প্রসংগত উল্লেখ্য, বিগত দেড়দশক ধরে
দেশে কেন্দ্রীয় সরকার নামক রাষ্ট্রযন্ত্রটি স্থায়িত্বের প্রশ্নে একটা অস্থিরতার
মধ্য দিয়ে চলেছে। নব্বইয়ের দশকে দেশে ক্ষণস্থায়ী বহু মিলিজুলি সরকার একের পর এক
দেখা যাবার পর অবশেষে ১৯৯৯ থেকে বেশ কয়েক বছরব্যাপী দীর্ঘ সময় ধরেই পরপর দু'টি বড় রাজনৈতিক
দলের নেতৃত্বে তৈরী গুটিকয়েক দলের বিশেষ দু'টি ভিন্ন গোষ্ঠীই স্থায়ীভাবে সরকার পরিচালনা
করতে পেরেছিল। তারপর দেশবাসী আবারো সেই আগের মতোই মিলিজুলি অস্থায়ী সরকার দেখতে
অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, যাদের চেহারাছবি আগের থেকেও বিচিত্রতর।
প্রথমে ঠিক
হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর
মিশ্র-নামটিতে শরিক দলগুলোর সর্ব্বোচ্চনেতাদের নাম তাদের দলের পাওয়া সীটের
সংখ্যানুযায়ী এক এক করে সীটসংখ্যার ক্রমহ্রাসানুসারে সাজাতে হবে, যাতে দলগুলোর
তুলনামূলক শক্তি স্পষ্ট বোঝা যায়। পরে অবশ্যি পার্লামেন্টের সাংস্কৃতিক কমিটির
সুপারিশে তা বাতিল হয়; কারণ সেক্ষেত্রে মিশ্র-নামটির শ্রুতিমাধুর্য
বিঘ্নিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়। তাই অপেক্ষাকৃত বেশী সীটপ্রাপ্ত দলগুলো
গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে গোঁ ছাড়তে রাজী হয় এবং নিজেদের শক্তি বোঝানোর
চুলচেরা হিসেবের ঊর্ধ্বে উঠে উচ্চারণের সুবিধে এবং ধ্বনিগত সাযুজ্যকেই মেনে নেয়; এমনকি জনগণের
মস্তিষ্কে অযথা চাপ কমাতে প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর নামটির গঠনে সহজ সন্ধি-সমাসের
প্রয়োগও চলতে পারে বলে ঐক্যমত গঠিত হয়।
আজ একটু পরেই যিনি শপথ নিতে যাচ্ছেন, সেই নতুন প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে ঠিক কোন্ নামে পরিচিত হবেন, তা কিন্তু এখনো সরকারীভাবে ঘোষিত হয়নি। তবে দু’একদিনের মধ্যেই সেই ঘোষণা সম্ভব হয়ে যাবে বলে বিশ্বস্তসূত্রে প্রকাশ। অবশ্যি ইতিমধ্যেই ওয়াকিবহাল মহলে জোর ধারণা, নতুন নিয়ম মেনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নাম হ’তে চলেছে- শ্রী হরিদাসা চন্দ্রোপাধ্যায় তেজস্বীরাও করুণাপালানিস্বামী মায়াজ্জাদব মুফতিরোবিন্দ পাওয়ারাব্দুল্লা। নামটা বড্ড লম্বা শোনাচ্ছে বটে, কিন্তু শরিকদলের অতিরিক্ত সংখ্যাধিক্য এবং দেশব্যপী বিস্তৃত অঞ্চলভেদে মনুষ্যনাম গঠনে শব্দের ও ঢংয়ের বিরাট তারতম্য থাকায় গৃহীত ফর্মূলাটি মেনে ঐটি ছাড়া আর কোন উপায়ান্তর নেই। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত এই যে, সুবিশাল এই দেশের কোন সচেতন নাগরিকই প্রস্তাবিত নামটা শুনে হয়তো জ্ঞান হারাবেন না, কারণ এই ভারতেরই দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও কোথাও নাকি এধরণের বড় বড় নাম বহুলপ্রচলিত।
এবারও কিছুটা তাক লাগিয়ে এককভাবে দু'শর সামান্য কিছু বেশী আসনে জিতে যাওয়া 'অহঙ্কারী ও অশুভ' দলটির কবল থেকে দেশকে বাঁচাতে এহেন গোঁজগাজার সুরক্ষাকবচ ছাড়া 'উদার ও শুভশক্তিসম্পন্ন' দলগুলোর কাছে নাকি আর কোন রাস্তাই খোলা ছিল না! তাই আসামের প্রাক্তন জঙ্গী নেতা শ্রীহরিদাসাজীকেই তাদের বেছে নিতে হয়েছে। মূলস্রোতে আত্মপ্রকাশের আগে শ্রীহরিদাসাজী অবশ্যি অন্য একটা ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন, তবে সেটা বর্তমানে অপ্রাসঙ্গিক বলে অনুল্লিখিতই রাখছি। অবশ্যি অত্যুৎসাহী বাঙালীরা কিছুটা আত্মতৃপ্তি পেতেই পারেন, কারণ এবারের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বাংলার অপেক্ষাকৃত নিকটতর প্রতিবেশী একটি রাজ্যের জলহাওয়ায় বড় হওয়া একজন মানুষ!
এদিকে দীর্ঘদিন সংসদীয় গণতন্দ্রের প্রতি দায়বদ্ধ, বর্তমানে পার্লামেন্টের চতুর্থ ক্ষুদ্রতম দলটিকে কিন্তু এখন নজিরবিহীন উদারতা দেখাতে হচ্ছে। শাসকপক্ষের তিন শরিকদলের থেকে বেশী আসন পাওয়া সত্বেও প্রধানমন্ত্রীর পবিত্র মিশ্র-নামটি থেকে তাদের নেতৃত্বের নামচিহ্নটুকু কোয়ালিশন সংস্কৃতির স্বার্থে ওরা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, কারণ তারা এবারও সরকারকে শুধু বাইরে থেকেই সমর্থনকারী। তাই দলটির চিরকালের সম্বল, দেশের সেই বিশেষ ঐতিহ্যবাহী পদবীটির কোন ছাপই প্রধানমন্ত্রীর ব্যবহৃতব্য নতুন নামটির মধ্যে নেই। তবে হ্যাঁ, সাকুল্যে পাঁচটি আসন পাওয়া আসামের শ্রীহরিদাসাজীকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বসাতে পারা এবারও এই পারদর্শী চৌকশ দলটিরই এক সুকৌশলী সাফল্য- অনেকটা বিগত শতকে নব্বুই-এর দশকের প্রথমদিকে কর্ণাটক থেকে খুঁজে নেওয়া প্রতিযোগীবিহীন সেই নিরীহ প্রধানমন্ত্রীকে আবিষ্কারের মতোই। তবে জনমত এই যে- রাজা বানানো দল বা তার নেতা/ নেত্রীর প্রতি আনুগত্যভরা গোপালসুলভ প্রতিদানী আচরণের মাপকাঠিতে নাকি আগের জঙ্গীপনা ও ঔদ্ধত্য ত্যাগ করা আজকের এই নতুন প্রধানমন্ত্রী অনেক এগিয়ে। একমাত্র চৌত্রিশ বছর আগে পাঞ্জাব থেকে পাওয়া পরপর দু’টি পূর্ণ মেয়াদের প্রধানমন্ত্রীর সাথেই এবিষয়ে তার অধুনা-অর্জিত আনুগত্যের তুলনা চলতে পারে, যদিও দু’জনের বিদ্যার ফারাক কিন্তু আকাশপাতাল।
দূর থেকে লালকেল্লার শীর্ষে জাতীয় পতাকার আশু দায়গ্রহীতা দণ্ডটির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম- আফশোস করে কোন লাভ নেই। বিগত পনের বছরে কেন্দ্রীয় সরকার বারবার ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে চলায় ভারতের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী সংস্থা তথা পার্লামেন্টের কাছে প্রধানমন্ত্রীর ব্যবহার্য মিশ্র-নাম ইস্যুটিতে যুগোপযোগী হস্তক্ষেপ করা ছাড়া আর কি বিকল্পই বা খোলা ছিল? এতসব করেও পরপর তৈরী সরকারগুলোকে হাতে গোনা কয়েক মাসের বেশী টেঁকানো যাচ্ছে কৈ? মিলিজুলির খেলায় কখন কে যে কোন্ দিক থেকে ফায়দা তোলার জন্যে বড়শির ফাৎনার ওৎটি পেতে বসে থাকে তার কি কোন ঠিক আছে?
এতক্ষণে
সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ শুরু হয়ে গেছে। মাননীয় নতুন প্রধানমন্ত্রীজী ডায়াসের দিকে
এগুচ্ছেন। মহাভারতের সঞ্জয়ের মত দেখতে পাচ্ছি- নেতাদের অনুশীলিত পরনিন্দা, দ্বেষ আর
শ্লেষাত্মক মন্তব্যের কু-অভ্যাস ছাপিয়ে জনতার লক্ষ লক্ষ কন্ঠ যেন সম্পূর্ণ
প্রস্তুত। উত্তোলনের জন্যে প্রস্তুত তেরঙা পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে জাতীয়-সংগীত গাইবার
জন্যে তারা হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা নিয়ে জড়ো হয়েছেন। চলমান প্রবণতায়
শ্রীহরিদাসাজী হয়তো মাত্র একবছর বাদে, মানে ২০৪২- এর ১৫ই আগষ্ট-ই লালকেল্লা থেকে
তেরঙ্গা তোলার অধিকার হারিয়েও ফেলতে পারেন, কিন্তু বহু-আকাঙ্ক্ষিত সেদিনের সেই সোনার ভারত
গড়তে আবহমান কাল অব্দি এই পতাকা পাহারা দিয়ে বয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব তো এই বৃহত্তর
আপামর জনগণের সজাগ চোখের উপরই বর্তায়।
(আবারো টাইম-মেশিনে বিশ বছর এক মাস পিছিয়ে এসে আজ পরিবেশিত।)


0 মন্তব্যসমূহ