- সিনেমা: অনওয়ার্ড (২০২০)
- পরিচালক: ডন স্ক্যানলন
- গোত্র: অ্যানিমেশন, অ্যাডভেঞ্চার, ফ্যামিলি ড্রামা, ফ্যান্টাসি।
- কন্ঠ-শিল্পী: 'স্পাইডারম্যান'-খ্যাত টম হল্যান্ড, 'গার্জিয়ান অব দ্যা গ্যালাক্সি'-খ্যাত ক্রিস্ প্র্যাট, অক্টাভিয়া স্পেন্সার প্রমুখ।
'অনওয়ার্ড' ছবির গল্পটা ঠিক এই পৃথিবীর নয়, এই গল্প আসলে এক বিকল্প পৃথিবীর গল্প, কমিক্সের ভাষায় বললে বলা যেতে পারে এ এক 'অল্টারনেট আর্থ'- এই পৃথিবীতে থাকে, কিছু অদ্ভুত মিথিক্যাল ক্রিয়েচার। আবার ধরুন গল্পের মূল চরিত্র যারা, তারা হল দুই এলফ্-ভাই (Elf) । এলফ্দের এমনিতে মানুষের মতন দেখতে বটে, শুধু কান দুটো ভারী অদ্ভুত, অনেকটা বড়ো। এদের মধ্যে একজন তাদের অতীত ইতিহাসের গরিমায়, নানান বীরত্বপূর্ণ কীর্তি ও প্রচলিত যাদুকাহিনীর মধ্যে ডুবে থাকে, যেগুলি সবই তাদের জীবন থেকে একে একে হারিয়ে গেছে। এই ছেলেটিই হল গল্পের মূল চরিত্রদুটির অন্যতম- বড়ো এলফ্-ভাই, যার নাম 'বার্লি লাইটফুট্'। সে ছেলেবেলায় তার বাবাকে হারিয়েছিল, যখন তার বাবা ছিল অত্যন্ত অসুস্থ এবং শয্যাশায়ী মানুষটার মুখে ছিল অসংখ্য নল পরানো। সেই অবস্থায় বাবাকে দেখে ভয়ে সে কাছে পর্যন্ত ঘেঁসতে পারেনি। ফলে, তার পক্ষে শেষ বিদায় জানানো হয়নি বাবাকে, রয়ে গেছে আক্ষেপ আর গ্লানি। বাবার মৃত্যুর পর সে প্রতিজ্ঞা করে, আর কোনোদিন, কোনো কিছুতেই সে ভয় পাবে না। এর ফলে তার জীবনটা হয়ে পড়ে অত্যন্ত অগোছালো আর বেপরোয়া। উল্টো দিকে রয়েছে তার ছোটো ভাই, যার নাম ইয়ান লাইটফুট্। সে কোনোদিন তার বাবাকে দেখেনি। তার জন্মের আগেই ভদ্রলোকের মৃত্যু হয়। সেই আফসোস যেমন একদিকে তার রয়েছে, অন্যদিকে সে এমন শান্তশিষ্ট আর মুখচোরা যে তার কোনো বন্ধু-বান্ধবও নেই। ইয়ান এখনও ইস্কুলে পড়ে। ওদের দুনিয়াটা ভারি মজার, কারণ ওদের ঘরের মধ্যেই থাকে মুখ থেকে আগুন বের করা একটা বাচ্চা ড্রাগন। সে যখনই মুখ থেকে আগুন বের করার চেষ্টা করে, বার্লি-ইয়ানদের মা শুধুমাত্র ড্রাগনটার মুখে জল স্প্রে করে দেন। ওদের এই দুনিয়াটা অবশ্যই অন্যান্য দুনিয়ার মতোই অনেকটা বদলে গেছে আগের তুলনায়, ক্রমাগত বদলাচ্ছে আর শিকড়টা ভুলছে সবাই। ওদের দুনিয়াতেও এখন বিমান আছে, রয়েছে দ্রুতগামী গাড়ি, রয়েছে ফায়ার ব্রিগেড ও অন্যান্য আধুনিক জিনিসপত্র। ফলে ম্যাজিক জানলেও সেগুলো দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই আর। তেমনি কারুর পিঠে যদি দুটো ডানা থাকে বা, কারুর যদি চারটি পা থাকে, তবুও তাদের কোনো কাজেই সেগুলো লাগে না। দরকার না থাকায় সেগুলোর কার্যকারিতা-ও কমে যাচ্ছে ক্রমশ। ফলে ক্রমশ ম্যাজিকের দুনিয়া থেকে সমস্ত ম্যাজিক উধাও হয়ে যাচ্ছে! বার্লি এই ম্যাজিকের বইপত্রের মধ্যে ডুবে থেকেও কিছুতেই কিছু শিখে উঠতে পারেনি। অবশ্য সমস্ত জাদুমন্ত্র বারবার অভ্যাসে মুখস্থ করে ফেলেছে সে। যদিও ইয়ানের এ-ব্যাপারে কোনো আগ্রহ-ই নেই। সে ভাবে, সে কিছুই পারে না।
গল্পটা এখান থেকে শুরু হলেও, হঠাৎ করেই ইয়ানের জন্মদিনের দিন সবকিছুই দুম করে বদলে যায়। ইয়ানের বাবা ওদের দুই ভাইয়ের জন্যে একটা উপহার রেখে গিয়েছিলেন। সেই উপহারটা ইয়ানের জন্মদিনে ইয়ানের মা ওদেরকে দেন। সেখানে একটা চিঠিতে লেখা ছিল একটা জাদুমন্ত্র এবং রাখা ছিল একটা জাদুদণ্ড। ছিল একটা অদ্ভুত সুন্দর ক্রিস্টাল। জাদুদন্ডের মাথায় সেই ক্রিস্টালটা রেখে, মন্ত্র পড়লেই ওর বাবাকে একদিনের জন্য ওরা পাবে, পরদিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত। কিন্তু গোল বাঁধলো যখন ইয়ান সফল হলেও ওর দাদার তাড়াহুড়োতে জাদু-টাই নষ্ট হয়ে গেল । ফলে ওদের বাবা-র ইমেজ কোমর অবধি তৈরি হলো বটে কিন্তু বাকিটা রয়ে গেল বেমালুম ফাঁকা। সেই বিদঘুটে ব্যাপারটা দেখতে ভারী মজার কারণ, একটা মানুষের শুধু কোমর থেকে পা অবধি আছে। মুখ না থাকায় কথা বলতে বা শুনতে পারে না যেমন, তেমনই চলতে-ফিরতে হোঁচট খায় চোখ না থাকায়। কিন্তু তাহলে ওরা এখন কী করবে?
এখান থেকেই শুরু হয় গল্পের অ্যাডভেঞ্চার, ইয়ান এবং বার্লির হাত ধরে। যত সময় এগোতে থাকে, ইয়ান ততই অনুভব করে যে, সে কিছু না জানলেও তার হাতে ওই জাদুদণ্ড এবং ম্যাজিক স্পেল ভালো কাজ করে। অর্থাৎ সে হলো গিয়ে যাকে বলে জন্ম-ম্যাজিশিয়ান, একেবারে স্বাভাবিক প্রতিভা তার- যেটা তার দাদা বার্লির হয়তো নেই! ফলে সূর্যাস্তের আগেই বাবার শরীরের বাকি অংশ জোড়া লাগাতে তারা যে অ্যাডভেঞ্চারে পাড়ি দেয়, সেই যাত্রাপথের সমস্ত বাধা অতিক্রম করতে ইয়ানের প্রতিভা আর বার্লির মুখস্থ হরেক নতুন নতুন যাদুবিদ্যা কাজে দেয়। আর এভাবেই একসময় ওরা একটা বিরাট বড়ো ও অভিশপ্ত পাথরের ড্রাগনকে হারিয়ে সূর্যাস্তের ঠিক আগের মুহূর্তে বাবার শরীর জোড়া লাগাতে সক্ষম হয়, অন্তত কিছুক্ষণের জন্য। আর এই পুরো যাত্রাপথে ইয়ান অনুভব করে যে, বাবার অবর্তমানে তার দাদা-ই তার বাবার জায়গাটা নিয়েছিল। বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি। তাই দাদার যে আক্ষেপ ছিল, ইয়ান সেটা মিটিয়ে দিতে সাহায্য করে। এবার বার্লি বাবাকে বিদায় জানাতে ভোলে না। সেই সঙ্গে সঙ্গে তাদের মা-ও ছেলেদের পিছু ধাওয়া করে একটা ছোটখাটো অ্যাডভেঞ্চার সেরে ফেলেন। আর এভাবেই একটা অ্যাডভেঞ্চারের গল্প হয়ে ওঠে ফ্যামিলি ড্রামা।
ছবিটা দেখতে দেখতে মনে হয়, এ যেন সুকুমার রায়ের কলমে হ্যারি পটারের গল্প। কিন্তু এই গল্পের একটা বিশেষত্বও রয়েছে। যে আশ্চর্য জায়গার গল্প আমরা গোটা সিনেমাজুড়ে দেখি, সেখানকার সমস্ত অদ্ভুত অদ্ভুত ও বিচিত্র প্রাণীরা সভ্যতার অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে তাদের শক্তি, যাদু-ক্ষমতা ও অতীত পরম্পরার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিল। আধুনিকতাকে তারা আপ্রাণ চেষ্টায় আপন করে নিলেও মোটেও সুখী ছিল না কেউ। ইয়ান এবং বার্লির আশ্চর্য অভিযান তাদের অনেককেই সে কথা মনে করিয়ে দেয়। এবং তারা প্রত্যেকেই অনুভব করে, শিকড়-টাকে ভুলে গেলে গাছ মরে যায়। আর তাই সিনেমার শেষে আমরা দেখি, ঘোড়ার মতন পিছনে দুই পা ওয়ালা, মোট চার পায়ের পুলিশ অফিসারটি, নিজের গাড়ি রেখে চারপায়ে সানন্দে, সজোরে দৌড়াতে শুরু করেন; যেন তিনি এতদিনে প্রাণের মুক্তি খুঁজে পেয়েছেন। ওদিকে ইয়ান-বার্লিরাও খুঁজে পায় তাদের জীবনের মানে! অসংখ্য মজা আর ছোট্ট ছোট্ট মানবিক অনুভূতির এই গল্প ছোটোদের ভালো না লেগে পারেনা। ইয়ান ও বার্লির তাদের অসম্পূর্ণ-কলেবর (কোমর-অবধি) বাবার সঙ্গে নাচ, বা ছবির শুরুর দিকে ক্যাসেট রেকর্ডার-এ বাবার গলার সাথে ইয়ানের মিছিমিছি বাক্যালাপের সঙ্গত এক্কেবারে মন ছুঁয়ে যায়। ছবিটা আরো ভালো হতে পারতো যদি ইয়ান-বার্লির মা, সৎ বাবা (পুলিস-অফিসার) ও ম্যান্টিকোর- এই তিনটি চরিত্রকে এতটা একমাত্রিক না করে, আরেকটু সম্পূর্ণতা দেওয়া যেত। আর সিনেমাতে একটা সত্যিকারের ভিলেন চরিত্র থাকলে আরো জমে যেত! তবুও নানান চমক আর উত্তেজনায় ঠাসা এই অ্যানিমেশন ছবিটি যে খুব সহজেই শিশুদের মন ভরাবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই - ছুটির দিনে পড়ুয়াদের আর কিই-বা চাই!
1 মন্তব্যসমূহ
আপনি সিনেমাটা দেখার আগ্রহ জাগিয়ে তুললেন।
উত্তরমুছুন