরজার উপর সাইনবোর্ডে ‘কোলকাতা-১০২’ লেখা রঙ-বেরঙের অক্ষর ও অঙ্কগুলো যেন দীপকের চোখে প্রহসন হয়ে উঠছিল।


৪)


জোড়াখানা ছাড়িয়ে বাস এতক্ষণে মাঝেরপাড়ায় এসে গেছে। আর দু’টো স্টপ পরেই ঘোষপাড়ায় ‘বাজারসম্রাট দীপক’-এর পদার্পণ ঘটবে। কিন্তু প্রহসনের বুঝি আরো বাকী ছিল। এবারে দীপকের পাশাপাশি সীটে বসা বেশ স্মার্টমতো এক ভদ্রমহিলাও কার সাথে মোবাইলে কথা বলার সময় হঠাৎ বলে উঠল, “কি বলছিস? তোর মিস্টার আমার উপর খুব রাগ করেছে? দেখা করিনি বলে? আর বলিস না ভাই, আমাকে আজই হঠাৎ যাদবপুরে চলে আসতে হল রে। তুই-ই বল্‌, নর্থের কোথাও থাকলে না হয় একবার ঠিক দেখা করে আসা যেত। অ্যাই, প্লী-ই-ই-জ, তুই একটু ওকে বুঝিয়ে বলবি তো?” দীর্ঘায়িত মিষ্টি স্বরের ‘প্লীজ’-এর সবিনয় মাধুর্য সুগন্ধী পারফিউমের মতো সীটের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল বটে, কিন্তু মিথ্যাচারের পরপর এই দু’টো ঘটনা যেন দীপকের চেতনায় জোর ধাক্কা মারল। সে লক্ষ্য করল- বাসে দু’তিনটে বাচ্চা পর্যন্ত মুচকি মুচকি হাসছে আর পরপর মিথ্যে বলে যাওয়া ঐ দু’জন যাত্রীকে ইঙ্গিত করে নিজেদের মধ্যে কিসব বলাবলি করছে। ওদের পিঠে বই-খাতার ব্যাগে নতুন কোন অধিগত বিদ্যে ঢুকিয়ে নিচ্ছিল কিনা কে জানে?


দীপক এবার ভাবতে চেষ্টা করে কোন্‌ পরিস্থিতিতে ওদেরকে এসব মিথ্যেগুলো বলতে হচ্ছে। যুধিষ্ঠিরও বিশেষ প্রয়োজনে মিথ্যে বলেছিলেন বৈকি। কিন্তু মিথ্যে বলে আজকের দুই নায়ক-নায়িকারা কি আসলেই খুব বিপজ্জনক কোন অবস্থা থেকে রেহাই পেতে চাইছেন? অথচ ঐ দু’জন যাত্রীর কাউকে দেখেই তো অন্তত: এই মুহূর্তে তাদের জীবনে তেমন কোন বিপর্যয়ের আভাস দেখা যাচ্ছে না! প্রথমজন তো দিব্যি বৌ-বাচ্চার সাথে হাসি-ঠাট্টা করতে করতেই যাচ্ছে। সে নিউটাউনের ‘অ্যাকুয়াটিকা’-র টিকিট কেটেছে আর তার নিজের বছর পাঁচেকের বাচ্চাটাকে নানা কায়দায় অঙ্গভঙ্গী করে বোঝাচ্ছে সেখানে গিয়ে কেমন করে ‘সুইমিং’ করতে হবে। আর ওই স্মার্ট ভদ্রমহিলা তো একটু আগেও কেষ্টপুর মোড়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা বাসটায় রাশভারী সব কথাবার্তা বলছিলেন। একদিকে কোলকাতার বাতাসে বৃষ্টিহীন উষ্ণতা, আর অন্যদিকে নোটবন্দী থেকে শুরু করে রামনবমীর মিছিলে তলোয়ার নিয়ে হাঁটা ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলে কত না সেমি-পলিটিক্যাল বক্তৃতাও ঝাড়ছিলেন !


মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে চলে আসতে দীপকের খুব একটা সময় লাগল না। সে বেশ বুঝতে পারল- নিজ দায় এড়াতে সামান্য কোন ক্ষুদ্রস্বার্থেই হুট করে মিথ্যে বলাটা আমাদের প্রত্যেকেরই সাধারণ অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। 'সত্যমেব জয়তে'-র শিক্ষা আপাততঃ সমাজবদ্ধভাবেই শিকেয় তোলা। যাত্রী দু’জন তারই দৃষ্টান্ত রেখেছে। দীপক এবার আয়নায় নিজেকেও একবার দেখে নেয়। নিজের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে আত্মবিশ্লেষণ করে। মনে মনে সেও তো অনেকক্ষণ ধরেই একাধিক মিথ্যে গল্প বানাবার চেষ্টা করছে। তাহলে সে আর ব্যতিক্রমী কিসের? একটুবাদেই বাড়ী ফিরে তার দ্বারাও তো সেই একই মিথ্যের অনুশীলন হতে যাচ্ছে। এবার সে ঠাণ্ডামাথায় ভাবে- আচ্ছা, সত্যি কথাটা বলে দিলে আমার কি এমন ক্ষতি হবে? নাহয় অবাধ্যতার অভিযোগ উঠবে; নিজের বৌ তো বিগত ছত্রিশ বছর ধরে খুব একটা কম শাসন করল না; এবার নাহয় সেই সাথে ছেলের দু’টো কটু কথাও শুনব। কোন্‌ মহাভারত তাতে অশুদ্ধ হবে? তাই বলে জ্বলজ্যান্ত মিথ্যে কথা বলে নিজের লোকদের কাছে সাময়িক ভাল সাজতে হবে?


ঠিক এমন সময় দীপকের পকেটে মোবাইলের হ্যালো টিউনটা বেজে উঠল। কিছুদিন আগে মেয়ের ডাউনলোড করে দেয়া নতুন রবীন্দ্র-সঙ্গীতটায় যেন কথা ও সুরের আত্মনিবেদন ফুটে উঠে- ‘জানি তোমার অজানা নাহি গো কি আছে আমার মনে, আমি গোপন করিতে চাহি গো- ধরা পড়ে দু’নয়নে ......’। দীপক ভাবে, এই মুহূর্তে এই টিউনটারই তো তার প্রয়োজন ছিল। সে গম্ভীর গলায় ফোনে সাড়া দেয়, “হ্যালো, শিউলি? হ্যাঁ, বল”। কলার’স ইমেজে স্ত্রী শিউলির ছবিটা আগেই ভেসে উঠেছিল। এবার তার কন্ঠস্বরও ভেসে এল:-

--  কি গো, তুমি কোথায়? আর কতক্ষণ?

--  এই তো আসছি।

--  এতো দেরী কেন? কোন অসুবিধে হয় নি তো? আচ্ছা, তুমি কি বাগুইহাটি চলে গেছিলে?

-- কি যে বল। (ঢোঁক গিলে) আচ্ছা, হঠাৎ তোমার এমন মনে হল কেন বল তো? 

--  না, মানে এত দেরী তো, তাই। 

--  কিন্তু আমি তো কতদিন বা-বাজারে গ-গল্প করেও দে-দেরী করে ফেলি। তু- তুমি তো তা জা-জানোই (জীবনে এই প্রথম দীপককে তোতলাতে শোনা যায়; একটু আগে ভেবে রাখা তার সব ছক একেবারে উল্টেপাল্টে যায়)।

--  অতশত জানিনে বাপু, তাড়াতাড়ি বাড়ী এস, তোমার ছেলে খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে অফিস যাচ্ছে।

- আরে ছেলেকে জানিয়ে দাও- আর কোন দুশ্চিন্তা নয়। এবার সব কুচিন্তার অবসান। এখন শুধুই সু-চিন্তার আবাহন। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নিশ্চিন্তে কর্মক্ষেত্রে রওয়ানা হ'তে বল।

- কি আবোল-তাবোল বলছ? তুমি ঠিক আছো তো? 

- একদম বিন্দাস আছি, চিন্তার কিছুই নেই। আমার ভুলভাল ভাবনাকেও এখন তাড়াতে পেরেছি।

- আবার কি উল্টোপাল্টা বলা হচ্ছে? তুমি এখন ঠিক কোথায়?

- এই তো আমি বাসে। এসেই পড়লাম বলে। ঘোষপাড়ায় প্রায় পৌঁছেই গেছি। জানো শিউলি, ওই ফেরার বাসটা আজ বাগুইহাটি পৌঁছুতে বড্ড দেরী করে দিল, তাও ভীষণ ভীড় ! আচ্ছা, বাড়ী এসে তোমাকে সব খুলে বলছি। না, না, কিচ্ছু লুকাবো না। বিশ্বাস না হলে তুমি মিলিয়ে নিও।


সব অপরাধবোধের অবসান ঘটিয়ে স্ত্রীকে সত্যি কথা শোনানোর এই প্রতিশ্রুতি দীপকের মুখ থেকে অত্যন্ত সাবলীলভাবেই বেরিয়ে এল। সাথেসাথেই বাসে তৈরী হওয়া অতি-আয়াসী মিথ্যে বলাবলির দূষিত বাতাবরণটা যেন অনেকটাই পরিশুদ্ধ হয়ে গেল। আর দীপক নিজে? সেও রক্ষা পেল সমাজের ক্ষুদ্রস্বার্থবোধপ্রসূত, সহজেই পরিহার্য অথচ হুট করে অনুশীলিত, আরো একটা রুটিন-মিথ্যাচার থেকে। আজকের অভিজ্ঞতা কি তাকে এই রুটিন-মিথ্যাচার থেকে দূরে থাকার, এবং 'সত্যমেব জয়তে'-র শিক্ষাকে বাঁচাবার একটা নির্ভরযোগ্য ঢাল উপহার দিল?


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ