বই - নারাচ
লেখিকা - দেবারতি মুখোপাধ্যায়
প্রকাশনী – পত্রভারতী
পৃষ্ঠাসংখ্যা – ৩০৪
প্রকাশকাল - অগাস্ট ২০২০
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ - রঞ্জন দত্ত
“নারাচ” দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের লেখা একটি
অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাস।' নারাচ ' হিন্দু পুরাণে বর্ণিত লৌহময় নিক্ষেপযোগ্য
অস্ত্র বিশেষ। এই অস্ত্রের উভয়
পার্শ্বই ছিল অত্যন্ত ধারাল। নরসমূহকে গ্রাস করে-এই অর্থে নারাচ। । কুরুক্ষেত্রের
যুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। উল্লেখ্য
এর অপর নাম “অস্ত্রসায়ক”।
টাইটানিক জাহাজডুবির
প্রায় পঁচিশ বছর আগের এক হৃদয়বিদারক জাহাজডুবির ঘটনা। ১৮৮৭ সালের ২৫ শে মে হাওড়ার চাঁদপাল
ঘাঁট থেকে স্যার জন লরেন্স নামক এক প্রকাণ্ড জাহাজ মহাসমারোহে রওনা দিয়েছিল পুরীর উদ্দেশ্যে।
সমুদ্রপথে বালেশ্বর হয়ে কটক। সেখানে থেকে পদব্রজে পুরী। এইভাবেই তখন যাত্রা হত নীলাচলধামে।
উনবিংশ
শতকের নবজাগরনের উন্মেষের প্রাক্কালে সামাজিক সংস্কারের সাথে সাথে সাহিত্য, গবেষণা
প্রভৃতির কাজও হয়েছে প্রচুর। সেই সমস্ত কাজের কাণ্ডারিদের কথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু
এই সমস্ত কাজে সহযোগিতা করা বহু সাধারণ মানুষের আত্মবলিদান অজানাই রয়ে গেছে। এই উপন্যাসে
একদিকে যেমন ডাঃ কাদম্বরী বসু গাঙ্গুলী, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী, তরুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,
উপেন্দ্রকিশোর, জগদীশচন্দ্র , বিদ্যাসাগর,
রামমোহন রায় প্রমুখের উল্লেখ আছে। তেমনিই উল্লেখ আছে সৌরেন্দ্র আর
ভুবনমণী, কৃষ্ণসুন্দর ও ব্রহ্মময়ী, মোতি বিবি ও চন্দ্রনাথের কাহিনী।
উপস্থিত
লখনৌয়ের নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ্। যিনি কলকাতার মেটিয়াবুরুজে গড়ে তুলেছিলেন একটুকরো লখনৌ। তার সেই আনন্দনগরী যেন কলকাতা শহরে থেকেও সম্পূর্ণ পৃথক এক নগর।বিলাসিতা, ভোগবিলাস,অর্থ অপচয়, হারেমের সাথে সাথে শিল্পচর্চাতেও যিনি
ইতিহাস রচনা করেছেন।
এই
বই এমন এক সময়কে তুলে ধরেছে, যে সময়ে একদিকে ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসকরূপে সমাজে
দৃপ্ত পদক্ষেপ রাখছেন কাদম্বরী বসু। সঙ্গিনী হচ্ছেন অবলা বসু, চন্দ্রমুখী বসুদের মত
নারীরা। শিক্ষার আলোকে নারীকে এগিয়ে যেতে পথ দেখাচ্ছেন, নতুন এক সমাজের স্থাপনা করতে
উদ্যত। সেখানেই আরেকদিকে সমান্তরালভাবে রমরমিয়ে চলছে অষ্টমবর্ষে গৌরীদানের নিয়ম। প্রতিবছর নীরবে স্বামীর ধর্ষণে অকালকুসুমের
মত ঝরে যাচ্ছে অপরিণত নাবালিকারা। নিরুত্তর
রক্ষণশীল সমাজ। সহবাস সম্মতি আইন তাঁরা কিছুতেই পাশ হতে দেবেন না। হিন্দু শাস্ত্রে
বিবাহ বা সহবাসে মেয়েদের সম্প্রদান করেন তাদের পিতা, তাই সহবাসে অধিকার অপ্রয়োজনীয়।এই সামাজিক কুনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে - সহবাসের বয়সসীমা মাত্র ১০ বছর
থেকে বাড়িয়ে ১২-১৪ বছর করার জন্য।
কুসংস্কারে
ভরা অশিক্ষিত গ্রাম্য সমাজ, জাতিভেদ ও বর্ণভেদ প্রথা, বাল্যবিধবাদের উপর হওয়া অত্যাচার,
কুলীন প্রথা, দাসপ্রথা, ভিনদেশে গ্রাম্য দরিদ্র অসহায় মানুষদের চড়া দামে বিক্রি করে
ও পাচার করে মজুরব্যবসা, বহুবিবাহ, নারী শিক্ষার
প্রসারে বাধাদান – এই সমস্ত কিছুই এই উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহে জড়িত।গৃহ্যসূত্র
কিংবা মনুসংহিতার কদর্য রীতি এবং সমাজপতিদের লালসার সামনে সমাজের প্রতিটি
স্তরে মেয়েদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের চিত্র উঠে এসেছে এই উপন্যাসে বারবার।
অর্থাৎ, বারো
বছর হয়ে গেলেও যে পিতা কন্যাদান করেন না, তাঁর পূর্বপুরুষরা প্রতিমাসে অমর্ত্যলোকে
সেই কন্যার ঋতুকালীন রক্তপান করেন। অবিবাহিতা কন্যাকে
রজঃস্বলা দেখলে মা ও বড় ভাই নরকে যান।সুতরাং
শৈশবেই যেন-তেন-প্রকারেণ গৌরীদান সম্পন্ন করতেই হবে। হোক না সে পাত্র শ্মশানগামী বৃদ্ধ।
তবু পরিজনের নরকবাস রোধ করতে শিশুকন্যাকে জীবন্ত নরকভোগে ঠেলে দিতে বিন্দুমাত্র চিন্তার
অবকাশ নেই।
‘অষ্টবর্ষা ভবেদ গৌরী’র নামে শৈশবেই বিয়ের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে মেয়েদের জীবনে নেমে আসা দুর্ভোগ,নির্যাতনে একচোখা সমাজ, পুত্রলাভের আশায় ঋতুমতী না হওয়া অবলা শিশুকে বলপূর্বক বিবাহ ও ধর্ষণের মত সংঘটিত হতে থাকা অমানবিকতার ঘটনা পড়ে বাক্রুদ্ধ হতে হয়। হতভাগী অপালাকে বুকে জড়িয়ে নবকিশোরের স্ত্রী দয়াময়ীর কান্নাজড়িত বাক্য পাঠককে যন্ত্রণায় স্তব্ধ করে দেয় –
“মরেচিস তো সেদিন যেদিন মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেচিলি মুখপুড়ি! আবার নতুন করে কী মরবি! “
কিছু ঘটনা আনন্দদায়ক, কিছু অত্যন্ত বেদনাদায়ক।এই কাহিনির লক্ষ্য হল পুরুষতন্ত্র।বইটি সুলিখিত ও সুমুদ্রিত।তবে উপন্যাসের
সমাপ্তি ঘটেনা। বহু ঘটনা অসমাপ্ত রয়ে যায়। লেখিকা নিজেই যা উপন্যাসের শেষে উল্লেখ করেছেন।
অসমাপ্ত ঘটনাগুলি পরবর্তী খণ্ডে জানাবেন বলেও জানিয়েছেন। ইতিহাস নির্ভর সময়কালের উপর
ভিত্তি করে কাল্পনিক ও কিংবদন্তী ঐতিহাসিক চরিত্রের সমন্বয়ে রচিত এই উপন্যাস পাঠককে
মুগ্ধতায় ভরিয়ে রাখবে বহুদিন। সাথে বইয়ের ভিতরের
সুন্দর অলংকরণও তৃপ্তিদায়ক।
0 মন্তব্যসমূহ