- বই – ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা
- লেখক – শিবরাম চক্রবর্তী
- প্রকাশনী – বিশ্বাস পাবলিশিং হাউস
- পৃষ্ঠা – ৪৭২
- প্রকাশকাল – জ্যৈষ্ঠ। ১৩৬৭
- প্রচ্ছদ ও অলংকরণ - পূর্ণেন্দু রায়
করোনাকালীন আবহে
যখন গৃহবন্দী জীবন হাঁপিয়ে ওঠে তখন মুক্ত বাতাসের খোঁজে মাঝে মাঝে হর্ষবর্ধন ও
গোবর্ধনের শরণাপন্ন হতে হয়। এক মুহূর্তে গুমোট কেটে বিনা পরিশ্রমে মুখে হাসি ফুটে
ওঠে। আপামর বাঙালি জীবনে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই দু’জন দরাজ হাতে নিজেদের অত্যন্ত
সহজ সরল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অনাবিল হাসির স্রোত বইয়ে দিয়েছেন। আগামী দিনেও তা
অব্যাহত থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। “হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধন”, দুই ভাই – এমন দুই চরিত্র যাঁদের তথাকথিত সরল
বা নিন্দুকদের চোখে মূর্খ ক্রিয়াকলাপে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই মুগ্ধ হয়ে যান। এই
দুই অমর চরিত্রের স্রষ্টা তথা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে হাস্যরসের সম্রাট রূপে যাঁর
নাম মনে আসে তিনি হলেন শিবরাম চক্রবর্তী।
কয়েক সপ্তাহ ধরে
হাসির রাজা শিবরাম চক্রবর্তীর বিভিন্ন লেখা পড়ছিলাম। সেই সূত্রেই হঠাৎ তাঁর রচিত
আত্মজীবনীমূলক লেখা "ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা" বইয়ের সন্ধান পেলাম। সারা
জীবন কৌতুক রচয়িতা শিবরাম জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কৌতুক রচনা করে গেছেন।
আত্মজীবনী লেখার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।নিজের জীবনকেও কৌতুকে মুড়ে পেশ
করেছেন। নিজেকে নিয়ে এবং নিজের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিকে নিয়েও যথারীতি কৌতুক
করতে এক বিন্দুও দ্বিধা বোধ করেন নি।
বইয়ের শুরুতেই
চিরাচরিতভাবে লিখেছেন -
“প্রায় লেখককেই নিজের কবর খুঁড়তে হয় - নিজের কলম দিয়ে। গায়কের মতন লেখকেরও ঠিক
সময়ে থামতে জানা চাই। সমে এসে যথাসময়ে না থামলেই বিষম, সবটাই বিষময় হয়ে দাঁড়ায়।“
রাজপরিবারে জন্ম
হয়েছিল তাঁর। কিন্তু রাজা বা রাজপুত্রের জীবন লাভ করেন নি। তাঁর পিতা-মাতা উভয়েই
সাধক মানসিকতার মানুষ ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যপাট ভেসে যেতে সময় লাগেনি। ঈশ্বর
সেবায় মগ্ন পিতা-মাতার ছেলের দিকে নজর দেওয়ার সময়ই ছিল না। পিতার দায়িত্ববোধহীনতা, মাতার উদাসীনতা
ছেলের জীবনেও লক্ষণীয় হয়ে রয়েছে। ছেলেও ছিলেন ভবঘুরে স্বভাবের। সমগ্র জীবন কেটেছে
বড়ই এলোমেলোভাবে। বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছেন, পথে ঘাটে ঘুরেছেন সহায় সম্বলহীন হয়ে, রাস্তায় হকারি
করেছেন, ধার করেছেন
জীবিকা নির্বাহের জন্য, ধার শোধ করতে পারেন নি,
স্বরাজ করে জেল বন্দী
হয়েছেন, দেশবন্ধু ও
নেতাজীর সংস্পর্শে এসেছেন, কাজী নজরুলের স্নেহধন্য হয়েছেন কিন্তু জীবনের
গতানুগতিকতায় আটকে থাকতে পারেন নি। গৃহী হয়েও সন্ন্যাসীর ন্যায় জীবন কাটিয়েছেন। বই
লিখে অর্থ উপার্জন করেছেন কিন্তু আপনজনকে বিশ্বাস করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কেমন
যেন একটা কোনও কিছুকেই পাত্তা না দেওয়ার মানসিকতা। জীবন যেভাবে এসেছে, তাকে সেই ভাবেই
বরণ করে নিয়েছেন। ভবিষ্যতের চিন্তায় মাথা খারাপ না করে বর্তমানের প্রতিটি
মুহূর্তকে সরসভাবে কাটানোর চেষ্টা করেছেন। মুক্তারাম স্ট্রীটের এক চিলতে ঘরে জীবন
কাটানোকে “মুক্তারামের সুক্তারাম” বলে ব্যঙ্গ করতেও পিছপা হন নি। একটা বিখ্যাত কথা
আছে। ‘যিনি নিজেকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে পারেন তিনি প্রকৃত হাস্যরসিক হন’। এই কথাটি
নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন শিবরাম চক্রবর্তী। নিজের নাম নিয়েও বিদ্রুপ
করেছেন – শিব্রাম চক্কোত্তি বলে। তাঁর তৈরি চরিত্রদের মধ্যে নিজের ছায়াও রেখে
গেছেন। চরিত্র প্রসঙ্গে বলেছেন – “এঁরা সবাই আমাদের আশেপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা
মানুষজন”। সেই আশেপাশের মানুষদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁদের নিয়ে গল্প
রচনা করেছেন। এই বইয়ে সেইসব প্রসঙ্গের উল্লেখও পাওয়া যায়। নিজের সমসাময়িক
সাহিত্যিকদের তুলনায় দৈন্যজীবন যাপন করেছেন। জীবনে প্রেম এসেছিল কিন্তু তাও ফাঁকি
দিয়ে চলে গেছে। যাকেই বিশ্বাস করেছেন সেই ঠকিয়েছে। জনপ্রিয় লেখকও তাঁকে দিয়ে কাজ
করিয়ে নিয়ে তাঁর পরিশ্রমের অর্থ দেননি। শিবরাম কষ্ট পেয়েছেন, কিন্তু অভিযোগ
করেননি। বহু ওঠাপড়ায় জীবনের প্রতিটি দিন কাটিয়েছেন, কিন্তু তাঁর ভাষায় হাসি দিয়ে উড়িয়েছেন। সমগ্র বই জুড়ে আছে তাঁর জীবনের অফুরন্ত ছোট ছোট
ঘটনা, যা বর্তমানে
অন্তর্জালের কল্যাণে বহুল প্রচারিত। নিজের বাউন্ডুলে জীবনের কথাকে অকপটে স্বীকার
করেছেন। মুক্তারাম স্ট্রীটের বাড়িতে নিজের শতজীর্ণ অবস্থার পরিচয় দিতেও থমকে যান
নি। জীবন যেমন তেমনি তাকে উদযাপন করো — এই মন্ত্রে দীক্ষিত শিবরাম চক্রবর্তীর
নিজের ভাষায় "ঝাড়া হাত পা" হয়ে জীবনকে কাটিয়েছেন। অন্যস্বাদের আত্মকথা
লিখেছেন, যা তাঁর লেখনীর
বিশেষ বৈশিষ্টই বহন করে।
এই সমস্ত জীবনের
উত্থান-পতনকে ঘিরেই তাঁর জীবনের সমস্ত ঘটনাকে তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন
আত্মজীবনীতে। তাঁর মতে – ঈশ্বরকে ভালোবেসে পৃথিবীকে আপন করে নিয়েই জীবন। তাই তাঁর
এই বইয়ের নাম "ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা"।
এই বই পাঠের
প্রতিক্রিয়া দেওয়ার স্পর্ধা আমার নেই। শুধু কিছু কথা বারংবার বলায় হয়ত একটু
একঘেয়েমি তৈরি হয়। কিন্তু ছোট ছোট ঘটনার উল্লেখ ও সরস বর্ণনা বই পড়ার গতি নষ্ট হতে
দেয় না। বই পড়া শেষ হলে মনের কোণে এক অন্তহীন দুঃখ বহনকারী মানুষের কথা গভীর
রেখাপাত করে যায়। এই বই এক অতীব দুঃখী মানুষের জীবনের উদযাপন, যিনি অন্য সমস্ত
মানুষের জীবনে আনন্দ ও হাস্যরসের বন্যা এনে দিয়েছিলেন। বাঙালীর জীবনে তাঁরই মতো
তাঁর আত্মজীবনীও বাংলা সাহিত্যের এক অমুল্য সম্পদ।
0 মন্তব্যসমূহ