ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

এক অজানা বিপ্লবী জীবন, উল্লাসকর দত্ত - সাগ্নিক বন্দ্যোপাধ্যায়


ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পেয়েছে আজ থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগে। এই স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য আজকের প্রজন্ম লাভ করেছে হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামীর আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে অখন্ড বাংলা বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পন্থা ছিল সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তি ছিলেন নির্ভীক, মৃত্যুঞ্জয় ও কষ্টসহিষ্ণু। যাঁরা নিজেদের পরিবার ছেড়ে, নিজেদের সুখের জীবনের কথা না ভেবে সমাজের কথা এবং আমাদের মতো ভারতের আগামী প্রজন্ম যাতে স্বাধীন ভারতের জন্ম নিতে পারে তার জন্য ভারতবর্ষের শৃঙ্খলমোচনের মহান আত্মবলিদান যজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু আমরা এঁনাদের অনেকের নাম পর্যন্ত মনে রাখিনি বা তাদের জীবন সংগ্রাম জানতে আগ্রহী হইনি। আজ সেইরকম একজন যিনি বেশিরভাগ মানুষের কাছে অজ্ঞাত তাঁর জীবন কাহিনী সংক্ষেপে বর্ণনা করার চেষ্টা করব। তিনি হলেন মহান বিপ্লবী শ্রী উল্লাসকর দত্ত।

 

"শিকল দেবীর ওই যে পূজা বেদী 

চিরকাল কি রইবে খাড়া? 

পাগলামি, তুই আয়রে দুয়ার ভেদি! 

ঝড়ের মাতন! বিজয় কেতন নেড়ে 

অট্টহাস্যে আকাশ খানা ফেড়ে 

ভোলানাথের ঝোলাঝুলি ঝেড়ে 

ভুলগুলো সব আনলে বাছা বাছা! 

আয় প্রমদ, আয়রে বাছা বাছা!"

 

বিশ্বের ভাগ্যবিধাতার আহ্বানে ভারতের শিকল দেবীর পূজাবেদী ভাঙার জন্য ঝড়ের মতো ১৮৮৫ সালের ১৬ই এপ্রিল ভারতমায়ের কোলে আবির্ভূত হলেন আজন্ম বিপ্লবী উল্লাস কর দত্ত। সিটি কলেজের ছাত্র থাকাকালীন স্টার থিয়েটার হলে বিপিনচন্দ্র পালের বক্তৃতা শুনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি আকৃষ্ট হন। বক্তৃতায় বিপিনচন্দ্র পাল কংগ্রেসের আবেদন নিবেদন নীতি স্বাধীনতা লাভের যে একমাত্র পন্থা নয়, প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হন। তিনি বক্তৃতায় বললেন, “আমরা কেবল চাহি ক্রন্দনের রোলে সুকোমল-কম্বল-লালিত ইংরাজের সুখ - নিদ্রার ব্যাঘাত জন্মাইয়া আমাদিগের উদ্দেশ্য সকল করিয়া লইব।" এরপর উল্লাস কর দত্ত রাজনীতি, ধর্মনীতি, সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে শুরু করেন। তিনি মিনার্ভা থিয়েটার হলে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী সমাজ নামক বক্তৃতা শুনতে যান। কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশ হলে ঢুকতে বাধা দিলে দর্শকদের সাথে পুলিশের খণ্ড যুদ্ধ বেঁধে যায়। এই পরিস্থিতির শিকার হন উল্লাস কর দত্ত এবং তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর আক্রমণের মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় ও অকথ্য অত্যাচারও চালানো হয়। এই সময়ে খবর পেয়ে বিপিনচন্দ্র পাল ও ডাক্তার ডি. এন. মৈত্র দুজনে এসে তাঁকে জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। উল্লাস কর দত্ত কারাজীবনী গ্রন্থে লিখছেন, ".... সেই রাত্রে যাহাতে আমাকে হাজতে থাকিয়া ভুগিতে না হয় তজ্জন্য ডাক্তার মৈত্র স্বয়ং জামিন হইয়া আমাকে ছাড়াইয়া লইলেন। সেই রাত্রে আর শিবপুর না গিয়া ডাক্তার সুন্দরীমোহন দাস মহাশয়ের বাসায় আসিয়া রহিলাম এবং সেখানে আসিয়া দেখা গেল যে, পিঠে রুলের গুঁতার দাগগুলি কালো হইয়া ফুলিয়া উঠিয়াছে।" এই ঘটনা তাঁকে পুলিশের ব্যবহার তথা গর্ভমেন্টের কার্যকলাপ সম্বন্ধে সম্যক ধারণা দিল। এরপর তিনি বরিশাল প্রাদেশিক সমিতির অধিবেশনে যান। কিন্তু সেখানে পুলিশের অকথ্য দমনপীড়নের হাত থেকে চিত্তরঞ্জন দাস সহ প্রথম শ্রেণীর নেতারাও রক্ষা পাননি। ফলত তার শিকারও হলেন উল্লাস কর দত্ত। এইসব কর্মকাণ্ডে উল্লাস কর দত্তের মধ্যে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য সংকল্প দৃঢ় হতে থাকে।

উল্লাস করের সংকল্পকে পরিণতরূপ দিতে তৎকালীন সময়ে সদ্য প্রবর্তিত "যুগান্তর পত্রিকা" বিশেষ ভূমিকা নেয়। তিনি বলেছেন, "স্বদেশি আন্দোলন প্রবর্তিত হইবার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্তও কাব্য, সাহিত্য অথবা চিন্তাশীল-গবেষণাপূর্ণ রচনা কিছুরই আস্বাদন পাই নাই। এই আন্দোলনেই যেন প্রাণের সকল রুদ্ধদ্বার উন্মুক্ত হইয়া গেল এবং টমাস কারলাইলের Heroes and Hero worship, ম্যাসিনির Faith & Future, বঙ্কিমচন্দ্রের অনুশীলন ও ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি কয়েকখানি বই পড়িয়া পড়ার ভিতরেও যে একটা প্রাণ - মাতানো জিনিস কিছু আছে তাহা এই প্রথম অনুভব করিলাম।" এই পর্বের স্বদেশী আন্দোলন ধীরে ধীরে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।

উল্লাস কর দত্ত উপলব্ধি করলেন শিবপুরে থেকে বিস্ফোরক দ্রব্য প্রস্তুত বিষয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার উপযুক্ত সুযোগ আছে। লাইব্রেরির উপযুক্ত বইয়ের সুবিধা এবং পরীক্ষাগারের রাসায়নিক দ্রব্যের সহজলভ্যতা তাঁর আশাপূরণে সক্ষম। তিনি মনে করলেন যে, দুই একটা এইরকম পরীক্ষা সফল করতে পারলেই অনায়াসে গুপ্ত দলের সভ্য হতে পারবেন।

  বারীণ ঘোষের "যুগান্তর দলে" উল্লাস কর যুক্ত হলেন। মুরারি পুকুরের বাগানবাড়িতে গোপন আড্ডা এবং বোমা তৈরির কাজ চলতে থাকলো। বিপ্লবী হেমচন্দ্র দাস কানুনগো বিদেশ থেকে বোমা তৈরীর পদ্ধতি শিখে এসে ওই বাগানবাড়িতে প্রশিক্ষণ দিতেন। উল্লাসকর বোমা তৈরীর ক্ষেত্রে তাঁর রসায়নের অধিত বিদ্যা কাজে লাগান। এরপর তাঁর ওপর সম্পূর্ণ বোমা তৈরীর ভার ন্যস্ত হলো। বোমা তৈরির পর তার শক্তি পরীক্ষা করার জন্য উল্লাস কর, প্রফুল্ল চক্রবর্তী সহ বেশ কয়েকজন বিপ্লবী দেওঘরে যান। সেখানে পাহাড়ের উপর থেকে বোমা ছুঁড়ে পরীক্ষা করার সময়ে বিপ্লবী প্রফুল্ল চক্রবর্তীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয় এবং উল্লাস কর দত্ত গুরুতরভাবে আহত হন। তাঁকে গোপনে কলকাতা এনে চিকিৎসা করা হয়। এরপর উল্লাসকরের তৈরি বোমা দিয়ে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীকে মুজাফফরপুরে প্রেরণ করা হয় অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যার জন্য। কিন্তু কিংসফোর্ডের বদলে মৃত্যু হয় কেনেডি দম্পতির। এরপর সারা বাংলা জুড়ে তল্লাশি শুরু হয়। এই অভিযানের নেতৃত্ব দেন পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট ক্রেগান এবং তার বিখ্যাত গোয়েন্দা বিনোদ কুমার গুপ্ত। তারা ১৯০৮ সালের ২রা মে বিভিন্ন জায়গার সাথে মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে তল্লাশি করে বোমা তৈরীর সরঞ্জাম, কার্তুজ, পিস্তল প্রভৃতি বাজেয়াপ্ত করে এবং বাগানবাড়ি থেকে ১৪ জন বিপ্লবীকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন উল্লাস কর দত্ত।

বারীন ঘোষ, উল্লাস কর দত্ত প্রমুখ বিপ্লবীদের "চল্লিশ ডিগ্রি" অর্থাৎ চল্লিশটি পর পর ছোট ছোট অস্বাস্থ্যকর কুঠুরিতে রাখা হলো। এরপর শুনানি চলতে লাগলো। শুনানি চলার সময় ব্রিটিশ পুলিশের সামনে স্বীকারোক্তি করা বৈধ না অবৈধ এই নিয়ে বিপ্লবীদের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হল। তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট বার্লির কাছে শ্রী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, শ্রী উল্লাস কর দত্ত, শ্রী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রী হৃষীকেশ স্বীকারোক্তি করেন। কিন্তু রাজসাক্ষী হলেন না। এই স্বীকারোক্তির বিরোধী ছিলেন হেমচন্দ্র কানুনগো, সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ। এবার প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, উল্লাস কর দত্ত সব বিপ্লবীরা স্বীকারোক্তি করলেন মানে ব্রিটিশ শক্তির কাছে তাঁরা মাথানত করলেন? নাকি এই স্বীকারোক্তির দরুণ তাঁরা কিছু সুযোগ সুবিধা পেল? এই স্বীকারোক্তি করার মধ্য দিয়ে তাঁরা বন্দীত্ব থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন যাতে বিপ্লবী কার্যকলাপ নতুন করে শুরু করতে পারেন। কারণ, তখন সারা বাংলার প্রতিটি বিপ্লবী দলের সদস্যরা জেলে বন্দী। তাঁদের মৃত্যু ভয় ছিল না, তাঁদের কোন ব্যক্তি স্বার্থ ছিল না। যুদ্ধনীতিতে শত্রুপক্ষের কাছে কখনো কখনো এক পা পিছিয়ে পড়ে দু পা এগিয়ে আক্রমণ করার কৌশল বহু যুগ ধরে চলে আসছে, এতে কোন অন্যায় নেই। আর এই স্বীকারোক্তির দরুণ তাঁরা সুযোগ পাওয়া তো দূরের কথা আলিপুর কোর্ট উল্লাস কর দত্ত ও বারীন ঘোষের ফাঁসির হুকুম দেয়। শোনা যায় তখন উল্লাস কর হেঁসে উঠেছিলেন এবং আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েই দৃপ্ত কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন, "সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে"। এরপর এই ফাঁসির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা হয়। যদিও উল্লাস করের তাতে সায় ছিলো না। কারণ, তিনি বলেছেন, "আপিল আবার কি করিব, যার কোর্টই মানি না তার আবার আপিলই বা কী আর বিচারই বা কী?" যদিও তাঁকে অনেক বুঝিয়ে আপিল করা হয়। বারিন ঘোষ লিখছেন, "আমি আর উল্লাস দা তখন গলায় দড়ি দিয়া ভবপারে যাইবার যাত্রী, মাথার উপর মিহী সুতায় বাঁধা খড়্গের মতো ফাঁসির হুকুম ঝুলিতেছে। হাইকোর্টে আপিল চলিতেছে, যদি জজ সাহেব সুবিচার করেন তবে আন্দামান জীয়ন্তে কবরস্থ হইতে যাইব, আর অবিচার করেন তো দূর্গা বলিয়া ঝুলিয়া পড়িব।" এরপর ১৯০৯ সালের ১১ই ডিসেম্বর তাঁদের ফাঁসির বদলে দ্বীপান্তর হল এবং "মহারাজা" নামক জাহাজে করে আন্দামানে প্রেরণ করা হলো।

কুখ্যাত সেলুলার জেল ছিল বিপ্লবীদের দ্বীপান্তরের স্থান। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাঁদের রাখা হতো। পালানোর কোন উপায় ছিল না। কারণ, চারিদিক সমুদ্রে ঘেরা। সারাদিন বিভিন্ন কষ্টসাধ্য কাজ যেমন, ঘানি থেকে তেল তৈরি, রাস্তা তৈরি, ইঁট তৈরি প্রভৃতি করানো হতো। কাজের ভুল হলেই চলত অকথ্য অত্যাচার। আন্দামান জেল সম্পর্কে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী তাঁর জেলে ত্রিশ বছর গ্রন্থে লিখেছেন, "আন্দামান জেলের খাওয়া দেশের জেল হইতে অনেক খারাপ। সস্তা রেঙ্গুন আতপ চাউলের ভাত, সারা বৎসর দুই বেলা অড়হর ডাল এবং অখাদ্য ঘাস পাতার তরকারি- ইহাই ছিল নিত্যকার খাদ্য। রাত্রে জেলে কোনো আলোর ব্যবস্থা ছিল না।"

উল্লাস কর দত্ত আন্দামানের এই কষ্টসাধ্য কাজ করতে অস্বীকার করেন। এর জন্য তাঁর এক সপ্তাহের জন্য হাতকড়ির হুকুম হয়। কারাজীবনী গ্রন্থে তিনি লিখছেন, "....... মাথার সমান উঁচু দেয়ালের গায়ে কতকগুলি হুক বসান আছে, তাহাতে এক একটি করিয়া হাতকড়ি রহিয়াছে, সেই হাতকড়িতে হাত পরাইয়া দেয়ালের দিকে মুখ করিয়া সকাল ছয়টা হইতে বিকাল চারিটা পর্যন্ত দাঁড় করিয়া রাখা হয়, কেবল দশটার সময় একবার আহারের জন্য খুলিয়া দেওয়া হয়। আমাকে হাতকড়িতে টাঙ্গাইয়া দেওয়ার প্রথম দিনই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কেন জানিনা জ্বর বোধ করিতে লাগিলাম এবং দেখিতে দেখিতে জ্বর অত্যন্ত বৃদ্ধি পাইয়া গেল।"

  কারাকাহিনীতে উল্লাস কর দত্ত আরও লিখেছেন, "নারিকেল ও তিল হইতে তেল নিষ্কাশনের জন্য ভারতে যেভাবে ঘানির সহিত বলদ জোতা হয়, আমাকেও সেই ভাবে তৈল নিষ্কাশনের যন্ত্রের সহিত জোয়াল দিয়া জোতা হইয়াছিল। ভারতে ঘানি ব্যবহার করার জন্য বলদ ব্যবহার করা হয় এবং তাহারাও সরিষা হইতে দিনে ষোলো পাউন্ডের অধিক তৈল বাহির করিতে পারে না।" এইভাবে উল্লাস কর দত্তের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালানো হয়। যেসব বিপ্লবীদের আন্দামানের সেলুলার জেলে রাখা হয় তাদের উল্লাস কর দত্তের ভাষায় "D Ticket অর্থাৎ Dangerous Criminals আখ্যা দেওয়া হইত।" সাধারণ Dangerous Criminal-দের এক বছর জেলে থাকার পর ছেড়ে দেওয়া হতো। কিন্তু বিপ্লবীদের কারাবাসের কোন সময়সীমা ছিল না। এই অত্যাচারে উল্লাস করের শরীরের অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে। তাঁকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এনে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়। তিনি বলছেন, "একবার ব্যাটারি চার্জ করা হয় তাহাও স্মরণ আছে। কেবল স্মরণ আছে কেন, এমনি প্রবল বেগে তড়িত চালনা করা হয় যে, আমার তখন বোধ হইতে থাকে যেন আমার সমস্ত শরীর বিদীর্ণ করিয়া, সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলীতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিয়া ঐ তড়িৎ নির্গত হইতে থাকে।" উল্লাস করের উপর এতটাই অত্যাচার করা হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় তৎকালীণ ভারতের সব জেলের প্রধান অর্থাৎ ডিরেক্টর জেনারেল আন্দামানে পরিদর্শন করতে এসে উল্লাস করকে দেখে বলেন, "তুমি এত রোগা হইয়া গিয়াছ এবং ওজনে এত কম হইয়া গিয়াছ, কিরূপে বিশ বৎসর কাটাইবে ? তোমাকে কোনও ভারতীয় জেলে স্থানান্তরিত করা উচিত, নতুবা এখানে থাকিলে নিশ্চয় মারা যাইবে; তোমাকে আর বিশ বৎসর খাটিতে হইবে না।" এরপর তাঁকে মাদ্রাজে পাগলা গারদে প্রেরণ করা হলো। সেখানেও তিনি বন্দী জীবন কাটালেও নিজের মনের মত কাজ করতে পারতেন। তার প্রিয় কাজ ছিল তালপাতা দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করা এবং এর সাথে তিনি একটি গানও রচনা করে ফেলেছিলেন।‌ তা হল,

 

                     "আমার তালের পাতা, ও আমার তালের পাতা !

                   তোমার পাতায় চটি বুনি, তোমার পাতায় চাটাই বুনি

                   তোমার পাতায় পাখা বুনি, টুপি বুনি খলতে বুনি,

                                      তালের পাতা।”

 

১৯২০ সালে উল্লাসকর দত্ত এগারো বছর পরে কারাবাস থেকে মুক্তি পান। তারপর শারীরিক দুর্বলতার কারণে সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসেন। কিন্তু ইংরেজ সরকার ফের তাঁকে গ্রেপ্তার করে ১৯৩১ সালে। এইবারে বিনা বিচারে তাঁকে ১৮ মাস কারাগারে রেখে দেওয়া হয়। অবশেষে তিনি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে নিজের জন্মভূমি কালিকচ্ছ গ্রামে ফিরে আসেন।

  ১৯৩১ সাল। মেদিনীপুর শহর থেকে মাত্র ছয় মাইল দূরে হিজলি বন্দিশালায় নিরস্ত্র আটক বন্দির উপর বেপরাগুলি চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা ও আহত করে ব্রিটিশ সরকার। সমগ্র বাংলার সঙ্গে মেদিনীপুর বাসিরা ও ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হয়। মেদিনীপুর শহরে চন্দ্রাকর পুকুরের পাড়ে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। পুলিশের সর্বত্র নজরদারি এবং টহলদারি চলতে থাকে। উল্লাস কর দত্ত সেদিন মেদিনীপুর শহরে হেমচন্দ্র কানুনগো- র বাড়িতে আসেন। তাঁদের দুজনেরই ভালো বয়স হয়েছে। তাই অপেক্ষাকৃত কম বয়সের বিপ্লবীরা তাঁদের ওই সভায় যেতে বারণ করেন। কারণ, ব্রিটিশ পুলিশের অকথ্যভাবে মারধর ও লাঠি চালানোর সম্ভাবনা ছিল। তাই দুজনেই যাবেন না বলে অন্য বিপ্লবীদের কথা দিলেও সভাস্থলে গিয়ে দুই বৃদ্ধই উপস্থিত হন। ফলত, বোঝা যাচ্ছে উল্লাস কর দত্ত দীর্ঘ কারাবাসের পর শারীরিক অসুস্থতার দরুন প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে গেলেও, তাঁর মধ্যেকার বিপ্লবী সত্ত্বা শেষ দিন পর্যন্ত বজায় ছিল। স্বাধীন ভারতে আমাদের চোখের অন্তরালে এই বিপ্লবী ব্যক্তির দেহাবসান ঘটে।‌ কিন্তু আমরা এতটাই আত্মবিস্তৃত জাতি যে এঁনাদের অবদানকে ভুলে গেছি। তাই আসুন স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে ভারতের সমস্ত বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করি এবং সকল স্তরের মানুষের মধ্যে তাদের জীবনী তুলে ধরি। এক্ষেত্রে যুবসমাজ ও নারী সমাজের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

 

তথ্যসূত্র:-
১) কারাজীবনী, উল্লাস কর দত্ত
২) দ্বীপান্তরের কথা (খন্ড ১), হেমন্ত কুমার সরকার
৩) বাংলার বিপ্লব সাধনা, শ্রী পুলকেশ দে সরকার
৪) নির্বাসিতের আত্মকথা, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
৫)sobbanglay.com, উল্লাস কর দত্ত (প্রবন্ধ)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ