ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

সুদীপ্তের ঈশ্বরবিশ্বাস বনাম ইতিহাস নির্ভর যুক্তিবাদ -সুভাষ কর

 পারিবারিক সূত্রে বহুদিনের ঈশ্বরবিশ্বাস বয়ে বেড়াচ্ছে বছর চল্লিশের সুদীপ্ত দত্ত ওরফে এক সময়ের সুদীপ্ত দত্তগুপ্ত, যদিও আশৈশব নিজ পরিবারেই বংশ নিয়ে গরিমা আর অবজ্ঞার অনুশীলন হ'তেও নেহাৎ কম দেখেনি সে। বরাবর অনেকটা গর্বের সাথেই সে জেনে এসেছিল- ওরা নিজেরা নাকি 'বদ্যি' বংশোদ্ভূত, যারা কিনা বর্ণ বিচারে 'ব্রাক্ষ্মণেরই প্রায় সমতুল্য'। ঘটা করে বলতে শুনেছে- বিয়েতে, শ্রাদ্ধে বা অন্য যেকোন উৎসবে মন্ত্রোচ্চারণের সময় নাকি একমাত্র ব্রাক্ষ্মণ ও বদ্যি, এই দুই কাষ্টের বেলায়ই নামের শেষে 'দেব' বা 'দেবী' শব্দের ব্যবহার অনুমোদিত; আর অন্যদের নাম উল্লেখের সময় সবার শেষে পুরোহিতেরা 'দাস' বা 'দাসী' শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন।


বাস্তবের বিচিত্র অভিজ্ঞতা কিন্তু সুদীপ্তের ভেতরে নিজেদেরকে ব্রাক্ষ্মণদের সমগোত্রীয় ভাবার এই অহেতুক আত্মশ্লাঘাকে বেশীদিন টিঁকতে দেয়নি। সেই ছেলেবেলায় প্রথম যেদিন এক 'ব্রাক্ষ্মণ' বন্ধুরই বাড়ীতে জন্মদিনের পায়েস খাওয়ার পর বন্ধুর বুড়ী ঠাকুমার নির্দেশে নিজের এঁটো বাসনটা নিজেই ধুয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল সুদীপ্ত, সেদিনই তার মনে যেন ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠেছিল। তেষ্টা পেলেও আর কোনদিন ওই বাড়ীতে জল পর্যন্ত খায়নি সে। কথাটা জানাজানি হয়ে গেলে সুদীপ্তদের বাড়ীতে অবশ্যি বলা হয়েছিল, এরকম নাকি হয়েই থাকে। "তোর ঠাকুমাও তো দেশের বাড়ীতে কত বাগ্দীর ছেলে, এমনকি কত মুসলমান বাচ্চাদেরকেও উঠোনে বসিয়ে পরম যত্নে খাইয়ে, পরে আবার নিজেই সেখানে গঙ্গাজল ছিঁটিয়ে দিত।"- মায়ের মুখে এজাতীয় মলমী সাফাই সে বহুবার শুনেছে ! আরো শুনেছে- "যারা বংশের বিচারে উপরে রয়েছে, তারা নীচের দিকে একটু বাঁকা চোখে তাকাতেই পারে; এটা সমাজেরই অনুমোদিত এক পরম্পরা"! শুনে তার ক্ষোভ বাড়ত বৈ কমত না। বরং কথিত 'উঁচু' বর্গীয় মানুষদের থেকে পাওয়া এইধরণের কষ্টকল্পিত করুণাপ্রসূত যত্নাদি বা অনুগ্রহ খারিজ করতে পারার মত পরিস্থিতি ছিল না বলে সেসব কথিত 'নীচু' কাষ্টের বা অন্য ধর্মের বাচ্চাদের জন্যে তার ভীষণ সহানুভূতি ও সমবেদনা হ'ত। বলা চলে, এরই প্রসারিত জেরে নিজেকে 'বদ্যি' বংশোদ্ভূত ভেবে অহেতুক আত্মতৃপ্তির অনুভবকে একদিন সে নিজেই গলা টিপে হত্যা করল। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের পদবী থেকে বনেদিপনাসূচক 'গুপ্ত' অংশটিকে ছেঁটে ফেলে সে নিজেকে শুধুই 'সুদীপ্ত দত্ত' হিসেবেই পরিচিত করল।


একটা কথা কিন্তু মানতেই হবে- তথাকথিত 'নীচুজাতের' বা ভিন্ন ধর্মের কাউকে সামগ্রিক অর্থে 'ঘৃণা' করার মতো শিক্ষা সুদীপ্তরা তাদের পরিবারে কোনদিনই পায়নি; কারণ, সর্বদাই বলা হয়েছে- সবার মধ্যেই নাকি 'ঈশ্বর' রয়েছেন ! অর্থাৎ প্রত্যেকের ভেতরে ঈশ্বরের অবস্থানই যেন ঘৃণা পাবার বিরুদ্ধে তথাকথিত নীচুজাত বা ভিন্ন ধর্মের মানুষের একমাত্র ঢাল ! কিন্তু বড় হয়ে সুদীপ্ত একদিন বুঝতে পারল- অনেকেই তো ঈশ্বর মানেন না, যারা নিজেদের 'নাস্তিক' বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। এবং বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সব ধর্মের ও জাতের মানুষের মধ্যেই এদের অস্তিত্ব রয়েছে যারা আবার সংখ্যায় উত্তরোত্তর বর্ধিষ্ণু। তাদের অনেকেই কাউকে উঁচু বা নীচুজাত বলে স্বীকারও করেন না। সুদীপ্ত শুধু ভাবত- এই দুনিয়া যদি ঈশ্বরেরই সৃষ্টি হয়ে থাকে, আর সবকিছু যদি একমাত্র ঈশ্বরেরই ইচ্ছায় সম্ভব হয়ে থাকে, তবে ওরা নিরীশ্বরবাদীই বা হয় কি করে, আর তাঁরই বিধানে তৈরী জাতিভেদ না মানার এত সাহসই বা পায় কিসের জোরে?


একদিন কে একজন বলল, ওই নিরীশ্বরবাদীরা নাকি মানুষের 'সত্যি ইতিহাস' জেনে গেছে, আর 'সত্যি ইতিহাস'- নির্ভর যুক্তিভিত্তিক বিচারবোধেই নিহিত রয়েছে তাদের সব শক্তি। সুদীপ্ত ভাবল, বিজ্ঞানের ছাত্র হ'লেও ইতিহাস তো কমবেশী সে নিজেও পড়েছে- আর ওর নিজের দাদা তো এই সময়টায় কলেজে ফাটিয়ে ইতিহাস পড়ান, এবং সেই সুবাদে প্রায়ই টিভি চ্যানেলে 'বিশেষজ্ঞ' হিসেবে তাকে পর্দায়ও দেখা যায়। অথচ সেই দাদা বিরাট 'ধর্মপ্রাণ' ব্যক্তি হয়েও স্রেফ 'ছোটজাত' বলে তার অতি প্রিয় মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করা তিন বছরের পুরনো জামাইটাকে এখন অব্দি মেনে নিতে পারেনি। তাই, সুদীপ্তর মনে প্রশ্ন জাগল- কি সেই না জানা সত্যি ইতিহাস, যা জানলে জাতপাতের অস্তিত্বকে মনের ভেতর থেকেই অস্বীকার করে চলা যায়- কোনরকম ঈশ্বরীয় উদারতার আড়াল ছাড়াই? কিংবা কোন্ সে সত্যি, যা খোদ ঈশ্বরকে না মেনেও কোন অসহায়ত্ববোধের অনুভব ছাড়াই বেশ ভালভাবেই জীবন কাটাবার হিম্মত যোগাতে পারে? 


একদিন সুদীপ্ত জানতে পারল ঐ সত্যি ইতিহাস নাকি সবাইকে জানায়- একসময় মানুষে মানুষে 'জাত' বা 'বর্ণ' নিয়ে ভেদ বলে কিছুই ছিল না- সবই পরবর্তীকালে মানুষের সৃষ্টি; তাও জন্মের ভিত্তিতে নয়- কাজের ভিত্তিতে। সে আরো জানল- মানুষে মানুষে যা কিছু ভেদাভেদ, তা মূলত: সম্পত্তির উপর ব্যক্তি-মালিকানার বৈষম্যের থেকেই উদ্ভূত; ধর্মের সৃষ্টিও মনুষ্যজাতির সৃষ্টির অনেক পরে; খোদ ঈশ্বরই নাকি স্রেফ মানুষের কল্পনার ফসল- বাস্তবে যার অস্তিত্ব এখনো কার্য-কারণ সম্বন্ধের মাপকাঠিতে অপ্রমাণিত।


সব মিলিয়ে আজ এই চল্লিশোত্তর সুদীপ্তের ভাবনা সম্পূর্ণ না পাল্টালেও, অনেকটাই নাড়া খেয়েছে। সুদীপ্ত এখন দ্বিধাহীনভাবেই ভাবতে পারে- সর্বভূতে বিরাজমান ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস যদি পৃথিবীতে মানুষে মানুষে প্রেম-ভালবাসার সেতুবন্ধন গড়তেই ব্যর্থ হয়, তবে সেই বিশ্বাসে কার কি লাভ? যেকোন বিশ্বাসেরই ফসলটা ভাল কি মন্দ, তা বিশ্বাসীর মানসিক ঔৎকর্ষের উত্তরোত্তর বৃদ্ধিতেই প্রতিফলিত হবার কথা- এ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণের বা তর্ক-বিতর্কের দ্বিতীয় কোন মাপকাঠি নেই। সুদীপ্তের চেতনায় ঐ স্বল্পালোচিত সত্যি ইতিহাস জানাটা যুক্তিবিজ্ঞানের এক প্রসারিত ক্ষেত্র প্রস্তুত করল- ভক্তির আড়ালে গড্ডালিকার ধর্মভীরুতা থেকে মুক্ত হতে তাকে সাহায্য করল।


কিন্তু চারদিকে নজরে আসা একধরণের যান্ত্রিক গ্ল্যামারযুক্ত নাস্তিকতাতেও সে ঠিক ভরসা করতে পারল না। আধ্যাত্মিকতার বেশ গহনে স্থিতচেতন সুদীপ্তের মনের চাহিদা যুক্তিবিজ্ঞানের সাহচর্যে যেন আরো অনেক বেড়ে গেল। তাই আজকাল 'অমুক একজন নিখাদ ভক্ত', কিংবা 'তমুক কেউ ঈশ্বরে পুরোপুরি অবিশ্বাসী'- শুধু এইটুকু তথ্য সুদীপ্তের পর্যাপ্ত সমীহ আদায় করতে ব্যর্থ। তার দাবী যে এর চেয়ে ঢের বেশী ! সুদীপ্তের এখন দৃঢ় বিশ্বাস- যে ঈশ্বরসাধনা সংকীর্ণ আত্মস্বার্থপ্রসূত, শুধুই ব্যষ্টির কল্যাণকামী ও জগন্মঙ্গলের সংকল্পবিযুক্ত, তা একেবারেই অসম্পূর্ণ। তেমনি সমষ্টির চেতনাবিযুক্ত নিছক আত্মকেন্দ্রিক নাস্তিক্যবাদও আসলে যুক্তিবাদের বুনিয়াদী ভিত্তিটাকেই অস্বীকার করে। যেহেতু মানুষ একা বাঁচতে পারেনা, বরং পরস্পরের প্রতি নির্ভরতাই তার ইচ্ছানিরপেক্ষ এক বাস্তবতা, তাই তাকে পারস্পরিক মর্যাদার এক সঙ্ঘবদ্ধতার বন্ধন খুঁজে নিতেই হবে। নইলে চলার সব পথই এক একটি অন্ধ গলি মাত্র।


এই ভাবনা নিয়ে পথ চলতে চলতে কোন এক অজানা পুণ্যের ফলে সুদীপ্ত একসময় এক ব্যতিক্রমী কর্মযোগী আধ্যাত্মিক গুরুর শিক্ষায় দীক্ষা লাভ করল। এবং এই অগতানুগতিক  গুরুদেবের কাছে প্রাপ্ত শিক্ষায় সুদীপ্তের ঈশ্বর-আরাধনার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে গেল এক অঙ্গীকার- "ওঁ জগন্মঙ্গলম্ ভবামি" অর্থাৎ "আমি জগতের মঙ্গলকারী হচ্ছি"। এই জীবনদর্শনই তাকে শেখালো- যতই বিপ্লবী বিপ্লবী গন্ধ বা গ্ল্যামার থাকুক, সার্বিকভাবে জগতের পক্ষে হিতকর নয় এমন কোন পদক্ষেপ নিতান্তই গুরুত্বহীন। সুদীপ্তের দৃষ্টিভঙ্গীতে এখন কথা ও কাজের ফারাক দিয়ে তত্ত্বের সার-অসারতা যাচাই করাটাই গুরুত্বপূর্ণ-  গতানুগতিক নিন্দা-প্রশংসার ঠুনকো মূল্যায়নের চাইতে যা অধিকতর কাম্য। গঠনমূলক নিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক সমালোচনার পথে এখন তার সাবলীল বিচরণ। জাতপাত ধর্মের অমানবিক ভেদাভেদ ভুলে একদিকে সে যেমন নিজেকে বিশ্বমানব বলে ভাবতে পারছে, তেমনি অন্যদিকে নিজেকে এক ঈশ্বরের (হোক না কারো কারো বিচারে তা কল্পিতই) সন্তান বলে ভাবতে পারায় কোন ভেদভাব বা কোন কুসংস্কারই কিন্তু তাকে আর পেছনে টেনে রাখতে পারছে না। একজন সত্যিকারের সাম্যবাদীর দৃষ্টিতে পৃথিবীর সব সম্পদের উপর যেমন বিশ্বমানবগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি নরনারীর সমান অধিকার, তেমনি একজন প্রকৃত ঈশ্বরবিশ্বাসীও মনে করেন- "পরের বাড়ী পরের জমিন ঘর বাইন্ধা আমি রই, আমি ত সেই ঘরের মালিক নই"। তাই ভাবের ঘরে কোন ফাঁকি না থাকলে  দু'জনের ব্যক্তি-আচরণের মূল জায়গায় বাস্তবে কোন দ্বন্দ্ব থাকার সংগত কোন কারণই নেই।


সাম্প্রতিক কালে জ্যোতিষীর উপর নির্ভরতা সম্পূর্ণ বর্জন করে ঈশ্বরপ্রদত্ত (তার বিশ্বাসমতো) শক্তির সবটুকুর সদ্ব্যবহার করে অধ্যাবসায়কেই সাফল্যের আসল চাবিকাঠি হিসেবে দেখতে শিখেছে সুদীপ্ত। কেননা তার ঈশ্বরবিশ্বাসের স্বকীয়তাই তাকে স্বাবলম্বনের পথ ধরিয়ে দিয়েছে। সত্যি অর্থে সে শিখেছে-"God helps only those who help themselves." স্বাবলম্বন ও অভিক্ষার দর্শনে উদ্বুদ্ধ তার আধ্যাত্মিক চেতনায় সংযোজিত হয়েছে গীতার অমোঘ বাণী "নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য, ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ !" অর্থাৎ "বলহীনের দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ হয় না, আর ভিক্ষার দ্বারা তো নয়ই"। সুতরাং প্রচলিত অর্থে কীর্তনের ঘোরে হাইতোলা ঈশ্বরভজনে ইহকাল ও পরকালের সুখ সুরক্ষিত করার পথ তার নয়। বরং বিশ্ব ভরা এই প্রাণসম্ভারে ঘটনাচক্রে স্থান পেয়ে যাওয়া অতি প্রিয় মূল্যবান এই জীবনটিকে কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা কাছের দূরের সবার কল্যাণে উৎসর্গীকৃত করাকেই সে তার সার্থকতা হিসেবে মেনে নিয়েছে। আর তার ঈশ্বরচেতনা যতক্ষণ সেই পথের সহায়ক রয়েছে বা থাকছে, ততক্ষণ সে অবশ্যিই আস্তিক; কিন্তু যেই মুহূর্তে মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরীতে তার এমন অবদান চোখে আসবে (যা আবার নেপথ্য কোন দুর্বৃত্তের অসৎ পরিকল্পনাপ্রসূত নয়)- সেই মুহূর্তে অন্ধ ঈশ্বরভক্তি ছেড়ে সে ভিড়ে যেতে চায় অবদমিত মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্যে লড়াইকামীদের পাশে- ঈশ্বরে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস যেখানে মোটেও কোন ফ্যাক্টর নয়। এর কারণ- সে যে আস্থা রাখতে শিখেছে ঈশ্বরেরই দেয়া নিজস্ব বিবেক ও বিচারবুদ্ধির যথাযথ অনুশীলনে ! সে যে জেনেছে- কোন বিশেষ অবাঞ্ছিত মুহূর্তে মানুষের তৈরী অন্ধকার দূর করার প্রয়োজনে কখনো কখনো খোদ হিরো-ঈশ্বরকেই ভিলেন-ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে দেয়াও তাঁরই দুনিয়ার ঘোষিত ন্যায় ও ধর্মযুদ্ধেরই একটি আবশ্যিক ধাপ হতে পারে !


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ