সেদিন ও ঘাটের মাঝি কে জিজ্ঞেস করলাম,
“ তুমি ক্লান্ত হও না এই দাঁড় বেয়ে? এই পরিচিত জলাধারের একই প্রবাহ তোমাকে কখনো টুটি টিপে ধরে বলে ওঠেনি যে এর বাইরেও সমাজ আছে… এর বাইরেও পথ আছে… জল যেমন তোমার আপন, আকাশ টাও তোমার হতে পারতো, ওই ঘাসের মেঠো পথ টাও তোমাকে চায়, বা, ধরো ওই আকাশ ছোঁয়া দালান টা তোমারই অপেক্ষায় আজও পূর্ণতা পায় নি… বলো না মাঝি, বলেনি তোমাকে?”
(এক, অপূর্ণ হৃদয় ভাঙা হাসি সম্বল করে মাঝি আমার দিকে তাকিয়ে বলে,)
“ছোট বাবু, তোমার এ উত্তর বড় জটিল গো, ওই… ওই ঠিক তোমার মত বয়সে যখন প্রথম এ ঘাটের হাল ধরলাম, তখন জানো তো, খুব মনে হতো এই কথা গুলো, কান পাতলেই শুনতে পেতাম, জলের ঢেউগুলোর আমার এই নতুন হাত একেবারেই পছন্দ না … আমিও চাইতাম এক ছুটে সব ছেড়ে চলে যেতে…কিন্তু, কিন্তু…”
(মাঝির চোখ যেনো আর বাঁধ মানছে না, চোখের পাতা তার দাঁড়ের কাজে যেনো এই ব্যর্থ হল বলে…)
আমি বললাম,“ তা তুমি গেলে না কেনো? এ তোমার ভারি অন্যায়, মনের কথা শুনলে না, দেখো তো আজও কেমন গুমরে আছো, যেনো তুমি বেঁচেও ঠিক বেঁচে নেই…”
(মাঝির চোখ এবার সত্যি ভাসছে…)
সে বলে,“ বাবু কিছু সময় নিজের ইচ্ছার দাম এই জলের স্রোতের মতই ভাসিয়ে দিতে হয় গো…”
আমি বললাম,“ তা তোমার কি লাভ হল তাতে? সেই তো আজ কেমন যেনো দিন কাটছে… যেনো এই জল জমে গেছে তোমার মনেও…”
মাঝি মৃদু হেসে বলে, “বাবু, এই জল কখনো স্বীকার করবে না গো, কিন্তু আমি তো জানি, আমাকে ছাড়া এ নদী প্রাণহীন হয়ে যাবে, সে ছাড়তে চায় না, তবু আমাকেই বুঝতে হয় গো, সে যে কখনোই তার চাহিদা আমাকে ছাড়া সবার সামনে বলবে না…এতো শুধুই তার আর আমার কথা গো…”
আমি শেষে বলি, “তাহলে, মাঝি তুমি এমনই থাকবে চিরকাল ?”
সে ক্লান্ত, এক অবসন্ন হাসি হেসে বলে, বাবু, “এতেও এক ভালোবাসা আছে গো, কিন্তু তা প্রকাশিত হয় শুধু আমারই সামনে, এই নদী আমার বড় লাজুক গো, সে যে সবার সামনে সব বলে না, আমিও যদি তাকে না বুঝে চলে যাই, তার যে এই উচ্ছ্বাস শেষ হয়ে যাবে, তা যে আমি সহ্য করতে পারি না…”
(অনেকক্ষণ কোনো কথা নেই…)
অজানা কারণে, হঠাৎ দেখি, আমারও গাল বেয়ে জল, আমিও কান্নায় ভেঙে পড়ছি…
সত্যই , অপ্রকাশিত, ইচ্ছা বিসর্জনের উঠোনে পাশে থাকাও এক সত্য ভালোবাসা, এক বিশ্বাসের ভালোবাসা, এক মান ভাঙানোর ভালোবাসা, এক সাথে থাকার ভালোবাসা …এর জন্যে তো সত্যিই অনেকটা পথ হাঁটা যায়…
0 মন্তব্যসমূহ