এই
বছরে মার্চের শেষের দিকে যে-মুহূর্তে কোভিড তার কড়াল গ্রাস থেকে আমজনতাকে একটু রেহায়
দিয়েছে তখন দেখছিলাম অনেকেই যে যেখানে পারছিল ঘুরতে বেরিয়ে পড়ছিল। সেই স্রোতে আমরাও
গা ভাসিয়ে দিলাম। গোটা পরিবার মানে আমি আর মা-বাবা মিলে ঠিক করলাম গ্যাংটক যাওয়া
যেতে পারে। এই জায়গায় আগে অনেকবার প্ল্যান করার পর শেষে যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি।
উত্তেজনার
বাষ্পে ভর করে ট্রেনে সিট না পেয়ে যাওয়ার সময় বাসে করে প্রথমে গেলাম শিলিগুড়ি সেখান
থেকে রাজ্যের স্টেট-বাসে চেপে রওনা দিলাম গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে। শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটকের
জার্নিটা বেশ অনেকটা, প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা লেগে যায়। আবার এখন ওখানে রাস্তা বেশ
খারাপ, এছাড়া রেলের কাজ চলছে সেকারণে হয়রানি একটু বাড়ে বইকি। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে
আর কাউকে সঙ্গী না পান একজনকে পাবেনই, সে হচ্ছে তিস্তা নদী।
আমরা
শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে এসে সেবক ব্রিজে না উঠে তাকে পাশ কাটিয়ে একটা রাস্তা ধরলাম। কখনো
তিস্তা বামে আবার কখনো ডানে আবার কখনো রাস্তার দু'পাশে বড়-বড় গাছের সারি–এইসবকে অতিক্রম
করে তিস্তা বাজার ছাড়িয়ে অনেক উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে গ্যাংটকের গেটওয়ে রংপো-তে পৌঁছলাম।
তারপরও বেশ কিছুটা রাস্তা যাওয়ার পর গিয়ে পৌঁছলাম সিকিম-রাজধানীতে।
সত্যজিৎ
রায় 'গ্যাংটক গন্ডগোল'-এ লিখেছিলেন গ্যাংটক আর দার্জিলিঙের মধ্যে পার্থক্য হল গ্যাংটক
অনেক ফাঁকা, শান্ত, লোক-সমাগম কম কিন্তু আজকের গ্যাংটক দেখলে মনে হবে এ যেন উলটপুরাণ।
কলকাতার মত ট্রাফিক যন্ত্রণা ওখানে গিয়েও বেশ পেতে হল। থরে-থরে গাড়ি, বাস রাস্তায়
দাঁড়িয়ে আছে; মনে হচ্ছে ইচ্ছে হলে তারা একটু-একটু করে এগোচ্ছে, তাদের শরীরে চলার
শক্তি ও ইচ্ছে দু'য়ের কোনটা নেই। এইভাবে যাবার পর আমরা হোটেলে উঠলাম।
একটা
দিন গ্যাংটকে কাটানোর পর পরের দিন একটা গাড়ি ভাড়া করে আমরা নর্থ সিকিম হাইওয়ে ধরে
লাচেনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বেশ অনেকটা রাস্তা। পথে কত নাম-না-জানা জলপ্রপাত পড়ল।
কোনোটাতে গাড়ি থামিয়ে একটু দাঁড়ালাম আবার কোনটা পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম। দুপুরের
খাওয়া-দাওয়া রাস্তাতেই করতে হল। অবশেষে ওখানকার একটা হোটেলে রাত্রিযাপনের জন্য ওঠা
হল।
পরদিন
বেশ ভোরে বরফে হাঁটার জন্য গামবুট পরে বেরিয়ে পড়া হল। গাড়ি প্রথমে থামল পৃথিবীর
সর্বোচ্চ ধোসা পয়েন্টে। ধোসা সহযোগে প্রাতরাশ করার পর খাঁড়া পথ পেরিয়ে যাওয়া হল
কালা পাথ্থরে। চারদিকে সফেদ-মিহি বরফ ছড়িয়ে থাকা কালো পাথরগুলোর ওপর নিজেদের আধিপত্য
স্থাপন করে রয়েছে। ওখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির, বরফকেলির পর গুরুদংমার লেকের দিকে যাত্রা
শুরু করলাম। বরফের আধিক্য বেশি থাকায় আমাদের গাড়ি গুরুদংমার লেক অব্দি গাড়ি পৌঁছল
না। খানিকটা আগে থেমে গেল কিন্তু বাতাসে অক্সিজেনের ঘনত্ব কম থাকায় আর কনকনে হিমশীতল
হাওয়া দেওয়ার কারণে লেক অব্দি পৌঁছতে পারলাম না। আক্ষেপের একটা সুর মনে এখনও রয়ে
গেছে। ভারতের উচ্চতম লেক চাক্ষুষ করতে পারলাম না এইবার। পরে যদি আবার সুযোগ হয় ওখানে
যাওয়ার ইচ্ছে রইল।
পরের
দিন চললাম ইয়ামথাং ভ্যালিতে। যাবার পথে এখানে রাস্তার পাশে পাথরের গায়ে গজিয়ে উঠেছে
স্নিগ্ধ-গোলাপি রডোডেনড্রনের থোকা। ইয়ামথাং ভ্যালির শ্লথ, নিঝুম পরিবেশ ও নৈসর্গিক
সৌন্দর্য ধীরে-ধীরে যেন মোহগ্রস্ত করে ফেলছিল। প্রকৃতি এখানে যে এত সুন্দর সেজেগুজে
থাকে সেটা হয়তো না গেলে জানতেই পারতাম না। এরই মধ্যে কাছের একটা গুমটি দোকানে মোমো
খেলাম এবং তার স্বাদও যেন এই প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিপূরক। উপত্যকায়, পাশের নদীর কূলে
বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে, ফোটো সেশন করে আমরা এবার বাড়ি ফেরার জন্য গ্যাংটকে ফিরে
গেলাম। ফেরার পথে রাস্তায় একটা মনোমুগ্ধকর ঝর্না পড়ল। জানতে পারলাম এটার নাম অমিতাভ
বচ্চন ফলস। নামটা শুনে প্রথমে বেশ চমকিত হয়েছিলাম। পরে জানলাম এটার সুউচ্চতার কারণে
অমিতাভ বচ্চনের নামে নামাঙ্কিত। রাতে এমজি
মার্গ অর্থাৎ গ্যাংটকের ম্যালে একটু ঘুরতে গেলাম। সেখানে কিছু জিনিসপত্র কেনা হল। তখন
আমাদের সঙ্গী ছিল গুঁড়ো বৃষ্টি, সে তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু আমাদের
ভেজাচ্ছিল না।
আমাদের
ঘোরার পর্ব প্রায় অন্তিম লগ্নে এসে উপস্থিত। পরের দিন সকালে আমরা সিকিম স্টেট-বাসে
করে শিলিগুড়ি পৌঁছলাম এবং সেখান থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। যাওয়ার সময় বাসে গেলেও
ফেরার সময় ট্রেনে ফিরলাম, কারণ শেষ মুহূর্তে কিছু কনফার্মড সিট পাওয়া গেছিল। রাতের
দার্জিলিং মেলে মনের ভিতর অনেক স্মৃতির বরফকুচি, কত নাম-না-জানা পাহাড়, খরস্রোতা নদী,
জলপ্রপাত, গাছেদের প্রতিচ্ছবি, একরাশ ভালোলাগা, কিছু আক্ষেপ এবং সর্বোপরি, পুনরায়
আসার ইচ্ছে নিয়ে পৌঁছে গেলাম শিয়ালদা স্টেশন। সেখান থেকে বাড়ি। এইভাবে শেষ হল আমাদের
এবারের হঠাৎ-ঠিক-হওয়া গ্যাংটক ভ্রমণ।
0 মন্তব্যসমূহ